খেলাধুলা

একক নৈপুণ্য নয়, ভারতকে হারাতে প্রয়োজন দলীয় প্রচেষ্টা

আচ্ছা বাংলাদেশ কি ওয়ান ম্যান আর্মি? সাকিব একাই কি সব শক্তির কেন্দ্রবিন্দু? ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাকিবের ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরির পর অধিনায়ক মাশরাফির কাছে রাখা হয়েছিল এ প্রশ্ন। নাহ, কোন ভিনদেশি নন, বাংলাদেশের এক সিনিয়র জার্নালিস্টই এ প্রশ্ন তুলেছিলেন।

Advertisement

অধিনায়ক মাশরাফি অবশ্য বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন, নাহ তা কেন হবে? আমরা মোটেও ওয়ান ম্যান আর্মি নই। কারো একার নৈপুণ্যের ওপর ভর করে নয়, আমরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ই ভাল খেলছি। হ্যাঁ, সাকিব এক্সট্রা অর্ডিনারি খেলছে, এক কথায় ‘ব্রিলিয়ান্ট’ পারফরম করছে। সাথে বাকিরাও অবদান রাখছে। মুশফিক ভাল খেলছে। তামিম-সৌম্য শুরুটা ভাল করে দিচ্ছে। রিয়াদ যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। লিটন প্রথম ম্যাচেই বাজিমাত করেছে। মোসাদ্দেকও নিজ দায়িত্বটা ভালই সামলাচ্ছে। আর বোলিংয়ে মিরাজ, সাইফউদ্দিন-মোস্তাফিজও কার্যকর অবদান রাখছে।

অধিনায়ক মাশরাফি খুব যে বাড়িয়ে বা ভুল কিছু বলেছেন তা নয়। সাকিব অনেক বেশি ভাল খেলেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও আফগানিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ যে তিনটি ম্যাচ জিতেছে, তার সবকটায় সাকিবই জয়ের নায়ক, ম্যাচ সেরাও।

দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ৭৫ রান, ১ উইকেট; ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৯৯ বলে ১২৪ রান, ২ উইকেট এবং সবশেষে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে ৫১ রান, ৫ উইকেট- দুর্দান্ত, দারুণ, অসাধারণ, অসামান্য বা অনন্য এমন কোন বিশেষণই অমন পারফরমেন্সের জন্য যথেষ্ঠ নয়। কারো একার পক্ষে যতটা ভাল খেলা সম্ভব, তাই খেলেছেন সাকিব এবং জয়ে বেশি অবদান রাখার এক অনুপম দৃষ্টান্ত।

Advertisement

এর মধ্যে তিন ম্যাচে সাকিব রেখেছেন তিন রকমের ভূমিকা। দুই প্রোটিয়া ফাস্ট বোলার রাবাদা ও লুঙ্গির মত প্রচন্ড গতির বোলারের বিপক্ষে বুক চিতিয়ে মাথা তুলে দাড়িয়ে সাকিব বাকিদের সাহস জুগিয়েছেন, দেখিয়েছেন ভয়-ডরের কিছুই নেই। সাহস আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেললেই হয়ে যাবে। বাকিরা তার পথে হাঁটায় রান গিয়ে ঠেকে ৩৩০।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও সাকিবের অসীম সাহসী ব্যাটিং শুধু পুরো দলকেই অনুপ্রাণিত করেনি, অন্যদের সাহস, আস্থা আর আত্মবিশ্বাসীও করে তুলেছিল। ওশানে থমাস, শ্যানন গ্যাব্রিয়েল, শেলডন কটরেলদের শর্ট বলের বিপক্ষে কত স্বচ্ছন্দে-অনায়াসে পুল, হুক, স্কয়ার কাট আর ড্রাইভ খেলা যায়, সাকিব তা দেখিয়ে দিয়েছেন। ক্যারিবীয়দের প্রচন্ড গতির বোলিংকে ‘থোরাই কেয়ার’ করা যায়- তা সাকিব চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

অন্যদিকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সাকিব প্রায় একা জিতিয়েছেন। শুরুতে ব্যাট হাতে হাফসেঞ্চুরি আর তারপরে বল হাতে আফগানদের স্পিন জাদুতে বশ করে আবার জয়ের নায়ক হয়ে ম্যাচ সেরা সাকিব।

তবে এর মানে এই নয় যে, বাকিরা কেউ কোন অবদান রাখেননি। ম্যাচের চালচিত্র বিশ্লেষণ করলে আর পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিচারে সাকিব অন্যদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে।

Advertisement

পরিসংখ্যানও তাই জানাচ্ছে। ৬ ম্যাচে সাকিবের একার রান ৪৭৬ (৭৫, ৬৪, ১২১, ১২৪*, ৪১, ৫১)। শুধু ব্যাট হাতে নয়, বল হাতেও সাকিব কম যাননি, নিয়েছেন ১০ উইকেট ((১/৫০, ০/৭১, ২/৪৭, ২/৫৪, ০/৫০, ৫/২৯ )। অলরাউন্ডার হিসেবে সেরা নৈপুণ্য।

