ফিচার

চতুর প্রাণী যুবরাজ পতঙ্গ

ফড়িং অতি পরিচিত পতঙ্গের একটি। তিড়িং বিড়িং লাফিয়ে চলে। দেখলেই সে কী আদর! ধরার জন্য পিছু ছুঁটতে ইচ্ছে করে ছোট-বড় সব মানুষের। লাল টুকটুকে, হলুদ বা ধুসর রঙের ফড়িং হলে তো কথাই নেই। রাজ ফড়িংয়ের প্রতি আকর্ষণ আবার একটু অন্যরকম। এর আকার অন্যদের চেয়ে একটু বড়। বাড়ির আঙিনায় কিংবা জঙ্গলে হঠাৎ উড়ে এসে বসে এই কাঙ্ক্ষিত রাজা ফড়িং। আর হ্যাঁ। লাল ফড়িংকে রানী হিসেবে ভাবা হয়।

Advertisement

ফড়িং অত্যন্ত ধূর্ত এবং চতুর প্রাণী। এদের ধরা খুব কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ। ফড়িং ধরার জন্য দেশে-বিদেশে আছে নানা বৈচিত্র্য। বাংলাদেশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা পাটকাঠির এক প্রান্তে আঁঠা জড়িয়ে দূর থেকে ফড়িং শিকার করে থাকে। ফড়িংয়ের গায়ের উজ্জ্বল রং দিয়েই এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতি আলাদা করা যায়। ফড়িং দু’জোড়া শক্তিশালী স্বচ্ছ পাখা এবং দীর্ঘায়িত শরীর দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কোথাও বসে থাকার সময় এদের পাখা অনুভূমিক এবং শরীরের সাথে সমকোণে থাকে। ফড়িংয়ের অন্যান্য পতঙ্গের মতো ছয়টি পা থাকলেও এরা হাঁটতে পারে না। ফড়িংয়ের পা কাঁটাযুক্ত এবং ডালপালায় বসার উপযোগী। ডানার পৃষ্ঠদেশের দু’প্রান্তে দু’টো কালো ফোঁটা আছে। মনে হয় যেন এক জোড়া চোখ। ওরা ডানা মেলে পাতার গায়ের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে লেগে থাকে। সুনির্দিষ্ট আকৃতি সত্ত্বেও বিশেষ মনোযোগ দিয়ে না দেখলে চোখেই পড়ে না। পাতার ওপর চুনের দাগের মতো মনে হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, ‘ক্রমবিবর্তনের ফলেই হয়তো ফড়িংয়ের এই প্রকার অদ্ভুত আকৃতি-প্রকৃতি অভিব্যক্ত হয়েছে।’

ফড়িং তৃণভোজী বা শাকাশী প্রাণী। ডিম থেকে ফোঁটার পরপরই, নিম্ফ অবস্থায় ফড়িং চারপাশের যে কোনো ছোট ছোট, সহজপাচ্য গাছ, ঘাস বা নতুন কোমল শাখা-প্রশাখা খেতে শুরু করে। দু’একবার খোলস মোচনের পর একটু বড় হলে শক্ত উদ্ভিদের খাবার খায়। তরুণ বয়সের ফড়িং পূর্ণাঙ্গদের মতোই নির্দিষ্ট উদ্ভিদের খাবার খায়। ফড়িং যেহেতু ঘাস, পাতা, শস্যের কচিপাতা আহার করে, সে কারণে এমন ধরনের নিচু বসতিই এদের পছন্দ। মূলত সব ধরনের বসতিতেই বিভিন্ন ফড়িং দেখা যায়। স্বাদুপানি ও ম্যানগ্রোভ জলাশয়ে যেহেতু পানির ওঠানামা বেশি হয় এবং ডিম পাড়ার স্থান প্লাবিত হয়ে যায়, সে কারণে এসব বসতিতে ফড়িং কম বাস করে। প্রতিকূল আবহাওয়ায় ফড়িং বিপুল সংখ্যায় পরিযায়ী হয়। তখন এরা দিনে প্রায় ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। বিশ্বে এ পর্যন্ত প্রায় বিশ হাজার এবং বাংলাদেশে বিশ প্রজাতির ফড়িং শনাক্ত করা হয়েছে। সচরাচর পাখিরাই কীট-পতঙ্গের প্রধান শত্রু হলেও সাধারণত ফড়িংকে আক্রমণ করে না কোনো পাখি। ফড়িং তাই পাখিদের আশেপাশে নির্ভয়ে উড়ে বেড়ায়। ফড়িংদের পরস্পরের মধ্যে অবশ্য শত্রুতাও আছে যথেষ্ট। সুযোগ পেলে সবল দুর্বলকে আক্রমণ করে একদম খেয়ে ফেলে।

