কিংবদন্তি গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি বুফন। ১২ বছর আগে তিনি নিজের নাম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বের বুকে। কিংবদন্তিতে পরিণত হননি। কিন্তু তার প্রতিপক্ষ, জিনেদিন জিদান। তিনি তখন রীতিমত জীবন্ত কিংবদন্তি। ফুটবলকে বিদায় বলে দেয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল তখন তার।
Advertisement
বুড়ো হাঁড়ের ভেলকি কিভাবে দেখাতে হয়, সেটা সম্ভবত জিদানের চেয়ে কেউ ভালো বলতে পারবে না। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ নিজের দেশকে (ফ্রান্স) উপহার দেয়ার পর ২০০২ বিশ্বকাপটা ফরাসিদের কেটেছে খুব হতাশার। জিদানও ভালোকরে খেলতে পারনেনি। ছিলেন ইনজুরিতে জর্জরিত।
আরও চার বছর পর জার্মানির মাটিতে গিয়ে জিদান নিজেকে খোলস ছেড়ে বের করে এনেছিলেন যেন। পুরো ক্যারিয়ারে সঞ্চিত সব অভিজ্ঞতা ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি মিউনিখ থেকে বার্লিন- পুরো জার্মানিজুড়ে। একার হাতে কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়েছিলেন তখনকার টপ ফেবারিট ব্রাজিলকে। একাই বলতে গেলে পুরো দলকে টেনে তুলেছিলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে। এমন একক পারফরম্যান্স সম্ভবত ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার পর আর কেউ দেখাতে পারেনি কোনো বিশ্বকাপে।
ম্যারাডোনার ২০ বছর পর, ২০০৬ সালে জিদান দেখালেন তার নিজের অবস্থান। তিনি কোন জগতের ফুটবলার ছিলেন, সেবার হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছিল বিশ্বের সব পরাশক্তি। ফাইনালেও ইতালি এই কিংবদন্তি ফুটবলারের কাছে ছিল যেন নস্যি। বিখ্যাত 'কাতানেচ্চিও' ডিফেন্সের জন্য পরিচিত ইতালি চেয়েছিল জিদানকে বোতলবন্দী করে রাখতে।
Advertisement
কিন্তু মার্সেলো লিপ্পির সেই পরিকল্পনা কাজে লাগেনি। তখনকার উদীয়মান (ততদিনে বিশ্বসেরা হয়ে উঠেছিলেন) জিয়ানলুইজি বুফন বুঝতে পেরেছিলেন, কতটা বিষ রয়েছে 'বুড়ো' জিদানের শট কিংবা হেডে। ফরাসি এই কিংবদন্তি অনেকবারই পরীক্ষা নিয়েছিলেন বুফনের। ইতালিয়ানরা বুঝতে পেরেছিলো, বুফন মাঠে থাকা মানেই যে কোনো পর্যায়ে তাদের পরাজয় অনিবার্য।
এ কারণেই বাঁকা পথে হাঁটলো তারা। মার্কো মাতেরাজ্জিকে দায়িত্ব দেয়া হলো জিদানের মাথা গরম করে দেয়ার। পরিকল্পনায় সফল তারা। জিদানকে ক্ষেপিয়ে দেয়া গেলো। তার মা এবং বোনকে নিয়ে গালাগালি দিলেন (যদিও এটা প্রমাণিত নয় এখনও) মাতেরাজ্জি। তাতেই রেগে ফুঁসে উঠলেন জিদান। আচমকা ঢুঁস মেরে বসলেন মাতেরাজ্জির পেটে।
আর যায় কোথায়! শারীরিকভাবে আক্রমণ, ফুটবল মাঠে এতো অনেক বড় অপরাধ। সে যে ফুটবলারই হোক না কেন! রেফারি সঙ্গে সঙ্গে পেছনের পকেট থেকে কার্ডটা বের করে ফেললেন। লাল কার্ড। জীবনের শেষ ফুটবল ম্যাচে মাথা নিচু করে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ফুটবলারটি।
