মধ্যরাতে হঠাৎ বারবার বেজে উঠছে ফোন। বিরক্ত হয়ে ঘুমঘুম চোখে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘তাড়াতাড়ি থানায় আয়, রাফিকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।’ এমন কথা শুনে রীতিমতো হাত-পা কাঁপছিল রিফাতের। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল সেই ছেলেটার মুখ, যে একসময় সবচেয়ে বেশি হাসতো, সবচেয়ে ভালো খেলতো, যার সঙ্গে প্রতিদিন না দেখা হলে দিনটা অসম্পূর্ণ লাগত। কবে, কীভাবে বদলে গেল তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা!
Advertisement
বন্ধু মানে শুধু সুখে-দুঃখে পাশে থাকা নয়, বন্ধু ভুল পথে পা বাড়ালে তার পথ রোধ করাও বন্ধুর দায়িত্ব। কিন্তু প্রিয় মানুষটা যখন ধীরে ধীরে অন্ধকারে হারিয়ে যায়, তখন কী করা উচিত? কীভাবে তাকে বোঝাবেন, থামাবেন, আগের জীবনে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবেন?
১৯৮৭ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয় যে, প্রতি বছর ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস (মাদকদ্রব্য অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস) হিসেবে পালন করা হবে। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হলো মাদকাসক্তি মুক্ত তরুণ সমাজ গড়ে তোলা। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের প্রয়াস ও সহযোগিতাকে আরও নিবিড় করে তুলতে প্রতি বছর ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস হিসেবে পালিত হয়।
নেশার পথে হাঁটা শুরু হয় কীভাবেএকজন তরুণ হুট করে নেশার পথে পা বাড়ায় না। এর পেছনে থাকে মানসিক চাপ, পারিবারিক অশান্তি, বন্ধুদের প্ররোচনা, সম্পর্ক ভাঙা কিংবা স্বপ্নভঙ্গের মতো নানা কারণ। প্রথমে হয়তো সিগারেট, পরে ধীরে ধীরে গাঁজা, ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন বা আরও ভয়াবহ সব মাদক গ্রহণ করেন অনেকে। নিজের ভেতরের শূন্যতা ঢাকতেই অনেক তরুণ মাদককে বেছে নেয় সাময়িক সঙ্গী হিসেবে।
Advertisement
তাদের চোখে তখন এটা ‘বাঁচার সহজ উপায়’। অথচ এই সাময়িক সুখই ধীরে ধীরে তাকে চুরমার করে দেয় মানসিকভাবে, শারীরিকভাবে এবং সামাজিকভাবে। এমন অবস্থায় বন্ধুর প্রতি আপনার করণীয় কী?
দোষারোপ নয়, তাকে বোঝার চেষ্টা করুনবন্ধু আচরণে বদল এলেই রেগে যাবেন না, আগে বুঝতে চেষ্টা করুন কী হচ্ছে। সে কেন বদলাচ্ছে? পারছে না বলতে, নাকি বলতে ভয় পাচ্ছে? তাকে সময় দিন, আগের মতো আড্ডা দিন, নিজের অনুভূতিগুলোও শেয়ার করুন। নেশা নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলে অনেক সময় সে গুটিয়ে যেতে পারে। বরং আগলে রাখুন, শুনুন।
বলার ধরণ বদলান, কিন্তু বলা থামাবেন না‘তুই কী করছিস এসব?’ এই ধরনের বাক্য না বলে বলুন, ‘তুই এমন ছিলি না... আমি তোর জন্য চিন্তিত’, ‘তোর জায়গায় আমি থাকলেও হয়তো এমন হতো, কিন্তু এখনও সময় আছে, আমি আছি তোর পাশে।’ আপনার বন্ধুকে এমনভাবে বোঝানোর চেষ্টা করুন, যেন সে আপনাকে ভরসা করতে পারে। কারণ ভালোবাসার ভাষা অনেক বেশি কার্যকর হয় রাগের চেয়ে।
সময় দিন, আলাদা নয়অনেক সময় পরিবার, সমাজ এমনকি বন্ধুরাও মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলতে থাকে। এতে করে সে আরও একা হয়ে পড়ে। অথচ আপনি পাশে থাকলে, সে বুঝবে, সে একা নয়। মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখতে নিয়ে যান, কোথাও ঘুরতে যান, তার ভালোলাগা ব্যাপারগুলো মনে করিয়ে দিন।
Advertisement
তার ভালো দিকগুলো মনে করিয়ে দিন‘তুই ক্লাসে সব সময় সেরা ছিলি’, ‘তুই গানটা ভালো গাইতি’ - এই ধরনের ছোট ছোট প্রশংসা একজন নেশাগ্রস্ত মানুষকে আবার নিজের প্রতি বিশ্বাস জাগাতে পারে। আত্মবিশ্বাস ভেঙে গেলে কেউ আর পরিবর্তনের পথ খুঁজে পায় না।
পেশাদার কাউন্সিলরের সাহায্য নিনযদি বুঝতে পারেন, সমস্যা আপনার একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়, তাহলে দেরি না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, পেশাদার কাউন্সিলর বা নিরাময়কেন্দ্রের সাহায্য নিন। তবে খেয়াল রাখুন, জোর করে নয়, বোঝাতে বোঝাতে তাকে রাজি করান। তাকে বোঝান যে, আপনি তার পাশে থাকবেন পুরো সময়।
বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে মাদকের বাস্তব চিত্রবাংলাদেশে মাদক সমস্যার ভয়াবহতা এখন অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্ট বলছে, দেশের প্রায় ৮০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদকাসক্ত। এর মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগই তরুণ। মাদক সেবন শুরু করার গড় বয়স এখন ১৫-১৮ বছরের মধ্যে।
শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজকেও ধ্বংস করে মাদকবন্ধু মাদক নিলেও তার প্রভাব পড়ে আশপাশের সব মানুষের ওপর। পরিবার ভেঙে যায়, পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, চাকরি হারায়, অনেক সময় সে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। একটি সম্ভাবনাময় জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তাই আপনি যদি একজন প্রকৃত বন্ধু হন, তাহলে তাকে চুপচাপ হারিয়ে যেতে দেখবেন না।
কেউ মাদকে আসক্ত বোঝার উপায়হঠাৎ অতিরিক্ত চুপচাপ হয়ে যাওয়া, চোখ লাল থাকা, আচরণে খিটখিটে ভাব আসা, অস্বাভাবিক উপায়ে টাকা জোগাড়ের চেষ্টা করা, পড়াশোনা বা কাজ নিয়ে আগ্রহ কমে যাওয়া ইত্যাদি।
বন্ধুত্বের আসল মানে তখনই বোঝা যায়, যখন সে অন্ধকারে থাকে আর আপনি আলো হাতে এগিয়ে যান। হয়তো আপনি পারবেন না তাকে একা বদলে দিতে, কিন্তু আপনার আন্তরিক চেষ্টাই হতে পারে তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। রাফির মতো আরও অনেক তরুণ এখনো সময় থাকতে ফিরে আসতে পারে, যদি পাশে দাঁড়ায় এমন একজন বন্ধু, যে শুধু তালি দেয় না, দরকার হলে কান্নায় ভিজে যায়, হাত ধরে টেনে তোলে।
জেএস/আরএমডি/এএসএম