আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা সমীকরণ ও হিসাব-নিকাশ চলছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় সংস্কার ইস্যুটি। ঠিক কতখানি সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার করতে চায়, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের জন্য সরকারকে কতটা সময় দিতে ইচ্ছুক—এসবই এখন মূল আলোচনা হয়ে উঠছে।
Advertisement
তবে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ‘সংস্কারবিরোধী’ আখ্যা দেওয়াকে দলটি দেখছে ‘একটি মহলের পরিকল্পিত অপপ্রচার’ হিসেবে। ‘সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু একটি মহল, একটি চক্র অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী বলে প্রচার করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে’- বলছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
গুলশান কার্যালয়ে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, একটা গোষ্ঠী বিএনপি হেয় করতে ও ভুলভাবে চিত্রায়িত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েকজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মিথ্যা প্রচারণা সমানে করে যাবেন আর মনে করছেন জনগণ সাড়া দিচ্ছে। জনগণ তাতে সাড়া দিচ্ছে না।
তবে ওই ব্যক্তিরা কারা কিংবা কোন গোষ্ঠী বিএনপির বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে তিনি সেটি প্রকাশ করেননি। যদিও দলটির পক্ষ থেকে বক্তব্যটি এমন সময়ে এলো যখন সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে চূড়ান্ত আলোচনার পর্যায়ে আছে।
Advertisement
ঐকমত্য কমিশনেরই এক সভার পর গত ৩০ জুন নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন অভিযোগ করেছিলেন, মৌলিক সংস্কারের জায়গা বিএনপি ও তাদের সমমনা কয়েকটি দলের কারণে আটকে আছে।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক নেতা ও সমর্থকদের সমন্বয়ে গড়া এবি পার্টির একজন নেতা বিএনপির নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, বেশিরভাগ দলের একটা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও কোনো একটি জায়গায় দিয়ে সেটি ঠেকে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, জনভিত্তি ধরে রাখার কৌশল হিসেবে বিএনপি সংস্কার চায় বললেও অনেকগুলো বিষয় নির্বাচিত সরকার করবে বলে তারা বলছে। তবে সেগুলো পরে আর হবে কি না, তা নিয়ে অন্যদের মধ্যে উদ্বেগ আছে।
একটি মহল ও চক্র বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিএনপি পরীক্ষিত উদারপন্থি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং দলটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে না
Advertisement
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করছেন, সামনের নির্বাচনে বিএনপি ভালো করবে মনে করে অনেকে সম্মিলিতভাবে এ বিষয়টি ঘিরে অপপ্রচার চালাচ্ছে যেন দলটিকে নির্বাচনে বিপাকে ফেলা যায়। সেজন্যই হয়তো বিএনপি উদ্বিগ্ন হয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছে।
সংস্কার নিয়ে কী বলছে বিএনপিরোববারের সংবাদ সম্মেলনে শুরুতেই বিএনপি মহাসচিব বলেন, অনেকে সংস্কার সম্পর্কে বিএনপিকে নিয়ে কথা বলছেন, যেগুলো সঠিক নয় এবং সংস্কারের প্রতি বিএনপির অঙ্গীকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
বিএনপির পক্ষ থেকে ২০১৬ সালে দেওয়া ভিশন ২০৩০, ২০২২ সালে দেওয়া ২৭ দফা এবং ২০২৩ সালে দেয়া ৩১ দফার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি অভিযোগ করেন, একটি মহল ও চক্র বিএনপিকে সংস্কারবিরোধী বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিএনপি পরীক্ষিত উদারপন্থি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং দলটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে না।
মির্জা ফখরুল বলেন, একটা গোষ্ঠী বিএনপিকে নিয়ে ভুলভাবে চিত্রায়িত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েকজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মিথ্যা প্রচারণা সমানে করে যাবেন আর মনে করছেন জনগণ সাড়া দিচ্ছে। জনগণ সাড়া দিচ্ছে না। এটাতে লাভ হবে না। কারণ মানুষ বিএনপি চেনে।
সংস্কার নিয়ে বিএনপিকে দোষারোপের সঙ্গে নির্বাচনকে বিলম্বিত করার কোনো চেষ্টা আছে বলে বিএনপি মনে করে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দেবো না। তবে নির্বাচনকে যারা বিলম্বিত করতে চায় তারা গণতন্ত্রের পক্ষের নয়, জুলাই আগস্টের বিপ্লবের পক্ষের শক্তি নয়। বিএনপি সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া ও বিরূপ মনোভাব তৈরির চেষ্টা সফল হবে না।
এদিন সংবাদ সম্মেলনে দলের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমতে পৌঁছার জন্য আমাদের প্রতিনিধিরা সভায় অংশগ্রহণকারী অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা এবং অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে হলেও একমত হয়ে কমিশনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো যে সব প্রস্তাব পেশ করেছেন, তার বিপরীত কিম্বা নতুন নতুন প্রস্তাব উত্থাপন এবং তা নিয়ে অনেক সময় অচলাবস্থা সৃষ্টির কারণে কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে।
সেখানে আরও বলা হয়, রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার নামে জনগণের নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার তথা রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল ও অকার্যকর করার কোনো প্রস্তাবের যুক্তিসঙ্গত বিরোধিতা সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।
লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়েছে, দুদক সংস্কার কমিশনে কতিপয় ছাড় দিয়ে ৪৭টি সুপারিশের ৪৬টিতে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি সুপারিশর মধ্যে ১৮৭টি প্রস্তাবে, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি সুপারিশে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে বিএনপি একমত হয়েছে।
