শিক্ষা একটি জাতির মূল ভিত্তি এবং উন্নতির চালিকাশক্তি। এটি কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয় বরং একটি শক্তি, যা ব্যক্তি, সমাজ এবং জাতির অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে শিক্ষার উদ্দেশ্য, পদ্ধতি এবং কাঠামো নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগে শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কেমন হওয়া উচিত?
Advertisement
একটি শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে তৈরি করা যায়, যা কেবল চাকরি প্রদানে সক্ষম হবে না বরং সৃজনশীল এবং মানবিক দক্ষতা বিকাশেও সহায়ক হবে?
শিক্ষার ভূমিকা: বর্তমান এবং ভবিষ্যৎআজকের যুগে শিক্ষা শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এটি হতে হবে এমন একটি পদ্ধতি, যা শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের জন্য প্রস্তুত করে। উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং এবং রোবটিক্সের মতো প্রযুক্তি কর্মক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন সুযোগ তৈরি করছে।
তাই শিক্ষাব্যবস্থায় কর্মমুখী শিক্ষার পাশাপাশি, প্রযুক্তিমুখী শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
Advertisement
• শিক্ষার্থীদের কোডিং, রোবটিক্স এবং ডিজিটাল লিটারেসির মতো দক্ষতায় পারদর্শী করে তোলা প্রয়োজন।• ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR) এবং অগমেন্টেড রিয়ালিটি (AR) প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠদানের পদ্ধতি আরও কার্যকর এবং আকর্ষণীয় হতে পারে।
কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাশিক্ষাব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে তত্ত্ব নির্ভর ছিল, কিন্তু এখন সময় এসেছে এটি ‘কাজ শেখা’ এবং বাস্তব দক্ষতার ওপর জোর দেওয়ার। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে, জার্মানি এবং জাপানের কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থাকে দেখা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা কর্মক্ষেত্রের জন্য প্রস্তুত হয়।
তবে, আমাদের শুধু কর্মমুখী শিক্ষাই নয়, প্রযুক্তিগত এবং মানবিক শিক্ষার একটি ভারসাম্য প্রয়োজন।
আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকা: শিক্ষাদানের দৃষ্টিভঙ্গিশিক্ষক কেবলমাত্র একটি পেশা নয়; এটি একটি মহান দায়িত্ব। একজন আদর্শ শিক্ষক শুধু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বা ভালো ফলাফলের জন্য তৈরি করেন না, বরং তাদের মনের গভীরে প্রভাব ফেলেন।
Advertisement
আমার বড় ভাই, প্রফেসর ড. মান্নান মৃধা, সুইডেনের কেটিএইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক, একজন আদর্শ শিক্ষকের উদাহরণ। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বাস্তব জীবনের উদাহরণ এবং আনন্দময় পদ্ধতির মাধ্যমে জটিল বিষয় সহজে বোধগম্য করে তুলেছেন।
উদাহরণস্বরূপ• তিনি ক্লাসে গল্পের মাধ্যমে বিজ্ঞান বোঝান।• শিক্ষার্থীদের কৌতূহল বাড়ানোর জন্য বাস্তব জীবনের উদাহরণ ব্যবহার করেন।• পরীক্ষার চাপে শিক্ষার্থীদের হতাশ না করে, তাদের সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করেন।
শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যাগুলো এবং তাদের সমাধানআজকের শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষার ফলাফলের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল। এতে সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই এর সমাধানে ‘প্রজেক্ট-ভিত্তিক লার্নিং’ এবং ‘ক্লাসরুম-বাইন্ডারী শিক্ষা’ চালু করা দরকার।
এছাড়া, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। উদাহরণস্বরূপ,
• প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল শিক্ষার সুযোগ দেওয়া।• শিক্ষকদের জন্য এআই এবং ইন্টারেক্টিভ টুল ব্যবহারের প্রশিক্ষণ চালু করা।
স্টাডি লোন: শিক্ষার্থীদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপউন্নত দেশের আদলে আমাদের দেশে স্টাডি লোন চালু করা জরুরি। কম সুদে সহজ শর্তে লোন প্রদান শিক্ষার্থীদের আর্থিক চাপ কমিয়ে আত্মনির্ভরশীল করতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করবে এবং কর্মজীবনে প্রবেশের পর তারা ধীরে ধীরে এই লোন পরিশোধ করতে পারবে।
যেমন, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডে স্টাডি লোন ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের মধ্যে আর্থিক স্বাধীনতা এবং সৃজনশীল কাজের সুযোগ বাড়িয়েছে। আমাদের দেশেও এমন ব্যবস্থা চালু করা হলে এটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার উদাহরণবিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের জন্য একটি মডেল হতে পারে।
১. ফিনল্যান্ডের শিক্ষা পদ্ধতি: পরীক্ষামূলক চাপ কমিয়ে সৃজনশীলতা ও সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হয়।২. জাপানের কারিগরি শিক্ষা: কর্মমুখী দক্ষতার জন্য বিখ্যাত।
এই উদাহরণগুলো অনুসরণ করে আমাদের দেশেও একটি টেকসই এবং ভবিষ্যতকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত জাতি গঠনআমরা যদি শিক্ষাকে শুধুমাত্র চাকরিমুখী শিক্ষা হিসেবে দেখি, তবে এটি ভবিষ্যতের জন্য যথেষ্ট হবে না। আমাদের এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা দরকার, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল, মানবিক এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতায় সমৃদ্ধ করে তোলে।
আজকের শিক্ষাব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত১. শিক্ষার্থীদের মেধার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটানো।২. তাদের সৃজনশীল এবং সমস্যার সমাধানকারী হিসাবে গড়ে তোলা।৩. তাদের নৈতিক এবং মানবিক গুণাবলিতে উজ্জীবিত করা।
উপসংহার: শিক্ষার ভবিষ্যৎ আমাদের হাতে
শিক্ষাব্যবস্থা শুধুমাত্র একটি কাঠামো নয়; এটি একটি জাতির আত্মা। যদি আমরা আজকের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক, সৃজনশীল এবং মানবিকভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পারি, তবে আগামী প্রজন্ম একটি শান্তিপূর্ণ এবং উন্নত বিশ্বের নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
আমাদের উচিত শিক্ষা ও শিক্ষকতার প্রতি গভীর মনোযোগ দেওয়া এবং প্রযুক্তি ও মানবিক গুণাবলির সমন্বয়ে একটি টেকসই ভবিষ্যতের পথ তৈরি করা।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেনRahman.Mridha@gmail.com
এমআরএম/জিকেএস