নারী ও শিশু

নারীর হাতে ঘুরছে সংসারের চাকা, বদলে গেছে দুটি গ্রাম

বাঁশ আর বেত। দুইয়ের মিশেলে নিপুণ হাতে বানাচ্ছেন একেকটি মোড়া। এভাবেই গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মোড়া তৈরি করে টেনেটুনে চলা সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা এনেছেন খাগড়াছড়ির কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়ার নারীরা। এসব নারীর হাত ধরে শুধু পরিবার নয়, বদলে গেছে দুটি গ্রাম।

Advertisement

মাটিরাঙ্গা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরের নিভৃত গ্রাম কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়া। তীব্র ইচ্ছাশক্তি আর কঠোর পরিশ্রম এক করে এ জনপদের নারীরা হাঁটছেন সফলতার পথে। পিছিয়েপড়া এ জনপদের নারীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় গ্রাম দুটির প্রতিটি বাড়ি হয়ে উঠেছে ছোট ছোট কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান।

সরেজমিনে মাটিরাঙ্গার কাজীপাড়া ঘুরে দেখা যায়, বাড়ির উঠানে মোড়া তৈরি করছেন আয়েশা আক্তার। মায়ের সঙ্গে বসে নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় বাঁশ-বেতের সমন্বয়ে মোড়া তৈরি করছেন কলেজ পড়ুয়া আঁখি। শুধু আঁখিই নন, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া এমন অনেকেই লেখাপড়ার ফাঁকে মায়ের সঙ্গে মোড়া তৈরির কাজ করেন।

মোড়া বানানোর ফাঁকে কথা হলে আয়শা বেগম জানান, দীর্ঘ ৭-৮ বছর ধরে মোড়া তৈরি করছেন। আগে একজনের আয়ে সংসার চলতো। এখন স্বামীর পাশাপাশি তিনিও আয় করছেন। সংসারের খরচের পর বাড়তি টাকা সঞ্চয় করেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই আছেন।

Advertisement

একটু দূরেই পাশের বাড়িতে মোড়া তৈরি করছেন দুই জা আকলিমা বেগম ও আমেনা বেগম। তারা বলেন, এখানকার প্রতিটি বাড়িতেই মোড়া তৈরি করা হয়। পরিবারের কাজ শেষে সবাই মোড়া তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। কারও যেন অবসর নেই। মোড়া তৈরি করে সবার পরিবারেই কমবেশি আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে।

অবসর সময়ে মোড়া তৈরি করে কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়ার নারীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে দাবি করে হাতিয়াপাড়ার জেসমিন আক্তার বলেন, আমরা নারী, আমরাও পারি। ইচ্ছাশক্তি থাকলে নারীরাও পারে পরিবারের সচ্ছলতায় ভূমিকা রাখতে।

আরও পড়ুন• নারী জামানতকারী দেখিয়েও ঋণ নিতে পারবেন নারী উদ্যোক্তারাই-জয়িতা মার্কেটপ্লেস নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকা রাখবে: মন্ত্রীসফল নারী উদ্যোক্তা জেমির গল্প

পাহাড়ের এসব সংগ্রামী নারীর পাশে দাঁড়িয়েছেন গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীন। তিনি কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়ার শতাধিক নারীকে মোড়া তৈরির উপকরণ দিয়ে তাদের সংগ্রামে সারথি হয়েছেন। তার মানবিক সহায়তায় নারীরাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

Advertisement

আকার ও মান অনুযায়ী প্রতি জোড়া মোড়া বিক্রি হয় ৬শ থেকে শুরু করে ১২শ টাকায়। প্রতি সপ্তাহে তিন-চার জোড়া মোড়া তৈরি করেন একেকজন নারী, যা থেকে একেকজন সপ্তাহে দুই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করেন।

কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়ার নারীদের তৈরি এসব মোড়া জায়গা করে নিয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীসহ সমতলের জেলাগুলোতে। স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে এসব মোড়া সমতলের জেলায় বাজারজাত করার মতো কাজটি করেন স্থানীয় পাইকার মো. দেলোয়ার হোসেন।

কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়ার নারীরা বোঝা না হয়ে সংসারের হাল ধরেছেন মন্তব্য করে মাটিরাঙ্গা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আলাউদ্দিন লিটন জাগো নিউজকে বলেন, মোড়া তৈরিতে নিয়োজিত নারীরা যথাযথ প্রশিক্ষণ পেলে এটি পাহাড়ের একটি সম্ভাবনাময় শিল্প হিসেবে গড়ে উঠবে।

গাজীপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীন বলেন, নারীরাও পারে এটার অনন্য উদাহরণ গড়েছে কাজীপাড়া ও হাতিয়াপাড়ার নারীরা। তারা শুধু পারিবারিক কাজে নিজেদের আটকে না রেখে অবসর সময়ে মোড়া তৈরি করে বাড়তি আয় করছে। দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা মোড়াকে শিল্প হিসেবে ঘোষণার দাবি জানাই।

মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ডেজী চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতায় ভূমিকা রাখা এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। তাদের ঋণ দেওয়াসহ মোড়া শিল্প এগিয়ে নিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।

মোড়াকে বিশেষ শিল্প হিসেবে ঘোষণা করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

মুজিবুর রহমান ভুইয়া/এএসএ/এমএস