ভালো খেলার রসদ আছে বেশ। ‘নিউজিল্যান্ডকে হারানো যায়, আমরা কিউইদের হারাতে পারি। এইতো ১৫ দিন আগে আয়ারল্যান্ডে তিন জাতি টুর্নামেন্টেও ব্ল্যাক ক্যাপ্সদের ৫ উইকেটে হারিয়েছি’ নিশ্চয়ই টিম বাংলাদেশের প্রতিটি সদস্য এই ভেবেই অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত। এছাড়া কার্ডিফের এই মাঠে এক যুগ আগে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর সুখ স্মৃতিও ভালো খেলার উদ্দীপক।
Advertisement
আজ (শুক্রবার) কয়েক ঘণ্টা পর যে মাঠে ব্ল্যাক ক্যাপ্সদের সঙ্গে অঘোষিত কোয়ার্টার ফাইনাল, সেই মাঠেই ২০০৫ সালে অসিদের হারানোর সুখ স্মৃতিও আছে টাইগারদের। সবচেয়ে বড় কথা আজকের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও ছিলেন ঐ অবিস্মরণীয় জয়ের অন্যতম রূপকার। সঙ্গে থাকা নির্বাচক হাবিবুল বাশার ছিলেন সে দলের অধিনায়ক। তারা নিশ্চয়ই টিম মিটিংয়ে দলকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করতে এক যুগের আগের মধুর স্মৃতি রোমান্থন করছেন।
এর বাইরে ভালো খেলার আরও রসদ আছে টাইগারদের। গত ৪৮ ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে পাকিস্তানের (ডিএল ম্যাথডে ১৭ রানের জয়) আর কাল (বৃহস্পতিবার) রাতে ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার অসাধারণ জয় দুটিও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ভালো খেলায় উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
চির প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে বিধ্বস্ত পাকিস্তান যদি ধ্বংস্তুপের মধ্য দাঁড়িয়ে সময়ের অন্যতম সেরা দল এবং কঠিন প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে পারে, প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে পাত্তা না পাওয়া শ্রীলঙ্কা যদি ভারতের জয়রথ থামিয়ে নিজেরা ঘুরে দাঁড়াতে পারে, তাহলে মাশরাফির দল কেন নিউজিল্যান্ডকে হারাতে পারবে না? বৃহস্পতিবার রাত থেকে এমন কথা সবার মুখে।
Advertisement
সেটা কোন আবেগমাখা সংলাপ নয়, মাশরাফি, তামিম, সৌম্য, সাব্বির, মুশফিক, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ আর মোস্তাফিজরা এই ভেবে নিজেদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন। যা হতে পারে ভালো খেলার খুব ভালো রসদ। ঐ ম্যাচ দুটিতে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার জয়কে খালি চোখে অঘটন ও চমক মনে হলেও দুটি দলই ভালো খেলে জিতেছে।
এর মধ্যে পাকিস্তানিরা দুর্দান্ত বোলিং করে প্রোটিয়াদের ২১৯ রানে বেঁধে জয়ের সম্ভাবনা জাগায়। আর শ্রীলঙ্কা বোলিংয়ে তেমন আহামরি কিছু দেখাতে না পারলেও অসাধারণ ব্যাটিং করে পেয়েছে এক অবিস্মরণীয় জয়ের দেখা। হাসান আলী ( ৮ ওভারে ২৪ রানে ৩ উইকেট) চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, পেস বোলিংয়ের বিরুদ্ধে সাবলীল ও স্বচ্ছন্দে খেলা ডু প্লেসি, ডুমিনি আর পার্নেলদের মাঝারি গতির পেসে বিষাক্ত সুইং দিয়ে ঘায়েল করা যায়। আর বাঁহাতি স্পিনার ইমাদ ওয়াসিমের মাপা স্পিন ঘূর্ণিতে হাশিম আমলা আর এবি ডি ভিলিয়ার্সের মত মাস্টার ব্যাটসম্যানও ধরা খেয়েছেন।
