ভ্রমণ

সিঙ্গাপুরে গ্রানাইট পাথরের দ্বীপে যা দেখবেন

 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিশ্র ভাষা ও সংস্কৃতির দেশ সিঙ্গাপুর। সাগরের বুকে হিরাকৃতির পাথর ও পাহাড়ের একটি ছোট দ্বীপরাষ্ট্র। আয়তনে বাংলাদেশের একটি জেলার সমান। দ্বীপরাষ্ট্রটি ছোট-বড় ৬৩টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। সম্প্রতি লেখক গিয়েছিলেন তার পছন্দের একটি দ্বীপে। সেখান থেকে লিখেছেন মনির আহমদ-

Advertisement

দ্বীপের নাম পোলাও উবিন। দ্বীপটি সিঙ্গাপুরের মূল ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। চাঙ্গি ভিলেজ নামক স্থান থেকে স্পিডবোটে যাতায়াত করতে হয়। দ্বীপটির দৈর্ঘ প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার। চাঙ্গি ভিলেজ থেকে ১০-১৫ মিনিটের নৌকাভ্রমণে পৌঁছানো যায় এ দ্বীপে। দ্বীপটিতে যাওয়ার আগে দ্বীপের ইতিহাসে জেনে নেই। ‘পোলাও উবিন’ মালয় ভাষা। ‘পোলাও’ অর্থ ‘দ্বীপ’, আর ‘উবিন’ অর্থ ‘গ্রানাইট পাথর’ অর্থাৎ ‘গ্রানাইট পাথরের দ্বীপ’। ধারণা করা হয়, এ দ্বীপের দৃশ্যমান লালচে রঙের গ্রানাইট পাথরগুলো প্রায় ৫ হাজার বছরেরও পুরনো। স্বাধীনতার আগে ও পরে এখানকার মূল্যবান অনেক গ্রানাইট পাথর সরিয়ে নিয়ে বিভিন্ন স্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে।

রূপকথা আছে, বহু বছর আগে সিঙ্গাপুরের মূল ভূখণ্ড থেকে একটি ব্যাঙ, একটি শুকর ও একটি হাতি জোহর বাহরু যাওয়ার জন্য সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল। প্রতিযোগিতায় যে হেরে যাবে, সে পাথরের রূপ নেবে। শেষপর্যন্ত শুকর ও হাতি পাথর হয়ে যায় এ দ্বীপে এসে। আর ব্যাঙ চলে যায় পোলাও সেকুদু দ্বীপে। যার অন্য নাম ব্যাঙ দ্বীপ।

পোলাও উবিনের সাম্প্রতিক ইতিহাস হচ্ছে, এখানে একসময় প্রায় দুই হাজারের বেশি পরিবার বসবাস করতো। ১৯৫০ সালের পরে এখানকার মানুষের শিক্ষা বিস্তারে দুটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৪০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুর সরকার ১৯৮০ সালের দিকে স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয় এবং ২০০৫ সালে ঘোষণা দেন, দ্বীপ থেকে যারা স্থায়ীভাবে চলে আসবে, তাদের সরকারি বাসা দেওয়া হবে। বর্তমানে এ দ্বীপে স্থায়ীভাবে বসবাস করে ৩৮টি পরিবার।

Advertisement

সিঙ্গাপুরের উল্লেখযোগ্য অঞ্চল ক্যামপং বাহরু, বিশান, সেরাঙ্গুন, ট্যাম্পিনেস, লেভেন্ডার, কালাং, গ্যালাং, টানামেরা, কাকিবুকিত হয়ে ২, ২৯, ৫৯, ১০৯ নম্বর বাসগুলো নিয়মিত চাঙ্গি ভিজেল এসে তাদের গন্তব্য শেষ করে। দিনব্যাপী ভ্রমণের জন্য সকাল সকাল এখানে এসে হাজির হতে হবে। বাস থেকে নেমেই খেয়ে নিতে পারেন সকালের খাবার কিংবা ক্যান্টিনের বারান্দায় বসে চা, কফি পান করতে করতে সকালটা উপভোগ করতে পারেন প্রাণখুলে। নামে চাঙ্গি ভিলেজ হলেও জায়গাটা মোটেও গ্রাম নয়। তবে এখানকার প্রকৃতি, পথ ও স্থাপনায় কিছুটা বৈচিত্র রয়েছে। পোলাও উবিন তুলনামূলক অনেক বড় দ্বীপ। একদিনের সফরে ভ্রমণ করা প্রায় অসম্ভব। তাই পছন্দসই গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে প্রাধান্য দিয়ে অনেকেই ভ্রমণের গতিপথ ঠিক করে নেন। নৌকায় চড়ার আগে সাথে নিয়ে নেন প্রয়োজনীয় সামগ্রী। যেমন পানীয়, দুপুরের খাবার, ছাতা কিংবা রেইন কোট। পোলাও উবিনে আমার দ্বিতীয় ভ্রমণটি ছিল বৃষ্টিমুখর, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছিল সারাদিন। তাই সাথে নিয়েছিলাম ছাতা ও রেইন কোট।