সাকিব ছাড়া মুশফিকুর রহীমও মোটামুুটি রানে (৭৮+ ১৯+৪৪+ ১+ ১০২+৮৩= ২৩০) আছেন। এছাড়া সে অর্থে কেউ তেমন ভাল ফর্মে নেই। তামিম (১৬ + ২৪+ ১৯+৪৮+৬২+৩৬ = ২০৫), রিয়াদ (৪৬+২০+২৮+৬৯+২৭=১৯০) ও লিটন (৯৪*+২০+১৬= ১৩০) রান করলেও ধারাবাহিকতা কম। আর সৌম্য নিজেকে সে অর্ধে মেলে ধরতে পারেননি। প্রথম দুই ম্যাচে যাও খেলেছেন, তারপর থেকে কেমন যেন আড়ষ্ট (৪২+ ২৫+ ২+২৯+১০+৩= ১১১)। সে তুলনায় নিচের দিকে মোসাদ্দেক (২৬+২৬+১১+৩৫) সময়ের দাবি মেটানোর চেষ্টা করছেন।

মোদ্দা কথা ব্যাটিংয়ে সাকিব একাই ‘একশ’ আর মুশফিকও সাধ্যমত অবদান রাখছেন। বাকিরা অনেক পেছনে।

বোলিংয়ে খালি চোখে মনে হবে সে তুলনায় স্থিতি আছে। দুই পেসার মোস্তাফিজ ৬ খেলায় ১০ উইকেট (৩/৬৭+ ১/৭৫, ০/৪৮, ০/৩৭, ৩/৫৯, ১/৬৯) আর সাইফউদ্দিন ৬ খেলায় ১০ উইকেট (২/৫৭, ২/৭৮, ২/৪১, ৩/৭২) ১০ উইকেট করে পেয়েছেন বটে, কিন্তু ভাল বল করতে পারেননি। লাইনলেন্থে সমস্যা দুজনারই। নতুন বলে ব্যাটসম্যানের অফস্টাম্প ও তার আশপাশে বল না ফেলে অপ্রয়োজনে লেগ সাইডে বল করার প্রবণতা চোখে পড়েছে তাদের।

সে কারণেই কেউ সমীহ আদায় করতে পারেননি। তারপরও তারা দিন শেষে উইকেট পেয়েছেন। কিন্তু অধিনায়ক মাশরাফি তাও পাননি। বল হাতে টাইগার ক্যাপ্টেন অনেকটাই নিষ্প্রভ, অনুজ্জ্বল। বলে ধার যে কোন সময়ের চেয়ে কম। ৬ খেলায় একটি মাত্র উইকেট; এ পরিসংখ্যানই বলে দেয় নড়াইল এক্সপ্রেসের বোলিংয়ের ধার কত কম! বোঝাই যায়, উইকেট থেকে সাহায্য না পাওয়ায় মাশরাফির বল কাজ করছে কম। বল গ্রিপ করছে না একদমই। কাটারও ধরছে না।

আগে ছোট ছোট সুইং পেতেন, এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে শুরুর কয়েক ওভার ছাড়া পুরো বিশ্বকাপে মাশরাফি তার মানের ধারে কাছেও যেতে পারেননি। অনেক মাশরাফি ভক্তও প্রিয় ক্রিকেটারের বোলিং দেখে হতাশ। তবে ভেতরের খবর, মাশরাফি আসলে শতভাগ সুস্থ্য নন। হ্যামস্ট্রিং ভোগাচ্ছে। যে কারণে বলের ধার গেছে কমে।

অফ স্পিনার মিরাজ শুরু করেছিলেন ভালই। প্রথম তিন ম্যাচে (১/৪৪, ২/৬৭, ২/৪৭, ০/৫৭, ০/৫৯, ০/৫৬) পাঁচ উইকেট তুলেও নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর কোথায় যেন হারিয়ে গেছেন। শেষ তিন ম্যাচে একটি উইকেটও পাননি। এই হলো সংক্ষেপে টাইগারদের বিশ্বকাপ পারফরমেন্স।

যাতে পরিষ্কার, সাকিব নির্ভরতা কতটা? সাকিব ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটাচ্ছেন। ব্যাটিং করছেন একদম পরিণত আর বিশ্বমানের ব্যাটসম্যানের মত। যাকে যেখানে খুশি শটস নিতে পারছেন। আগের সেই তাড়াহুড়ো গেছে কমে। শুরু করছেন সতর্ক-সাবধানে বলের মেধাগুণ বিচার করে। একটু আলগা ওভার পিচ আর হাফ ভলি পেলে নিমিষেই সীমানার ওপারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। প্রাণপন চেষ্টায় আছেন ম্যাচ শেষ করে বিজয়ীর বেশে সাজঘরে ফিরতে।

এই কাজে মুশফিক সাধ্যমত চেষ্টা করছেন সাকিবের সাথী হতে। কিন্তু নিকট অতীত ও বিগত দিনগুলোয় বিশ্ব আসর ও বড় মঞ্চে তামিম-রিয়াদ যে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন, এখন পর্যন্ত দুজনার কেউ সে ভূমিকা নিতে পারেননি।

