১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। সেনাবাহিনীর কিছু জুনিয়র অফিসার এই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। তারা কয়েকজন সিনিয়রকেও আগ থেকেই তাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল। যেমন তারা আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাককেও আগে থেকে প্রস্তুত রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রও আজ প্রকাশ্য। ১৫ আগস্টের পর থেকে সেনাবাহিনীতে চলতে থাকে অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানের রক্তারক্তি খেলা। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনাদের হত্যা। গণভবন থেকে ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে ওঠে সেনানিবাস। ধীরে ধীরে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। এরপর শুরু হয় সৈনিক হত্যা। রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশ চলতে থাকে পেছনের দিকে। যেন পাকিস্তানেরই একটি এক্সটেনশন। বদলানো যায়নি শুধু বাংলাদেশ নামটি। এরইমধ্যে ইতিহসের সবচে’ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয় জেলখানার ভিতরে, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন মাসের মধ্যেই ওই একই খুনিচক্র জেলখানার মত নিরাপদ স্থানে রাতের অন্ধকারে হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে। এটি কেবল নিছক হত্যাকাণ্ডই নয়। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল তারা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান- এই চারটি নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্রসম। এই চারজনকে ছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস লেখা সম্ভব না। ৭১ এর ২৫ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানিরা আটক করে নিয়ে যাওয়ার পর তারাই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশ স্বাধীন করেন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। মূলত তাদের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাষ্ট্র যখন পরিচালিত হচ্ছে খুনিদের কথামতো, আর এই চারনেতা যখন কারাগারে বন্দি তখন তাদের হত্যা করতে হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে আজকের রাজনৈতিক হানাহানির হিসেবটাও মিলবে। বঙ্গবন্ধুকে কি শুধুই ওই জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা হত্যা করেছে? বলা হয় তাদের রাগ ছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর। তাহলে জাতীয় চার নেতাকে কেন হত্যা করা হল। তাজউদ্দিন আহমদতো মন্ত্রিসভায়ও ছিলেন না। তাদের খুন করা হয়েছে একটি কারণেই সেটা হল ৭১এর প্রতিশোধ। পাকিস্তানিরা যে কাজটা করতে পারেনি এক লাখ সৈন্য দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়েও যে যুদ্ধে তারা জিততে পারেনি, সেই অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তান বানানোর পরিকল্পনা থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ খুনিচক্র জানে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই চার নেতাই দেশকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। যেমনটি তারা ৭১ এ যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সাফল্যের সাথে। খুনিরা জানতো এই চার নেতার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আবার ওঠে দাঁড়াবে, তারা বেঁচে থাকলে বাংলাদেশকে কখনোই পাকিস্তান বানানো যাবে না। তাই বঙ্গভবন থেকে নির্দেশ দিয়ে রাতের অন্ধকারে জেলগেইট খুলতে বাধ্য করে খুনিদের ভেতরে পাঠানো হয় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করতে। এরপর ২১টি বছর ওই খুনিদের মনিবরাই ক্ষমতায় আসীন ছিল। আর খুনিরা শুধু রাষ্ট্রীয় পদেই ছিল না, তাদের কারো মৃত্যুর পর, কারো অবসর নেওয়ার পর বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে, এমনকি সংসদে বসার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনেরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এই ২১ বছরে রাষ্ট্রের কাঠামোটাও পরিবর্তন করা হয়েছে। জাতীয় চার মূলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু হয়েছে, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাসপোর্টে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী করা হয়েছে, পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা শুরু হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ সুগম করে দেয়া হয়েছে, শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও করা হয়েছে। এই প্রতিটি কর্মকাণ্ডই পাকিস্তানের আদলে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে করা হয়েছে। আজ যে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা, আজ যে জঙ্গিবাদের উত্থান এটা সেই ষড়যন্ত্রেরই ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করতে না পারলে আজ দেশে অন্তত সাম্প্রদায়িকতার ঠাঁই হতো না। তাই আজ শোকাবহ জেলহত্যা দিবসে দাবি থাকবে খুনি চক্রের ফাঁসিই শুধু নয়, কেন জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করা হয়েছিল এর রাজনৈতিক তদন্তের। কারা নেপথ্যে ছিল, কারা ইন্ধন জুগিয়েছে, কারা ষড়যন্ত্র করেছে এর সবটাই উদঘাটন করতে হবে। এটা ফৌজদারি তদন্তের বিষয় নয়, দরকার রাজনৈতিক তদন্ত। ভবিষ্যত বাংলাদেশে যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না ঘটে তার জন্য এই তদন্ত খুবই জরুরি। লেখক : সম্পাদক, ডিবিসি নিউজএইচআর/আরআইপি
Advertisement