খেলাধুলা

বার্মিংহ্যামে এবার সেই ভারতের বিপক্ষে নতুন ইতিহাস গড়বে বাংলাদেশ?

সত্যি কি অদ্ভুত ব্যাপার! আবার সেই বার্মিংহ্যাম, সেই এজবাস্টন আর সেই ভারত। এ যেন ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির চিত্রনাট্য! সেবারও এই বার্মিংহামের এজবাস্টনে ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। দুই বছর পর এবার বিশ্বকাপে আবার একই শহরের একই মাঠে বাংলাদেশ-ভারতের লড়াই।

Advertisement

পার্থক্য একটাই। দুই বছর আগে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ আর ভারত মুখোমুখি হয়েছিল সেমিফাইনালে। এবার ভারতের সাথে আগামী ২ জুলাই টাইগারদের দেখা হচ্ছে রাউন্ড রবিন লিগেই।

তবে কাগজ-কলমের হিসাবে রাউন্ড রবিন লিগ হলেও ২ জুলাই ভারতীয়দের বিপক্ষে আসলে মাশরাফি বাহিনীর মহারণ। কারণ, এখনকার হিসাব-নিকেশটা ভিন্ন। রবিন লিগ ম্যাচ হলেও ভারত আর পাকিস্তানের (৫ জুলাই লর্ডসে) সাথে ম্যাচ দুটি এখন বাংলাদেশের কাছে নকআউট পর্বের মতোই।

এর একটিতে হারলেও ছিটকে পড়তে হবে। শেষ হয়ে যাবে শেষ চারে থাকার স্বপ্ন। যেহেতু ভারতের সাথে ম্যাচ আগে, তাই বিরাট কোহলির দলের সাথে খেলাটির গুরুত্ব আপাতত বেশিই।

Advertisement

পুরো বাংলাদেশের চোখ এখন বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনের দিকে। যেখানে ঠিক পাঁচদিন পর ভারতের বিপক্ষে মাঠে নামবে টাইগাররা। জিততে পারলে সেমির পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবে টাইগাররা। তখন পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ জয় আর ইংল্যান্ডের বাকি দুই ম্যাচের ফলের ওপর নির্ভর করবে টাইগারদের ভাগ্য।

খুব প্রাসঙ্গিক কারণেই ২ জুলাই ভারতের বিপক্ষে খেলার আগে চলে আসছে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচ। তবে মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকরা সে ম্যাচের কথা ভুলে থাকতে চাইবেন। কারণ, ২০১৭ সালের ১৫ জুন এজবাস্টনে ভারতের সাথে সেমির লড়াইয়ে বাংলাদেশ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। হেরেছিল ৯ উইকেটে।

তামিম (৮২ বলে ৭০) আর মুশফিকের ৮৫ বলে ৬১, জোড়া হাফসেঞ্চুরি আর নিচের দিকে অধিনায়ক মাশরাফির (২৫ বলে ৩০ নট আউট) চেষ্টায় ২৬৪ রানের মাঝারি স্কোর দাঁড় করিয়েছিল মাশরাফির দল। তবে সেটা পর্যাপ্ত ছিল না একদমই। রোহিত শর্মার অনবদ্য সেঞ্চুরি (১২৯ বলে অপরাজিত ১২৩) আর অধিনায়ক বিরাট কোহলির ঝড়ো ৭৮ বলে ৯৬ রানের উইলোবাজিতে ৯ উইকেট হাতে রেখে অনায়াসে ৫৯ বল আগেই জয় তুলে নেয় ভারত।

বাঁ-হাতি ওপেনার তামিম আর নির্ভরতার প্রতীক মুশফিক ছাড়া বাংলাদেশের আর একজন ব্যাটসম্যানও ওই ম্যাচে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। বাঁ-হাতি ওপেনার সৌম্য ফিরে গিয়েছিলেন কোনো রান না করেই।