তৃতীয় ভ্রমণটি হলো ৫ জুন ২০১৯, পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। সকালে ঈদের নামাজ শেষে কাকিবুকিত থেকে ৫৯ নম্বর বাস ধরে সোজা চলে এলাম চাঙ্গি ভিলেজ। সবার আগে চলে আসায় বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা, পাশাপাশি চলল পোলাও উবিন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ। চাঙ্গি খেয়াঘাটের কাছ দিয়েই একটি খাল চলে গেছে শহরের দিকে। দূরে শহরের উঁচ উঁচু বিল্ডিং দেখে মনে হয় তৃষ্ণার্ত শহর যেন এই জলের অপেক্ষায় বসে আছে। খেয়াঘাটের সামনেই পায়ে হাঁটার সরু একটি সেতু নান্দনিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওপারে গেলেই সাগর, এ জায়গাটিও সময় কাটানোর জন্য চমৎকার। এঁকেবেঁকে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে পায়ের পথ। কেউ কেউ সখে ও সুখে সাইকেলে প্যাডেল চাপছে। তবে সূর্য ডোবা মুহূর্তে জায়গাটি খোশগল্পের জন্য চমৎকার হবে বোঝাই যায়।

বন্ধুরা এসে পৌঁছলো সকাল সাড়ে ১১টার দিকে। এরপরে শুরু হলো খেয়াঘাটে টিকিটের জন্য অপেক্ষা। জানিয়ে দিলাম আমরা ৯ জন আছি। ঘাট কর্তৃপক্ষ সে অনুযায়ী আমাদের সিরিয়াল দিল। মূলত একটি স্পিডবোটে ১২ জন করে নেওয়া হয়, সে অনুযায়ী আমাদের সাথে বাড়তি ৩ জন যুক্ত করে স্পিডবোট ছাড়লো। জাকির, মোহর, বেলাল, সুমন ভাই ও আমিসহ ৪ জন বিদেশি বন্ধু ছিল আমাদের ভ্রমণে। যাওয়ার জন্য ৩ সিঙ্গাপুরী ডলার ভাড়া জনপ্রতি পরিশোধ করতে হলো। সাঁতার না জানা লোকদের জন্য ভ্রমণটি ঝুঁকিপূর্ণ না হলেও অনেকটা ভীতিকর হতে পারে। কারণ স্পিডবোট তুলনামূলক খুব ছোট ও হালকা। চলার পথে প্রচুর ঢেউয়ের সৃষ্টি করে, ফলে পার্শ্ববর্তী স্পিডবোটের ঢেউয়ে দারুণ দুলে ওঠে। সাঁতারের অভিজ্ঞতা থাকায় এ দোল আমাদের মাঝে অন্যরকম উন্মাদনার সৃষ্টি করলো। স্পিডবোটের যান্ত্রিক শব্দ, সিঙ্গাপুর সাগরকে দু’ভাগ করে ছুটে চলা, পাশাপাশি বিভিন্ন পাখির ওড়াউড়ি এক অপরূপ চিত্রকল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়।

১৫ মিনিট পরেই পৌঁছলাম পোলাও উবিন জেটি খেয়াঘাটে। জেটি অর্থ হাটবাজার, পোলাও উবিনের হাট যেন বাংলাদেশের অজপাড়া গ্রামের নদীকেন্দ্রীক হাটবাজারের সাথে একাকার হয়ে গেছে। এখানে রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্য ধারণ করে বেঁচে থাকার সব আয়োজন। খাবারের হোটেল, মুদি দোকান, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, চায়ের দোকান, পুলিশ ফাঁড়ি, চাইনিজ মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। বলা যায়, এখানে বসবাস করা ৩৮টি পরিবারের প্রধান কেন্দ্র এ জেটি। মূলত এখানকার বেশিরভাগ ব্যবসা ও নৌকার মাঝি এ ৩৮ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আমরা পোলাও উবিন পৌঁছতেই চাইনিজদের একটি দল মন্দির থেকে বেরিয়ে খেয়াঘাটের দিকে বাদ্য বাজাতে বাজাতে ছুটে গেল।