কঠিন বাস্তবতা হলো ভারত ও পাকিস্তানের ধারালো ও বৈচিত্রে ভরা বোলিংয়ের বিপক্ষে সাফল্য পেতে আগে দরকার ব্যাটিংয়ে সামর্থ্যের সেরা প্রয়োগ। ভুবনেশ্বর কুমার, জাসপ্রিত বুমরাহ, হারদিক পান্ডিয়া, ইয়ুজভেন্দ্র চাহাল, কুলদ্বীপ যাদবদের সাড়াশী বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে শুরুতে তামিম, তারপর সাকিব এবং মাঝ খানে মুশফিক-রিয়াদের (যদি কাফ মাসলের ইনজুরি কাটিয়ে খেলতে পারেন) মাথা তুলে দাঁড়ানো যে খুব দরকার। তবেই টাইগারদের আকাশে সাফল্যের সূর্য উদিত হবে।

বোলিং দিয়ে ভারতকে টলানো খুব কঠিন হবে। বাংলাদেশের বোলিংয়ের রীতিমত নড়বড়ে অবস্থা। একজন পেসার নেই যিনি প্রতিপক্ষ ব্যাটিং লাইনআপে কাঁপনভাঙন ধরাতে পারেন। মোস্তাফিজ আর সাইফউদ্দিনের বলে না আছে গতি বরং লাইনলেন্থ খুঁজে পেতেই অস্থির। তাই তো আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচ জিততে সাকিবের একার ওপর তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। সাকিব আফগানদের বিপক্ষে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করায় মিলেছে স্বস্তির জয়। না হয় কি হতো বলা কঠিন।

এমন নির্বিষ বোলিং দিয়ে ভারতের ব্যাটিং লাইনকে নাড়া দেয়া, কাঁপন ধরানো খুব কঠিন। রোহিত শর্মা , বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনি, হার্দিক পান্ডিয়ারা অনেক পরিণত। পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও অনেক বেশি। তাদের বধ করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। অনেক ভাল বোলিং করতে হবে।

আবার সেই সাকিবের কথায় ফিরে যেতে হচ্ছে, ‘ভারতের বিপক্ষে আমাদের সেরাটা উপহার দিতে হবে।’ সাকিব একা সেই সেরা পারফরমেন্স করলে চলবে না। সবার সেরাটা প্রয়োজন। তবেই কেবল ভারতবধ সম্ভব।

মনে নেই ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে একটা কমপ্লিট টিম ওয়ার্ক হয়েছিল? বল হাতে মাশরাফির বিশ্বকাপ সেরা ফিগার; ৩৮ রানে ৪ উইকেট। কোন উইকেট না পেলেও বাঁহাতি পেসার সৈয়দ রাসেলের অসাধারণ মাপা বোলিং (১০ ওভারে /৩১), আর সাথে বাঁহাতি স্পিনার আব্দুর রাজ্জাক (১০-২-৩৮-৩) ও রফিকের (১০-২-৩৫-৩)। উইকেট না পেলেও তখনকার উঠতি বাহাতি স্পিনার আজকের ‘হিরো’ সাকিবও (১০ ওভারে ০/৪৪) ভারতের তারকা উইলোবাজদের রান গতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন।

ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে ভারতের তখনকার বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপকে মাত্র ১৯৫ রানে বেঁধে ফেলে জয়ের ভিত রচে দিয়েছিলেন আসলে বোলাররা। পরে সেই ছোট লক্ষ্যের পিছু ধেয়ে ভারতীয় বোলারদের তুলোধুনো করলেন সে সময়ের তিন টগবগে যুবা তামিম (৫৩ বলে ৫১), মুশফিক (১০৭ বলে ৫৬) আর সাকিব (৮৬ বলে ৫৩)। তাদের প্রত্যেকের ব্যাট থেকে আসা অর্ধশতকে ৫ উইকেট হাতে রেখে ৯ বল আগে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছিল দলকে।

এক ম্যাচে প্রধান স্টাইক বোলার মাশরাফির ৪ উইকেট, দুই বাঁহাতি রাজ্জাক-রফিকের ৩ উইকেট করে পাওয়া আর শেষ ও আসল অংশে তিন যুবা তামিম, মুশফিক ও সাকিবের হাফসেঞ্চুরি- শতভাগ টিম পারফরমেন্স। যার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল সে সময়ের বিশ্বের এক নম্বর দল ভারত।

কাজেই ইতিহাস ও পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে কমপ্লিট টিমওয়ার্ক আর টিম পারফরমেন্স হলে ঠিকই ভারতকে হারানো সম্ভব- সেটাই দরকার। কিন্তু তা কী হবে? সাকিবের সাথে অন্যরাও কি জ্বলে উঠতে পারবেন? তা হলেই কেবল টাইগারদের জয়রথে পিষ্ট হবে কোহলির দল।

এআরবি/এসএএস/পিআর