Advertisement

এখন যার ব্যাটের দাপটে প্রতিপক্ষ বোলারদের নাভিশ্বাঃস উঠছে, সেই সাকিব আল হাসানের ব্যাটও সেদিন কথা বলেনি। সাকিব আউট হয়ে গিয়েছিলেন ১৫ রানে (২১ বলে)। রিয়াদ (২৫ বলে ২১), সাব্বির (২১ বলে চার বাউন্ডারিতে ১৯) এবং মোসাদ্দেকও (২৬ বলে ১৫) ব্যর্থতার মিছিলে অংশ নিয়েছেন।

তামিম-মুশফিকের ১২৩ রানের পার্টনারশিপ ছাড়া ওই ম্যাচে আসলে কিছুই ছিল না বাংলাদেশের পক্ষে। শেষ দিকে অধিনায়ক মাশরাফি আট নম্বরে নেমে ২৫ বলে ৩০ রানের হার না মানা ইনিংস খেললে হয়তো রান ২৪০’র ঘরও পার হতো না। মাশরাফির তেজদ্বীপ্ত ব্যাটিংয়েই রান ২৬০-এর ঘরে পৌঁছায়।

তবে সেটা মোটেই যথেষ্ট ছিল না। ভারতের ব্যাটিংয়ের সময় পরিষ্কার বোঝা গেছে শতভাগ ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটে রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলির মতো বিশ্বমানের ব্যাটসম্যান সাজানো ভারতীয় ব্যাটিং লাইনআপকে ওই ২৬০-২৬৫ রানের টার্গেট দিয়ে পার পাওয়া যাবে না।

যদিও এবার বিশ্বকাপে এই মাঠে হওয়া নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচে রান ওঠেনি তেমন। প্রোটিয়াদের ২৪১ রানে থামিয়ে কিউইরা ৪ উইকেটের জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে, তবে হেসেখেলে নয়, তিন বল আগে মাত্র। এজবাস্টনে আজ আরও একটি বড় ম্যাচ। পাকিস্তান আর নিউজিল্যন্ডের। আজকে বোঝা যাবে এই মাঠের উইকেটের সত্যিকার অবস্থা।

তবে উইকেট যেমনই থাকুক, ভারতের যে ব্যাটিং লাইনআপ, তাতে ৩০০, ৩২০ কিংবা ৩৩০ এর নিচে টার্গেট দিয়ে জেতা কঠিন। ব্যাটিংটা অনেক বেশি সাজানো-গোছানো। রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলির মতো দু’দুজন সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান ভারতীয় ব্যাটিংয়ের বড় সম্পদ ও শক্তি।

এরপর রয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনির মতো ‘গ্রেট ফিনিশার।’ তাই আগের মতো ২৬৪-২৬৫ দিয়ে হবে না- ধরেই খেলতে নামতে হবে। আশার কথা মুশফিক ফর্মে। এরই মধ্যে ছয় ম্যাচের তিনটিতে পঞ্চাশের ঘরে পা রেখেছেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরিও করেছেন। তামিম বড় রান করতে না পারলেও ফর্মে ফিরেছেন।

সবচেয়ে আশার কথা হলো, সাকিব আল হাসান আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। একমাত্র ইংল্যান্ডের সাথে ম্যাচে স্লোয়ারে ৪১ রানে মিড অফে ক্যাচ দিয়ে ফেরা ছাড়া সব ম্যাচেই জ্বলে উঠেছে সাকিবের ব্যাট। হয় ফিফটি, না হয় সেঞ্চুরি করে মাঠে ছেড়েছেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার।

প্রতি ম্যাচে উইকেটে গিয়েই অনায়াসে প্রতিপক্ষের বোলিং মোকাবিলা করছেন একদম জাত ব্যাটসম্যানের মতো। কি ফাস্ট, মিডিয়াম পেস কিংবা স্পিন- সব বোলিংয়ের বিপক্ষেই সমান সাবলীল এখন সাকিব। কাজেই ভারতের সাথে আগামী ২ জুলাইয়ের ম্যাচেও সাকিব অনেক বড় নির্ভরতা ও আশার আলো বাংলাদেশের জন্য।