Advertisement

> আরও পড়ুন- ঝরনা ও পার্ক এবার বিমানবন্দরের ভেতরে

দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্নরকম ফল তারা সংগ্রহ করে এখানে বিক্রি করেন। তবে সিঙ্গাপুরের জাতীয় ফল ডোরিয়ান। ‘ওয়েলকাম টু পোলাও উবিন’ লেখা গেটটি অতিক্রম করলেই হাতের বামপাশে চোখে পড়লো পোস্ট বক্স। মূলত এখান থেকে চাইলে চিঠি পাঠানো যাবে যে কোন দেশে। সামনে রয়েছে পোলাও উবিনের সম্পূর্ণ মানচিত্র। কোথায় গেলে কী কী পাওয়া যাবে, সব এখান থেকে নিশ্চিত হয়ে সবাই ভ্রমণ যাত্রা শুরু করে। আমরাও তা-ই করলাম।

মানচিত্রের পেছনে রয়েছে ফ্রেশ হওয়ার ব্যবস্থা। সাথেই রয়েছে রেস্ট রুম, যেখানে অত্যাধুনিকভাবে সাজানো আছে পাখি পরিচিতি। এখানে উল্লখযোগ্য পাখি মাছরাঙা ও বুলবুলির পাশাপাশি অন্যান্য পাখির ভিডিওচিত্র ও সুর শোনা যায়। সাথে দেখে নিলাম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও। বামপাশেই রয়েছে বিভিন্ন দোকান। প্রথমে মালয় ক্যাফের পরেই চোখে পড়ল ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। এখানকার ট্যাক্সিগুলো পোলাও উবিনের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করে। কাঠের খামের উপরে টিনের একচালা নিচে মাটি ও পাথরের উপরে দু’টি বেঞ্চ নিয়েই মূলত ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের অফিস। অফিসের সামনে রংতুলিতে আঁকাবাঁকা করে লেখা আছে ট্যাক্সি সার্ভিস। সুতরাং কারো ভুল করার সুযোগ নেই। পাশেই রয়েছে সাইকেল ভাড়া দেওয়ার দোকান। দিনব্যাপী চুক্তিতে নিয়ে নিতে পারেন। এরপরে ছুটতে পারেন যেদিকে চোখ যায়। অনেকেই এখানে সাইকেল চালাতে আসেন। কেউ কেউ নিজস্ব সাইকেলও নিয়ে আসেন। এজন্য সাইকেল প্রতি অতিরিক্ত ২ সিং ডলার পে করতে হয়।

২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল আমার প্রথম সফরে চেক জাওয়া পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম। সেখানে যেতে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ পায়ে হাঁটতে হয়। তৃতীয় ভ্রমণটি হলো মিনিবাসে আমরা ৯ জন চেপে বসলাম। ১২ সিটের মিনিবাস হওয়ায় প্রতি সিটের ভাড়া আসা-যাওয়া ৪ সিং ডলার করে ৪৮ ডলার পরিশোধ করতে হলো। আমরা ছুটলাম চেক জাওয়ার উদ্দেশ্যে। ৮ ফিট সরু পিচঢালা পথ ধরে যেতে যেতে মনে হলো, কোন অজপাড়া গ্রাম পার হয়ে যাচ্ছি প্রিয় কোন মানুষের কাছে। চোখে পড়লো স্থানীয়দের বাড়ি। বাড়িগুলো টিন, কাঠ ও প্লাস্টিকের তৈরি। যেন সংস্কার হয়নি কয়েক যুগ ধরে। এক বাড়িওয়ালা তো সাজিয়েছেন চমৎকার কফি হাউস। সেখানে পাওয়া যায় কোমলপানীয়, বিভিন্ন ড্রিংকস, বিভিন্ন ফল এবং চা-কফি। রাস্তার পাশের জায়গাটায় এলোমেলোভাবে রয়েছে অসংখ্য চেয়ার ও টেবিল। চাইলে ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিলেও অসুবিধা নেই।

রাস্তার দু’ধারের বনাঞ্চলের ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পেলাম নারিকেল, ছোট ছোট ডোরিয়ান, নাম না জানা অসংখ্য ফল মাটিতে বিছিয়ে আছে। দু’একটা রামবুটানের গাছও লক্ষ্য করা যায়, এখনো তা পরিপক্ক হয়নি। হয়তো কিছুদিন পরেই খাওয়ার উপযুক্ত হবে। কিছুদূর যেতেই সুন্দর ও মসৃণ পিচঢালা পথ হারিয়ে গেল। উসকোখুসকো পথ উঁচু থেকে নিচুতে ঢলে পড়ছে, আবার উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। গ্রামীণ জীবনের ব্যতিক্রম হিসেবে এখানে দেখা গেল কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রামাগার, বিভিন্ন রকমের গাছ ও তার বর্ণনা সম্বলিত ফলক।

