মতামত

ট্রাম্প কি নোবেল পাচ্ছেন?

ট্রাম্প কি নোবেল পাচ্ছেন?

অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করেছেন। বিষয়টি সামরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে কীভাবে স্থান পাবে তা এ মুহূর্তে সঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে যুদ্ধবাজ, পারমাণবিক শক্তিধর, মানবতার প্রতি দরদহীন, ও হঠকারী একজন ব্যক্তির জন্য নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপ্য হতে পারে তা নিয়ে এই সংবাদটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে সেটা বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে ধাঁ ধাঁ ও বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে অতি ব্যাপকভাবে !

Advertisement

নোবেল শান্তি পুরস্কার নামটি উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মানবিকতা, অহিংসা, শান্তি প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করা কিছু ব্যক্তিত্বের মুখচ্ছবি। মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, মালালা ইউসুফজাই, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, নিহোন হিদাঙ্কিয় বা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর মতো নামগুলো নোবেলের মর্যাদা ও গুরুত্বকে তুলে ধরে। কিন্তু আজ এই পুরস্কার যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো যুদ্ধাপরাধের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ শরিক এক নেতার নামের পাশে উচ্চারিত হয়, তখন প্রশ্ন জাগে, নোবেল কমিটিকে নিয়ে কেউ মজা করছে নাকি ইতিহাসের মুখে এক ভয়াবহ চপেটাঘাত করা হচ্ছে?

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হঠাৎ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করাটা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর ও প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ ট্রাম্প হচ্ছেন সেই নেতা, যিনি মুসলিম নিষেধাজ্ঞা জারি করে পাকিস্তানসহ বহু মুসলিম দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় প্রবেশে বাধা দিয়েছিলেন। আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক আগ্রাসন বাড়িয়েছিলেন; এমনকি পাকিস্তানের উপরও বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করেছেন। ফলে একসময় যে ট্রাম্পকে পাকিস্তানে বিশ্ব মুসলিম বিদ্বেষের প্রতীক বলা হতো, আজ তার শান্তির প্রতীক হিসেবে সুপারিশ করাটা শুধু রাজনৈতিক ইউটার্ন নয়, বরং এটি পাকিস্তানি সামরিক অভিজাতদের আত্মবিক্রয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের নতুন অক্ষ খোঁজার ইঙ্গিতও বটে। এটি একদিকে যেমন বিস্ময় জাগায়, তেমনি বিশ্ববাসীকে সতর্কও করে যে, ক্ষমতার খেলার দাবায় নীতির কোনো স্থায়ী জায়গা থাকে না।

নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে এমনিতেই নানা বিতর্ক রয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জারকে দেওয়া নোবেল পুরস্কার আজও ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হিসেবে রয়ে গেছে। তখন যেমন বলা হয়েছিল ‘নরকের আগুন নেভানোর জন্য যারা আগুন ধরিয়েছিল তাদেরই পুরস্কৃত করা হচ্ছে,’ আজ ট্রাম্পকে সুপারিশ করে একই ইতিহাস পুনরাবৃত্তির আয়োজন চলছে।

Advertisement

ট্রাম্প শুধু একজন বিতর্কিত রাজনীতিবিদ নন, বরং তিনি এমন একজন নেতা যাঁর শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে আগুনে ঘি ঢেলেছে। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত, গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার পৃষ্ঠপোষকতা, ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে নির্লিপ্ততা, এসব কিছুর দায় ট্রাম্পের ঘাড়েই বর্তায়। শুধু তাই নয়, ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বর্বর বিমান হামলার ক্ষেত্রে মার্কিন অস্ত্রের জোগান এবং নৈতিক সমর্থনও এসেছে তাঁর প্রশাসন থেকে। এর সবই যুদ্ধাপরাধের পরিসরে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির লঙ্ঘন।

এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পকে শান্তির নোবেলের জন্য সুপারিশ করা কেবল অবিবেচনার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এক অর্থে যুদ্ধাপরাধকে বৈধতা দেওয়ার শামিল। তা হলে কি ভবিষ্যতে অ্যাডলফ হিটলারকে ইউরোপীয় ঐক্যের প্রবক্তা হিসেবে বা জর্জ বুশকে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হবে? ইতিহাস কি এতই হাস্যকর হয়ে উঠেছে?

নোবেল পুরস্কারের সুপারিশ করা যেকোনো ব্যক্তি বা সংস্থার পক্ষে উন্মুক্তভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সংসদ সদস্য, বিচারপতি বা আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতিনিধি সুপারিশ করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ ধরনের সুপারিশ করার ক্ষেত্রে কোনো ন্যূনতম নৈতিক বিবেচনা থাকা উচিত নয় কি? ট্রাম্পের নাম যারা শান্তির পুরস্কারের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন, তারা কি তার আগের চার বছরের ইতিহাস ভুলে গেছেন, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করছেন?

