ভ্রমণ

ছুয়ানঝৌ: প্রাচীন বন্দরনগরী থেকে আধুনিক শিল্পকেন্দ্র

ছুয়ানঝৌ: প্রাচীন বন্দরনগরী থেকে আধুনিক শিল্পকেন্দ্র

মো. খালেদ হাসান মোরশেদুল বারী

Advertisement

প্রায় দু’সপ্তাহ সময় কাটিয়ে মাত্রই ফিরে এলাম চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের ছুয়ানঝৌ শহর থেকে। একপাশে সমুদ্র, চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা এই ছিমছাম শহরটি চীনের অন্যতম প্রাচীন শহরগুলোর একটি। প্রায় ১৪০০ বছরের পুরোনো ছুয়ানঝৌ একসময় ছিল সিল্ক রোডের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।

আধুনিক বন্দর ব্যবস্থার গোড়াপত্তন এখানে হয়েছিল বহু আগেই। এক সময়কার চীনের অন্যতম ব্যস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল এটি। খ্যাতিমান পর্যটক মার্কো পোলো বলেছিলেন, ‘বিশ্বের দুটি বৃহত্তম বাণিজ্য আশ্রয়স্থলের একটি।’ ইবনে বতুতা বলেছিলেন, ‘সম্ভবত এটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বন্দরগুলোর মধ্যে একটি।’

বন্দর ঘিরেই এখানে গড়ে ওঠে সিরামিক, চিনি, লবণ, গ্রানাইট-পাথরের কারখানা এবং ভাস্কর্য নির্মাণ শিল্প। এরই ধারাবাহিকতায় আজও শহরটি চীনের অন্যতম শিল্পকেন্দ্র হিসেবে টিকে আছে।

Advertisement

সহকর্মী যখন বলল যে, এ শহরে রয়েছে এক হাজার বছরের পুরোনো এক মসজিদ। শুনে প্রায় চমকে উঠেছিলাম। কিছুটা কৌতূহলও হলো, এ তো দেখতেই হয়। কাজের ফাঁকেই ঢুঁ মারতে গিয়ে দেখলাম, আসলেই প্রায় এক হাজার বছরের পুরোনো। ১০০৯ খ্রিষ্টাব্দে বানানো স্থাপনাটি আরব বণিকদের হাত ধরেই নির্মিত। ভাবতেই অবাক লাগে, হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে সেই সময়েও তারা এ বন্দর শহরে এসে মসজিদও নির্মাণ করেছিলেন।

শুধু ইসলাম নয়, হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের ছোঁয়াও স্পষ্ট ছুয়ানঝৌর প্রাচীন স্থাপনাগুলোতে। শহরের প্রান্তে রয়েছে একটি প্রায় ১৪০০ বছরের পুরোনো বৌদ্ধ মন্দির। সেখানে থাকা পাথরের খোদাই করা শিব ও বিষ্ণুর অবয়ববিশিষ্ট পিলারগুলো বর্তমানে সংরক্ষিত আছে ছুয়ানঝৌ জাদুঘরে। ঐতিহাসিক সূত্রমতে, এগুলো তৈরি করেছিলেন ১৩০০ শতকে দক্ষিণ ভারতের তামিল জনগোষ্ঠীর কিছু অভিবাসী, যারা এখানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। মন্দিরে এবং জাদুঘরে ছবি তোলার অনুমতি না থাকায় স্মৃতি ধরে রাখা গেলো কেবল মনে।

আরও পড়ুনপথের শেষে দাঁড়িয়ে পৃথিবী দেখতে চাইবিমানবন্দরে নামবো একদম খালি হাতে: ইকরামুল হাসান শাকিল

ছুয়ানঝৌ কেবল ইতিহাসের শহর নয়, এটি আজও চীনের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অঞ্চল। ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটারের এ শহরে প্রায় ১২ হাজার গার্মেন্টস কারখানা আছে। সমগ্র চীনের রপ্তানিযোগ্য রেডিমেড গার্মেন্টসের প্রায় ১৫ শতাংশ এখানে উৎপাদিত হয়। চীনের ৮০ শতাংশ এবং বিশ্বের প্রায় ২০ শতাংশ স্নিকার্স উৎপাদিত হয় এ শহরেই। এখানে আছে একাধিক গাড়ির গ্লাস নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, যাদের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নির্মাতাও অন্যতম। এসব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিতভাবে উৎপাদিত গ্লাস চীনের মোট চাহিদার প্রায় ৩৫% পূরণ করে।

Advertisement

এতসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান আর সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ছুয়ানঝৌ নিঃসন্দেহে এক ধনী ও গতিশীল শহর। এ শহরের জিডিপি প্রায় ১৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চীনে থাকা অবস্থায় আমি যত শহরে গেছি; তার মধ্যে সম্ভবত ছুয়ানঝৌতেই সবচেয়ে বেশি বিলাসবহুল গাড়ির শোরুম চোখে পড়েছে।

এ শহরে দু’সপ্তাহ কাটানোর সময়টুকু শুধু কাজ আর ঘুরে বেড়ানোতে আটকে থাকেনি। প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন ফ্যাক্টরি ভিজিটের মাঝেই কিছু মানুষের সাথে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আড্ডা হয়েছে। তাদের সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপট আর পারস্পরিক সম্ভাবনার জায়গাগুলো নিয়ে আলাপ—সব মিলিয়ে প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা ছিল নতুন কিছু শেখার মতো। কখনো এক ঝলক জুতার বাজারে ঢুঁ মারা, কখনো চলতি পথে চোখে পড়া শোরুমে ঢুকে দেখা, গল্পে-গল্পে দু’পক্ষের সম্ভাব্য সহযোগিতার সূত্র খোঁজা—সবকিছুতেই যেন নিজেকে একটু একটু করে নতুন করে চিনলাম।

সমুদ্রের পাশের শহর হওয়ায় প্রতিদিনের যাত্রায় উপসাগরের ধারে সময় কাটানো, প্রায় ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র-সেতু দিয়ে চলা কিংবা সৈকতের ধারে বসে সন্ধ্যা দেখা—সব মিলে মনে হচ্ছিল, ব্যস্ততার ভিড়েও কোথাও যেন একটু প্রশান্তি লুকিয়ে আছে।

ছুয়ানঝৌ থেকে বিদায়ের আগে ভাবছিলাম, কতটুকু শহর দেখা হলো আর কতটুকুই বা মনের মধ্যে থেকে গেলো। কিছু জায়গা দেখা হয় না, কিছু অনুভব বলা হয় না—তবুও এই দুই সপ্তাহের অভিজ্ঞতা হয়তো ভবিষ্যতের অনেক পথচলার ভিত হয়ে থাকবে। একটি নতুন শহরকে দেখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ; তেমনই নিজের পথচলার পরের ধাপগুলোর ধারণা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও এ অভিজ্ঞতা অনেক সমৃদ্ধ করেছে। কোথাও গিয়ে মনে হয়, শুধু বেড়াতে আসিনি—শেখার, বোঝার আর গড়ে তোলার একটি চেষ্টাও করে গেলাম।

লেখক: টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চীনের সাংহাইয়ে কর্মরত। কাজের প্রয়োজনে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি ইতিহাস ও ভ্রমণবিষয়ক লেখালেখিতে আগ্রহী।

এসইউ/জেআইএম