চেক জাওয়া পৌঁছে বাকি ভ্রমণ অবশ্য পায়েই হেঁটেই করতে হয়। সাইকেল, ট্যাক্সি সব এখানে থামে। এখানে দেখা মিলল বানর, শুকর, বনমোরগ ও নেড়িকুকুর। কুকুর, শুকর কাছে আসলেও এরা ক্ষতিকর নয়। তবে বানর দেখলাম খুব কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে। সুযোগ পেলেই এর-ওর হাতের ব্যাগ টেনে নিতে চাইছে।

চেক জাওয়া হচ্ছে এক ব্যক্তির নাম। বহুবছর আগে থেকে এ স্থানকে চেক জাওয়া বলা হয়। এখানে রয়েছে তার চমৎকার ইটের নির্মিত অট্টালিকা। যা তিনি প্রত্নতাত্ত্বিকের হাতে তুলে দিয়ে সিঙ্গাপুরের মূল ভূখণ্ডে চলে গেছেন। এখন বাড়িটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অট্টালিকার পেছনেই সমুদ্র, যেখানে নির্মিত হয়েছে চমৎকার হাঁটার সেতু। সেতু হেঁটে গেলাম শেষপ্রান্তে, মনে হলো সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। চারদিক থেকে এলোমেলো বাতাস আমাকে দুলিয়ে যাচ্ছে।

চেক জাওয়ার মূল পয়েন্ট থেকে ১৮০ মিটার দূরত্বেই রয়েছে বোর্ডওয়াক। হেঁটে যেতেই চোখে পড়ল বেশকিছু মুসলিমের কবর। এর পাশেই বিশালাকৃতির গ্রানাইট যেন বসে আছে আমার অপেক্ষায় যুগ যুগ ধরে। মেটে রঙের এ পাথর আমাকে প্রাচীন কোন সভ্যতার কথাই মনে করিয়ে দিল।

কিছুদূর যেতেই মনে হলো, এ পথ আর যায়নি কোথাও। পাহাড়ের উপর দিয়ে চাষের জমির আইলের মতো সুক্ষ্ম একটি পথ আমাকেও অন্য বন্ধুদের মতো ভাবিয়ে তুলল। যেহেতু দিকনির্দেশনা করা এ পথেই বোর্ডওয়াক ওয়ে। সুতরাং আমরা হাঁটলাম পথ ধরেই।

> আরও পড়ুন- ভারত ভ্রমণে শীর্ষে বাংলাদেশ

বোর্ডওয়াকের কাছে এসে দেখলাম, এটি মূলত ভূমি পেরিয়ে পাথরের পাহাড়ের পাশ দিয়ে সমুদ্রের বুক হয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা সেতু। আমার কাছে পোলাও উবিনের সবচেয়ে দর্শনীয় জায়গা মনে হয়েছে এটি। হেঁটে যেতে যেতে মনে হলো সাগরের ওপারে সিঙ্গাপুরের টেকং দ্বীপের উঁচু পাহাড় আমায় ডাকছে। অবশ্য পোলাও উবিন দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটি মূল ভূখণ্ড থেকে ৭৫ মিটার উঁচুতে। যা মোটেও কম নয়, তবে সেখানে ওঠার মতো ব্যবস্থা এখনো হয়নি।

যা হোক, বোর্ডওয়াক হয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখলাম এবং শুনলাম বিশালাকৃতির লাল পাথরের বুকে ঢেউ কিভাবে আছড়ে পড়ছে, আবার চুপচাপ নেমে যাচ্ছে। আর একটু হেঁটেই অবাক হলাম, এখানের ম্যানগ্রোভ ও গোলপাতার গাছগুলো যেন ঘোরের ভেতর দিয়ে সুন্দরবনে নিয়ে যাচ্ছে। বোর্ডওয়াক কখন যে স্যাঁতসেঁতে মাটি স্পর্শ করে কাঠের পুলে রূপ নিয়ে বন-বাদার হয়ে ছুটে যাচ্ছে, এই ঘোর থেকে বেরিয়ে তা বুঝতে কিছুটা সময় লেগে গেল।