বিএনপি বলছে, সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে আমরা দফা ওয়ারী মতামত দিয়েছি। অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ৭০ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ। দুই বিষয়েই আমরাই ছাড় দিয়েছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার বিধান বিশ্বের কোথাও না থাকার পরেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা সম্মত হয়েছি। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়েও আমরা আমাদের প্রস্তাব থেকে সরে এসে একমত হয়েছি।
রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিংবা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন করার অধিকার কোনো ব্যক্তি দল কিংবা কমিশনের আছে কি না তা' বিবেচনায় নিতে হবে
‘জাতীয় সংসদে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪টিসহ আসন সংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ দিতেও আমরা সম্মত হয়েছি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে আমরা সম্মত হওয়ায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে’- বলছে বিএনপি।
এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনি এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার আনার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধন ও আইনের মাধ্যমে বিশেষায়িত কমিটি গঠনেও বিএনপি একমত হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
মির্জা ফখরুল জানান, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়ে তারা সেটি বিচার বিভাগের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন।
অপপ্রচারে উদ্বেগ কেন?বিএনপি বলছে, সংস্কার কমিশন সমূহের প্রস্তাবের উপর আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও নিত্যনতুন এমন সব প্রস্তাব আসছে, যেগুলো রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সংসদ পরিচালনায় বিপুল প্রভাব ফেলবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এসব প্রভাব ইতিবাচক হলে অবশ্যই তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিংবা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন করার অধিকার কোনো ব্যক্তি দল কিংবা কমিশনের আছে কি না তা' বিবেচনায় নিতে হবে।
লিখিত বক্তব্যে দলটি আরও বলছে, ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে অধিক ক্ষমতা দিলে যেমন ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়, ঠিক তেমনই নির্বাচিত সরকার এবং সংসদকে ক্ষমতাহীন করলে রাষ্ট্র দুর্বল, ভঙ্গুর ও অকার্যকর হয়।
দেশের প্রধান এ রাজনৈতিক দলটি ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিভিন্ন দলের নতুন নতুন প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে সায় দিচ্ছে না বলে অনেকের কাছে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো ও সংবিধান সংশোধন নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির কিছু প্রস্তাবে বিএনপি স্পষ্ট আপত্তি করেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো ধারণা দিয়েছে।
এ কারণে ‘বিএনপি সংস্কার চাইছে না’- এমন প্রস্তাব মাঠে নিয়ে আসা হয়েছে বলে ধারণা করছেন বিএনপি নেতারা। তারা মনে করছেন- মূলত, সংবিধান পরিবর্তন কিংবা সম্ভাব্য সংস্কার বিষয়ে বিএনপিকে চাপে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপির মূল বক্তব্য হলো নির্বাচিত পার্লামেন্টে এগুলোর সুরাহা হওয়া উচিত।
অনেক বিষয়েই সংস্কার প্রস্তাব বিএনপি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে করতে চাইছে। অনেকেই মনে করেন সরকারে গিয়ে এগুলো আর করবে না বলে বিএনপি এমন বক্তব্য দিচ্ছে। কারণ, করলে তো এখনই করতে পারে
অন্যদিকে, কথিত ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে বিএনপির সঙ্গেও অন্য কয়েকটি দলের মতবিরোধ তৈরি হয়েছে বলে ধারণা অনেকের। যদিও এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, জুলাই সনদের বিষয়ে আমরা বহু আগে আমাদের মতামত দিয়েছি ঘোষণাপত্রের বিষয়ে। এরপর সরকার বলেছে তারা এটা করবে। কিন্তু তারা করেনি। এ ব্যাপারে আমাদের সমস্যা নেই। আলোচনায় আমরা প্রস্তুত আছি।
আবার সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন নিয়েও অন্য দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে দলটির। এ নিয়ে এক প্রশ্নে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, পিআর হলো গোটা নির্বাচনব্যবস্থা বদলে দেওয়া। এ নিয়ে জনগণের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে? এ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা শুরুই হয়নি।
‘অনেক বিষয়েই সংস্কার প্রস্তাব বিএনপি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে করতে চাইছে। অনেকেই মনে করেন সরকারে গিয়ে এগুলো আর করবে না বলে বিএনপি এমন বক্তব্য দিচ্ছে। কারণ, করলে তো এখনই করতে পারে’- বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ।
‘মানুষ কিছু পরিবর্তন চায় এবং সবকিছু আগের মতো থাকুক তা তারা চায় না। নির্বাচন হলে বিএনপি ভালো করবে বলে মনে করে। এ কারণে কিছু মানুষ সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করছে যে বিএনপিকে যদি দোষী সাব্যস্ত করা যায়। তাহলে বিএনপিকে নির্বাচনে বিপাকে ফেলা যাবে বলে তারা মনে করেন। সেই অপপ্রচারে কুলিয়ে উঠতে পারছে না বিএনপি, সেজন্যই তারা আশঙ্কা করছে এমন প্রচারণা তাদের জন্য ক্ষতিকর। হয়তো সেটাই তাদের চিন্তার কারণ’- বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ।
খবর বিবিসি বাংলার
এমকেআর