সঙ্গে সঙ্গেই যেন ভেঙে পড়লো বাস্তিলদুর্গ। ইতালিয়ান কুটচালের সামনে পতন ঘটলো ফরাসি বিপ্লবের। যদিও সে পতন ছিল টাইব্রেকার নামক ভাগ্যের পরীক্ষায়। কিন্তু জিদানের ওভাবে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে মানসিকভাবে যেভাবে ডেভিড ত্রেজেগেরা ভেঙে পড়েছিলেন, তাতে সেখান থেকে তাদের ফিরে আসার উপায় ছিল না। সুতরাং, টাইব্রেকারে হেরে দ্বিতীয়বারেরমত বিশ্বকাপ জয় আর করা হলো না জিদানের ফ্রান্সকে।
Advertisement
সেই ঘটনার ১২ বছর পর যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখতে পেল ইতালি। জিয়ানলুইজি বুফন। একযুগ আগের ম্যাচটি ছিল বিশ্বকাপের ফাইনাল। এবার বিশ্বকাপ কিংবা কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ নয়। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের কোয়ার্টার ফাইনাল। তবে মঞ্চে সেই বিখ্যাত দুই চরিত্রের উপস্থিতিই দুই ঘটনার যোগসূত্র তৈরি করে দিয়েছে এবং মাহাত্ম্যটা তৈরি করেছে বেশ।
জিদান এবং বুফন- দু'জন একযুগ আগেও ছিলেন। এবারও আছেন। জিদান ডাগআউটে, বুফনের প্রতিপক্ষ রিয়াল মাদ্রিদরে কোচ। আর বুফন সেই আগের মতই তিন কাঠির (গোলপোস্ট) নিচে। জিদানের দল রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে বুফনের এটা ছিল ক্যারিয়ারের শেষ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ম্যাচ। অন্তত বুফন সে ঘোষণা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন।
নিয়তির কী পরিহাস! জিদানের মত হয়তো হেড বাটের ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু জিদানের মত লাল কার্ড দেখতে হলো বুফনকে। কোয়ার্টার ফাইনালের ফিরতি লেগে একেবারে শেষ মুহূর্তে ডি বক্সের মধ্যে রিয়ালের লুকাস ভাসকুয়েজকে ফাউল করার অপরাধে রেফারি মাইকেল অলিভিয়ের পেনাল্টির বাঁশি বাজিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তেড়ে আসেন বুফন। তিনি জুভেন্টাসের অধিনায়কও বটে। রেফারির হঠাৎ এবং একেবারে শেষ মুহূর্তে এই পেনাল্টি মেনে নিতে পারেননি তিনি। রেফারির দিকে আঙ্গুল তুলে কথা বলতে শুরু করেন।
রেফারির কাছে এটা অপরাধ গণ্য হলো। তিনিও হাত দিলেন প্যান্টের পেছনে। বের করে আনলেন লাল কার্ড। দেখিয়ে দিলেন বুফনকে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ক্যারিয়ারে নিজের শেষ ম্যাচটায় শেষ মুহূর্তে এভাবে লাল কার্ড দেখবেন- বুফন হয়তো কল্পনাই করতে পারেননি কখনও। শেষ পর্যন্ত পেনাল্টি থেকে গোল করলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। বিদায় নিলো বুফনের দল জুভেন্টাস।
একযুগ পর হলেও নিয়তির প্রতিশোধ ঘটে গেলো। ইতিহাসের হলো পুনরাবৃত্তি। যদিও জিদান নিজে থেকে বলছেন, 'বুফনকে লাল কার্ড দেখানোটা উচিৎ হয়নি। ওটা লাল কার্ড দেখানোর মত অপরাধ ছিল না।'
জিদানের মতই যে নিজের ক্যারিয়ারের এমন ইতি ঘটে যাবে, সেটা ভাবতেই অবাক হয়ে যাচ্ছেন বুফন। স্কাই স্পোর্টস ইতালিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বুফন সেটাই বললেন, 'সম্ভবত জিদানের হেড বাটের পর তার ক্যারিয়ার যেভাবে শেষ হয়ে গিয়েছিল, আমার ক্যারিয়ারও সেভাবে শেষ হলো।'
আইএইচএস/জেআইএম