আনারস ভেবে কাঠের পুল থেকে নেমে হঠাৎ বনে প্রবেশ করলাম। কিন্তু এ যে আনারস নয়, অন্য জাতের ফল। যা সম্পর্কে জানিও না, আর নিয়ে আসাও অসম্ভব। ততক্ষণে সাথের বন্ধুরা চলে গেছে অনেক পথ। চারদিকে একদম নির্জন ও নিস্তব্ধ পড়ন্ত বিকেল। তখন গাছেরা আলোবন্দি করে অনেকটা আঁধার করে ফেলেছে। ভয়ে কিছুটা উদগ্রীব হলোও বটে। কাঠের পুলে উঠেই এক বন্ধুকে পেয়ে গেলাম। যেতে যেতে চোখে পড়ল নানা প্রজাতির কাঁকড়ার আবাসভূমি। অনেকটা স্বচ্ছল পরিবারের মতো সবার আলাদা আলাদা বাসা। গুইসাপ, কাঠবিড়ালির দেখাও পেলাম পথে পথে।

পথটি আবার ঘুরেফিরে চেক জাওয়ায় গিয়ে উঠেছে। পথিমধ্যে পেয়ে গেলাম ভিউ টাওয়ার। লোকজন এ টাওয়ারকে জিজাই টাওয়ার বলে থাকেন। এটি ২০ মিটার উঁচু, এখানে উঠে উপভোগ করলাম পাখিদের জীববৈচিত্র। গোলপাতা, ম্যানগ্রোভ, জানা অজানা অসংখ্য গাছ কীভাবে হা হয়ে আছে আকাশের দিকে। মাছারাঙা, বুলবুলি, বাজপাখি, সাথে বেশকিছু পরবাসী পাখিও এখানে এসে শীতের মৌসুমে আশ্রয় নেয়।

এখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো, পাশের দ্বীপগুলোর পাহাড়ে উড়ে যাই পাখি হয়ে। সাগরের বুকে ছোট ছোট নৌকা দেখে মনে হলো হাঁস হয়ে ভেসে থাকি। আমার বন্ধুরা ইতোমধ্যে মনোমুগ্ধকর এ সময়কে উপভোগ্য করতে কবিতা পাঠের আয়োজন করেছেন। আমি পড়লাম জীবনানন্দের ‘আমি যদি হতাম বনহংস’ কবিতা।

দেখতে দেখতে বিকেল প্রায় সাড়ে ৫টা বেজে গেছে। মূলত ৫টা থেকেই দ্বীপটি সবাই ছেড়ে যেতে শুরু করে। চেক জাওয়ায় অট্টালিকার পাশের ফ্রেশরুম থেকে মোটামুটি সবাই নিজেকে পরিপাটি করে নিলাম। এবার ফেরার পালা। আমরা তৃতীয় সফরটি মিনিবাসে করে এসেছিলাম। ড্রাইভার আমাদের তার মোবাইল নম্বর দিয়ে গেছেন। ফোন দিতেই কিছুক্ষণ পরে তিনি চলে এলেন।

আমার দ্বিতীয় সফরটি ছিল ২০১৮ সালে। বৃষ্টিমুখর সেই সফর ছিল সম্পূর্ণ রেইন কোট পরে। যা সম্পর্কে এখন বেশি কিছু মনে নেই। যাই হোক, শেষ সফরটি পোলাও উবিন খেয়াঘাট হয়ে আগের মতোই আমরা ৯ জন চলে এলাম চাঙ্গি ভিলেজে। এখানে কিছুক্ষণ চা খেতে খেতে বিশ্রাম নিলাম। এরপর সবাইকে বিদায় দিয়ে বাসে উঠলাম। ছুটলাম আমার গন্তব্যের ঠিকানায়।

সিঙ্গাপুরের বেশকিছু দ্বীপে ভ্রমণ করলেও এ দ্বীপে যতবার ভ্রমণ করি, যেন ততবারই নতুন কিছু খুঁজে পাই। আরও বহুবার ভ্রমণের ইচ্ছা আছে। কী যেন এক ঘোর লেগে থাকে, যেন খুঁজে পাই আমার শৈশবের লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড, বাজার। যেন প্রিয় চেনা কতকিছু পদ্মা নদীতে ডুব দিয়ে এখানে ঠাঁই নিয়েছে। আরও মনে হয়, কোন চরাঞ্চলের এক চমৎকার জীবনযাত্রা প্রতিনিয়ত দুলছে এখানে।

পোলাও উবিন, আবার দেখা হবে অন্য সময়।

এসইউ/এমএস