ফড়িংয়ের মাথা বড় এবং ইচ্ছেমতো ঘোরানো যায়। মাথার দু’পাশের প্রায় পুরোটা জুড়ে দু’টো অর্ধগোলক। উপর দিকে দু’পাশের চোখ গায়ে গায়ে মিশে গেছে। বেশ বড়। জীববিজ্ঞানীদের মতে, ‘ফড়িংয়ের এই অবাক করা চোখ আসলে বৃহৎ যৌগিক চোখ। কিছুটা ডিম্বাকৃতির এবং মোটরদানার মতো দেখতে।’ বিজ্ঞানীদের ভাষায়, ‘ফড়িংয়ের চোখ আসলে ডাশ দু’টো নয়। কয়েক হাজার। কারণ বড়-সড় একটি ফড়িংয়ের চোখে প্রায় আটাশ হাজার ছোট ছোট সরলাক্ষি ছাড়া ছাড়া অবস্থায় থাকে।’ বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানীদের মতে, ‘ফড়িং একশ কুড়ি ফুট দূরের জিনিসও স্পষ্ট দেখতে পায়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো অতিবেগুনি রশ্মি বা ‘আল্ট্রাভায়োলেট রে’ আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। ফড়িংয়ের চোখে ওই অতিবেগুনি রশ্মি শনাক্তকরণ ক্ষমতা আছে। ফড়িং এই ক্ষমতার জোরেই পরিষ্কার ঝকঝকে একটি পাতার মধ্যে থেকেও খাবার খুঁজে পায়। অনেক পাতা, ফুল ও ফলে এমন চিহ্ন আঁকা থাকে যা অতিবেগুনি রশ্মি ছাড়া দেখা সম্ভব নয়। ফড়িং আমাদের মতো চার রং দেখতে পারে না ঠিক। তবে এমন অনেক কিছুই ফড়িং দেখে থাকে, যা আমাদের চোখের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।’

Advertisement

ফড়িংয়ের চোখে দেখা নিয়ে গবেষকদের অবাক করা প্রশ্ন, ‘তাহলে আমাদের এই পৃথিবী নিশ্চয়ই ফড়িংয়ের চোখে অন্য জগৎ হয়ে ধরা পড়ে? বিজ্ঞানীরা এ প্রসঙ্গে স্পষ্ট করে জানান, ‘ফড়িংয়ের কাছে পৃথিবীটা কেবলই ছাই রঙের। তবে কোথাও গাঢ় কোথাও বা হাল্কা’। এর কারণ রং বুঝতে গেলে চোখের পর্দায় থাকা চাই রঞ্জক কণা। ফড়িংয়ের চোখের পর্দায় তা নেই। তবে অনেক ব্যাপারেই এই ফড়িং মানুষকেও ছাড়িয়ে গেছে। মাথা না ঘুরিয়ে ফড়িং চারপাশের যতটা জায়গা দেখতে পাচ্ছে, সামনে দু’পাশে এমনকি পেছনে। ওভাবে আমরা মানুষরা দেখতে পাচ্ছি না। মানুষের মতো ফড়িং চোখ দিয়ে দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস একসঙ্গে দেখতে পারে না। জীববিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানিয়েছেন, ‘ফড়িংয়ের নিজের শরীর যত লম্বা, কেবল তার বিশগুণ দূরের জিনিসই পরিষ্কার দেখতে পায়।’ জ্যান্ত না হয়ে টিভি পর্দায় কোনো ফড়িংয়ের ছবি দেখানো হলে তাও ঠিক ঠিক চিনতে পারে ফড়িং। অবশ্য সেটি বোঝা যায়, ফড়িং জ্যান্ত কিছু দেখছে তা অবলোকন করে। সে সময় ফড়িংয়ের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজিত চালচলন লক্ষ্য করা যায়।

ফড়িং দেখতে যত হাড্ডিসার দুর্বলই হোক, আত্মরক্ষা ও আক্রমণের শক্তি এদের প্রবল। এসব বৈচিত্র্যময় গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য আর প্রাণচাঞ্চল্যের জন্য ফড়িংকে আদর করে লোকে ডাকে ‘যুবরাজ পতঙ্গ’।

এসইউ/জিকেএস

Advertisement