সাকিবের ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠা, বড় ইনিংস খেলার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ। হতো ভাবছেন বাংলাদেশের নির্বিষ পেস বোলিং ছাপিয়ে শুধু সাকিবের ব্যাটিংয়ের কথা বলা কেন? বলা এই কারণে যে, এ মুহূর্তে বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি রানের তালিকায় তিনে থাকা সাকিব সত্যিই আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। যার সামনে রাবাদা, লুঙ্গি এনগিদি, বোল্ট, ম্যাট হেনরি, লকি ফার্গুসন, ওশানে থমাস, জোফরে আর্চার, মার্ক উড, বেন স্টোকস, মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স এবং রশিদ খানের মতো বোলারও মাথানত করেছেন। তাদের সবার বিপক্ষে সাকিব যেন মহাবীর আলেকজান্ডার। তার ব্যাট যেন খাপ খোলা তরবারি।

এক সাকিবই এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের চালিকাশক্তি। মূল অস্ত্র। প্রতিটি প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সাকিব ব্যাট ও বল হাতে জ্বলে ওঠে শুধু সাফল্যের নতুন কীর্তিই গড়ছেন না, দলকেও এগিয়ে দিচ্ছেন। তার হাত ধরেই প্রথমবার বিশ্বকাপের সেমিতে খেলার স্বপ্ন এখন বাস্তবের খুব কাছাকাছি।

কাজেই ভারতের বিপক্ষে আগের ব্যবধান কমিয়ে বাংলাদেশকে অনেক এগিয়ে দিয়েছেন সাকিব। ভুবেনেশ্বর কুমার, জসপ্রিত বুমরা, হারদিক পান্ডিয়া, ইয়ুজবেন্দ্র চাহাল, কেদার ও কুলদিপ জাদবের সাঁড়াশি বোলিংয়ের বিপক্ষে সাকিবই বাংলাদেশের সব আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু।

দুই বছর আগে তামিম-মুশফিকের চেষ্টার সাথে এবারের সাকিবের ব্যাট চালনার রূপ ও গতির বিস্তর ফারাক। এখন সাকিবের ব্যাট প্রতিপক্ষ বোলিংকে শাসন করছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে যে লক্ষ্য-পরিকল্পনায় নামছেন বিপক্ষ বোলাররা, সাকিবের ব্যাটের উত্তাল তোড়ের মুখে তা খেই হারিয়ে ফেলছে। ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যে বাঁ-হাতি পেসার ভুবনেশ্বর কুমার (২/৫৩), ডান হাতি পেসার জসপ্রিত বুমরাহ (২/৩৯) আর অফ স্পিনার কেদার যাদব (২/২২) বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, এবার তাদের সামলানোই শুধু নয়, শাসন করার সামর্থ্যও রাখেন সাকিব।

এরপরও খেলাটা ক্রিকেট, বিগ ম্যাচে কারো একার ওপর বেশি নির্ভর করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ভারতের সাথে সাকিবনির্ভরতা কমিয়ে পাশাপাশি ব্যাটিংয়ে তামিম, সৌম্য, মুশফিক, লিটন, মাহমুদউল্লাহ (কাফ মাসলের ইনজুরি কাটিয়ে খেলতে পারলে) আর মোসাদ্দেক এবং তিন পেসার অধিনায়ক মাশরাফি, মোস্তাফিজ-সাইফউদ্দীন আর অফস্পিনার মিরাজের সেরাটা উপহার দিতে হবে।

আশার কথা আফগানিস্তানের সাথে ম্যাচ শেষেই সাকিব খুব বড় গলায় একবুক আশা নিয়ে বলেছেন, ‘ভারতের সাথে সেরা ক্রিকেটটাই খেলতে হবে। আমরা নিজেদের সেরাটাই উপহার দিতে চাই।’ বাকিরা সাকিবকে ঠিকমতো সাপোর্ট দিতে পারলে হয়তো এবার সেই বার্মিংহামের এজবাস্টনে টিম বাংলাদেশের সেরা পারফরম্যান্সটাই দেখা যাবে। যদি তার দেখা মেলে তাহলে এবার দেখা মিলবে অন্য এক বাংলাদেশের। রচিত হবে নতুন ইতিহাস।

কে জানে সাকিবের হাত ধরেই হয়তো পতপত করে উড়তে থাকবে লাল সবুজ পতাকা।

এআরবি/আইএইচএস/এমএস