তার মানে মাশরাফি-মোস্তাফিজরা জায়গামত বল ফেলতে পারলে গাপটিল, রনকি, উইলিয়ামসন আর রস টেলরদের রানের লাগাম টেনে ধরতে পারেন। সাকিবের একটি জাদুকারি স্পেল ব্যাকফুটে ঠেলে দিতে পারে ব্ল্যাক ক্যাপ্সদের। আর টাইগার ব্যাটসম্যানদের সামনে বাতিঘর হয়ে আছে বৃহস্পতিবার রাতে লঙ্কানদের গাণিতিক ব্যাটিং। ম্যাচ জেতানোর ফর্মুলাটা খুব ভালো ভাবেই এ্যাপ্লাই করেছেন লঙ্কানরা।
বোলাররা সে অর্থে ম্যাচ নির্ধারণই ভূমিকা নিতে না পারলেও ব্যাটসম্যানরা দায়িত্ব নিয়ে খেলে এক ঐতিহাসিক জয় উপহার দিয়েছেন শ্রীলঙ্কাকে। ওপেনার ডিকভেলা ছাড়া প্রতিষ্ঠিত ব্যাটসম্যানদের প্রায় সবাই একদম গাণিতিক ব্যাটিং করেছেন। কুশল মেন্ডিস, দানুষ্কা গুণাতিলকে, কুশল পেরেরা আর অধিনায়ক অ্যাঞ্জোলো ম্যাথিউস যেন জানতেন কার কি দায়িত্ব ও কর্তব্য ? একদম সাজানো চিত্রনাট্যের সফল মঞ্চায়ন যাকে বলে। সবাই সেই মতই খেলেছেন। আর শেষ অবধি ক্লিনিক্যাল ফিনিশ করেছেন অধিনায়ক নিজেই। আর সে কারণেই ভারতের সমৃদ্ধ, শক্তিশালী আর বৈচিত্রে ভরা বোলিং শক্তির বিরুদ্ধে ৩২২ রানের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সে অর্থে তেমন বেগ পেতে হয়নি। দিনের আট বল আগেই জয়ের বন্দরে লঙ্কানরা।
Advertisement
এই ম্যাচেই প্রমাণ হয়েছে একজন দক্ষ ও যোগ্য ওয়ান ডাউন ব্যাটসম্যান কত প্রয়োজন? শুরু ভালো হয়নি একদমই। উদ্বোধনী জুটি ভেঙেছে মাত্র ১১ রানে। সোয়া তিনশো রানের পিছু ধেয়ে শুরুতেই বিপদে পড়া। সেই ভাঙাচোরা অবস্থা থেকে দ্বিতীয় উইকেটে হাল ধরলেন দুই তরুণ টপ অর্ডার কুশল মেন্ডিস আর দানুষ্কা গুণাতিলকে। ওয়ান ডাউন কুশল মেন্ডিস একটু রয়ে সয়ে ৯৫.৬৯ স্ট্রাইক রেটে ৯৩ বলে ৮৯ করলেন। আর দানুষ্কা গুণাতিলকে খেললেন আর একটু হাত খুলে। তার ৭৬ রানের ইনিংসটি আসলো ৭২ বলে ( ১০৫.৫৫ স্ট্রাইকরেটে)। দ্বিতীয় উইকেটে ১৫৯ রানের বিরাট জুটিতেই শ্রীলঙ্কা পেল জয়ের ভীত। লক্ষ্যের পথে অনেক দূর এগিয়েও গেল। তারপরও এক সময় ঐ দুই সেট ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফিরলেন। কাকতালীয়ভাবে দু`জন সেট ব্যাটসম্যানই হলেন রান আউটের শিকার।
এরকম অবস্থায় ছন্দপতন ঘটে অনেক সময়। কিন্তু লঙ্কানদের ওসব কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি। কি করে পারবে? কুশল মেন্ডিস আর দানুষ্কা গুণাতিলকে ফেরার পর আরও এক কার্যকর জুটি গড়লেন কুশল পেরেরা আর অ্যাঞ্জোলো ম্যাথিউস। যার আস্থা ও আত্ববিশ্বাসী ব্যাটিংয়ে ভারতীয়দের ম্যাচে ফেরার সব চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যভূষিত হচ্ছিল, সেই কুশল পেরেরা হঠাৎ ক্র্যাম্প করে সাজঘরে।
৪৩ ওভারে কুশল পেরেরা যখন ৪৪ বলে ৪৭ রান করে ইনজুরিতে সাজঘরের পথে, তখনো ৪২ বলে ৫১ রান দরকার ছিল শ্রীলঙ্কার। ঐ অবস্থায় হাল ধরলেন অ্যাঞ্জোলো ম্যাথিউস। সঙ্গী হলেন সাহসী আসেলা গুনারত্নে। মাত্র ২১ বলে দুটি করে বাউন্ডারি ও ছক্কায় ৩৪ রানের হার না মানা ইনিংস উপহার দিয়ে অধিনায়কের সঙ্গে দল জিতিয়েই সাজঘরে ফিরলেন গুনারত্নে। অধিনায়কের ব্যাট থেকে আসে ৪৫ বলে ৫২ রানের হার না মানা ইনিংস। পাঁচ, ছয় কিংবা সাত নম্বরে নামা ব্যাটসম্যানরা শেষ পর্যন্ত ক্রিজে থাকলে যে সোয়া তিনশো রানও তাড়া করে সহজে জেতা যায় তার সর্বশেষ উদাহরণ কালকের ম্যাচ।
এই জায়গায় ঘাটতি বাংলাদেশের। ওপরের দিকে তামিম একা খেলছেন। আর প্রথম দিন মুশফিকও চার নম্বরে নেমে ৭৯ রানের দারুণ ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সাজানো পথে হেটে সাকিব, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বিরের কেউ শেষ বল পর্যন্ত উইকেটে থাকতে পারেননি। সেই না থাকায় দুই ম্যাচের কোনটায় শেষ ভালো হয়নি।