এখানে মনে রাখা জরুরি, শান্তি শুধু যুদ্ধ না থাকার নাম নয়, শান্তি হলো মানুষের মর্যাদা, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের ওপর দাঁড়িয়ে নির্মিত এক টেকসই সমাজব্যবস্থা। আর এই জায়গায় ট্রাম্প হচ্ছেন একেবারে ব্যর্থ এক প্রতিচ্ছবি। তাঁর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদ উসকে উঠেছিল, অভিবাসী ও মুসলিম বিদ্বেষ চরমে পৌঁছেছিল, এবং ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির নামে বিশ্ববাসীর প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গাটি নির্বাসিত হয়েছিল।

Advertisement

নোবেল পুরস্কার সম্পর্কে এমনিতেই নানা বিতর্ক রয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জারকে দেওয়া নোবেল পুরস্কার আজও ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হিসেবে রয়ে গেছে। তখন যেমন বলা হয়েছিল ‘নরকের আগুন নেভানোর জন্য যারা আগুন ধরিয়েছিল তাদেরই পুরস্কৃত করা হচ্ছে,’ আজ ট্রাম্পকে সুপারিশ করে একই ইতিহাস পুনরাবৃত্তির আয়োজন চলছে। এটি একদিকে যেমন নোবেলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে, অন্যদিকে বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধাপরাধীদের হাতে একটি মিথ্যা বৈধতার সনদও তুলে দেয়।

বিচার, মানবতা ও ইতিহাস একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একজন যুদ্ধাপরাধের শরিক যখন শান্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হন, তখন সাধারণ মানুষের চেতনায় বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে, এবং সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, যুদ্ধাপরাধীরা এতে উৎসাহিত হয়। এমন একটি প্রক্রিয়া যদি চলতেই থাকে, তবে ভবিষ্যতে শান্তির সংজ্ঞা হয়তো এমন হবে, ‘যার হাতে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র, সেই-ই শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে।’

নোবেল কমিটি এখনো ট্রাম্পকে পুরস্কার দেয়নি এটাই একমাত্র সান্ত্বনা। তবে যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাঁকে সুপারিশ করেছে, তারা এক ধরনের নৈতিক অপরাধ করেছে বলেই মনে করা যায়। এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা এবং নোবেল কমিটিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি যে, তারা শুধু একটি পুরস্কার দিচ্ছেন না, তারা ইতিহাস লিখছেন। ভুল মানুষকে পুরস্কৃত করা মানে, মানবতা ও ন্যায়বিচারের সঙ্গে প্রতারণা করা।

পাক সেনাপ্রধানের হঠাৎ ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করার পেছনে নিছক প্রশংসার চেয়ে অনেক গভীর রাজনৈতিক হিসাব লুকিয়ে থাকতে পারে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নির্বাচনে আবারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে আছেন, আর পাকিস্তান বিশেষ করে সেনাবাহিনী চায় ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্ক পুনর্গঠন ও নিজেদের ভূরাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করতে।

এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পকে শান্তির দূত হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা মূলত ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ, কৌশলগত আশীর্বাদ পাওয়ার কূটচাল হিসেবেই দেখা যেতে পারে। পাশাপাশি, সেনাবাহিনী বর্তমানে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সমর্থন খুঁজছে, এবং ট্রাম্পের মদদ পাওয়ার জন্য এমন নোবেল কৌশল হয়তো তাদের মতে কার্যকর মাধ্যম। ফলে এই সুপারিশ কেবল এক নেতার প্রশংসা নয়, বরং তা হলো এক কূটনৈতিক চেস মুভ।

এটি এক জটিল সামরিক-কূটনৈতিক চেস মুভ, যেখানে প্রতিটি চালই ভবিষ্যতের লাভ নিশ্চিত করতে কষে বসানো। পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানে, ট্রাম্প যদি আবার হোয়াইট হাউসে ফেরেন, তবে তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি ও মুসলিম বিশ্বের প্রতি আগ্রহহীনতা সত্ত্বেও আফগানিস্তান, ভারত, চীন ও মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ইসলামাবাদের জন্য নতুন দরজা খুলতে পারে।

এই প্রস্তাবের মাধ্যমে সেনাবাহিনী ট্রাম্পের সম্ভাব্য ক্ষমতা প্রত্যাবর্তনের আগে থেকেই এক ধরনের অনুগত সংকেত পাঠাতে চায়, যাতে ভবিষ্যতে কৌশলগত সুবিধা, সামরিক সহায়তা কিংবা রাজনৈতিক আশীর্বাদ আদায় সহজ হয়। একই সঙ্গে এটি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের দিকেও এক পরোক্ষ বার্তা যে ইসলামাবাদ বিকল্প মিত্র তৈরি করতেও পিছপা নয়। অর্থাৎ, এই নোবেল সুপারিশ আসলে বিশ্বশক্তির দাবা বোর্ডে একটি আগাম চাল, যার গন্তব্য ভবিষ্যৎ প্রতিদান নিশ্চিত করা।

তবে ইরান-ইসরায়েল ভয়াবহ সংঘাত চলাকালীন এই মুহূর্তে যুদ্ধ, নিপীড়ন, উদ্বাস্তু সংকট ও গণহত্যা যখন বিশ্বের নানা প্রান্তে বিদ্যমান, তখন শান্তির নোবেল কারো হাতে তুলে দেওয়ার আগে একটিবার ভাবা দরকার। তিনি সত্যিই কি শান্তির প্রতিনিধি, নাকি সহিংসতার স্টেজ ম্যানেজার? এই প্রশ্নটিই আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

নোবেল শান্তি পুরস্কার যদি সত্যিই শান্তির বার্তা দেয়, তবে ট্রাম্পের নামের পাশে তার উচ্চারণ যেন ভবিষ্যতেও না হয়। আর যদি হয়, তবে সেটিই হবে নোবেলের ইতিহাসে আরেক অনুশোচনার অধ্যায়, যা থেকে পৃথিবীর কিছুই শেখা হয়নি।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/জিকেএস