কঠিন সত্য হল, ওপরের দিকে কেউ একজন লম্বা ইনিংস খেললে আর মাঝখানে একাধিক কার্যকর ইনিংস গড়ে উঠলেও লাভ হবে না, যদি না কেউ একজন ছয় বা সাত নম্বরে নেমে ম্যাচ শেষ না করে সাজঘরে ফেরেন। সেই কাজটাই হচ্ছে না। আজ কার্ডিফের সুফিয়া গার্ডেনে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সে কাজটিই করতে হবে।
অ্যাঞ্জোলো ম্যাথিউস বৃহস্পতিবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কিভাবে ম্যাচ শেষ করতে হয়। তামিম ফর্মের চুড়োয়। এখন পর্যন্ত দুই ম্যাচ শেষে টুর্নামেন্টের টপ স্কোরার। কিন্তু ওপরের দিকে আর মাঝখানে প্রথম ম্যাচে মুশফিক ছাড়া আর সে অর্থে কেউ জ্বলে উঠতে পারেননি। এভাবে ওয়ানম্যান শো দিয়ে বিগ ম্যাচ জেতা কঠিন। নিউজিল্যান্ডের মত দলকে হারানো সত্যিই কঠিন।
অবশ্য ডাবলিনের ক্লোনটার্ফ ক্রিকেট ক্লাব গ্রাউন্ডের ম্যাচটি আশার আলো। ঐ ম্যাচের চালচ্চিত্রর সঙ্গে বৃহস্পতিবার রাতে লঙ্কানদের ব্যাটিং পারফরমেন্সের মিল আছে যথেষ্টই। যদিও লক্ষ্য তুলনামূলক ছোট ছিল। ২৪ মে টাইগারদের টার্গেট ছিল ২৭১। আর বৃহষ্পতিবার তারচেয়ে ৫০ রান বেশি লক্ষ্য ছিল লঙ্কানদের। যেভাবে লঙ্কান ওপেনার দানুষ্কা আর তিন নম্বর কুশল মেন্ডিস বড় জুুটি গড়ার পর ম্যাথিউস, পেরেরা আর গুনারত্নে ফিনিশ করেছেন, ডাবলিনে কিউইদের সঙ্গে ম্যাচে বাংলাদেশের ওপেনার তামিম (৬৫) আর ওয়ান ডাউন সাব্বির (৬৫) ১৩৬ রানের বড় জুটি গড়ে জয়ের পথে এগিয়ে দিয়েছেন। আর ম্যাচ শেষ করেছেন মাহমুদউল্লাহ (৪৬*) আর মুশফিক ( ৪৫*) জুটি।
মোদ্দা কথা এমন সম্মিলিত অবদানই দরকার। তা করতে পারলে জেতা অবশ্যই সম্ভব। শেষ কথা হলো আগে কিংবা পরে যখনই ব্যাটিংয়ে থাকুক বাংলাদেশ, অন্তত একজন ওপেনার আর তিন না হয় চার নম্বর ব্যাটসম্যানের দুজনকে লম্বা ইনিংস খেলতে হবে। তাদের মধ্যে ১০০+ পার্টনারশিপ প্রয়োজন। আর তারপর ৫, ৬ ও ৭ নম্বরে যে কোন দুজনের বা অন্তত একজনের শেষ বল পর্যন্ত উইকেটে থাকতে হবে। তা করতে পারলে সাফল্যর দেখা মিলবে।
অনেকের মত গানিতিক ক্রিকেট খেলেছে লঙ্কানরা। আবার কারো কথা স্ট্র্যাটেজিক্যাল ক্রিকেট খেলে ক্লিনিক্যাল ফিনিশ করেছে ম্যাথিউসের দল। সেমির সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখতে আজ বাংলাদেশকে সাফল্যের ভেন্যু কার্ডিফে সঠিক সময় সঠিক কাজগুলো করতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা কাউকে না কাউকে ম্যাথিউসের মত যথার্থ উইনারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। সে ভূমিকা নেবেন কে? সাকিব আল হাসান না মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ?
কেউ বলবেন না মেধা, প্রজ্ঞা, ব্যাটিং টেকনিকে ম্যাথিউসের চেয়ে পিছিয়ে সাকিব ও মাহমুদউল্লাহ। দুজনই যথেষ্ট পরিণত, অভিজ্ঞ ও যে কোন পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য রাখেন। কিন্তু মেধা-প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে ম্যাচ শেষ করে দল জিতিয়ে বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়ার ইচ্ছেটাই কম। এই ইচ্ছে শক্তি বাড়াতে হবে। আমি পারি। আমার সামর্থ্য আছে দল জেতানোর। ম্যাচ শেষ করে মাঠ ছাড়ার। এটাই আমার কাজ। এই দৃঢ় সংকল্প আর তাগিদটা বড্ড দরকার সাকিব ও মাহমুদউল্লাহর।
এআরবি/এমআর/জেআইএম