ভ্রমণ

ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে যা দেখবেন

ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে যা দেখবেন

সুরাইয়া পারভীন

Advertisement

আরনো নদীর তীরে প্রাচীর ঘেরা সমৃদ্ধ শহর ফ্লোরেন্স। নিজস্ব শাসনব্যবস্থা, সংবিধান, সামরিক বাহিনী, অর্থব্যবস্থা, পররাষ্ট্র সম্পর্ক সব বিদ্যমান। আকারে নগর কিন্তু স্বভাবে রাষ্ট্র। ১১০০ সাল পরবর্তী ফ্লোরেন্স ছিল একটি নগররাষ্ট্র। পঞ্চাশ ফুট উঁচু, প্রাচীন ইট, পাথর দিয়ে বানানো ফ্লোরেন্সের প্রবেশপথ। আজ পর্যন্ত টিকে আছে সে সময়ের কাঠের দরজা। অবশ্য সব সময়েই খোলা থাকে। দরজার সামনেই গোল চত্বর। মাথায় বোঝা নিয়ে চত্বরে একাকী দাঁড়িয়ে আছে এক নারীমূর্তি। চত্বর থেকে ছয়টি সড়ক, শহরের ছয় দিকে আলাদাভাবে ছুটে গেছে।

শহরে ছড়িয়ে থাকা রাস্তার আশপাশের সুপ্রাচীন ভবনগুলোয় আঁকা শিল্পশৈলী জানান দেয় জনগণের ধর্মীয়, শিল্পকলা, শক্তিমত্তা, এমনকি অর্থপ্রাচুর্যের কথা। আর্ট ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা ফ্লোরেন্সের এখানে-সেখানে একেবারে গুরুত্বহীন জায়গায় চমৎকার গ্রাফিতি এঁকে রেখেছেন। দেখে মনে হয়, সম্পদের বিনাশ। অথচ এগুলো একেবারে পাকা হাতের কাজ। ইতালিয়ানরা স্বভাবজাত ইতিহাসের সংরক্ষক।

ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত ফ্লোরেন্স শহর পৃথিবীতে অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ উপহার দিয়েছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, দান্তে, ম্যাকিয়াভেলি, গ্যালিলিও, বাত্তেচেল্লি এবং মেডেসি পরিবারের শাসকরা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আমাদের কাছাকাছি সময়ের ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, জনপ্রিয় লেদার ব্র্যান্ড গুচি পরিবার।

Advertisement

মেডেসি নামটাই ফ্লোরেন্সের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। তিন শতাব্দী শাসনকালে মেডেসি পরিবার অকল্পনীয় সম্পদ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। চারজন পোপ, ফ্রান্সের দুজন রানী এবং ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এদের অবদান। আধুনিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সিস্টেম মেডিসিরাই প্রবর্তন করেন।

মেডেসি পরিবারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কেবল ফ্লোরেন্স শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৫১৩ সালে পোপ লিও দশম নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন মেডেসি পরিবারের। পোপ হিসেবে কার্যত পুরো ক্যাথলিক চার্চের সমস্ত সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ পেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল শ্রেষ্ঠ রাজা বা সম্রাটদের সাথেই ছিল না। তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বের ধনী ব্যক্তি।

লিও দশম ছাড়া আরও তিনজন পোপ এ পরিবারের ছিলেন। প্রত্যেকেই চার্চের অপরিমেয় সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করতেন। সমস্ত পোপরাজ্যও। মধ্য ইতালির বেশকিছু জমি দখল করেছিলেন। মেডেসিরা সরকার ও গির্জাকে ব্যবহার করে ধনী ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুনইতালির বিস্ময়কর গ্রাম রিওম্যাগিওরকাঠমান্ডুর থামেলে ঝলমলে নাইট লাইফ

ক্যাথেরিনা ডি মেডিসি ফ্রান্সের দ্বিতীয় হেনরির স্ত্রী, রানী এবং ফ্রান্সের শাসক। তার তিন ছেলে ছিলেন ফ্রান্সের রাজা। ফ্রান্সিস দ্বিতীয়, চার্লস নবম এবং হেনরি তৃতীয়। ফ্রান্সের প্যারিসে, সেইন নদীর তীরে, তুইলেরিস প্রাসাদ মেডেসিদের নির্মিত। গণহত্যাকারী, সিম্বল অব ডার্কনেস, ব্ল্যাক কুইন রানী ক্যাথেরিনা দি মেডেসি এ প্রাসাদ নির্মাণ করেন। অর্থনৈতিক শক্তি কিংবা রাজনীতির চেয়েও মেডেসিদের সবচেয়ে বড় লিগ্যাসি ছিল শিল্পকলায়। অনেক শিল্পী-কবি এই পরিবারের বদান্যতা লাভ করেছেন।

Advertisement

মেডেসি শাসকরা সাধারণ জনগণের সাথে একই রাস্তায় চলতে চাইতেন না। তাদের আবাসস্থল পিত্তি প্যালেস থেকে আরনো নদীর ওপারে পালাসসো ভেক্কিওতে অবস্থিত প্রাশাসনিক ভবনের সাথে একটি নিরাপদ এবং সিক্রেট প্যাসেজওয়ে তৈরি করে নেন।

মেডেসি শাসক গ্র্যান্ড ডিউক প্রথম কসিমোর নির্দেশে ১৫৬৪ সালে ডিজাইন করেছিলেন জর্জো ভাসারি। শিল্পী আর্কিটেক্টের নামানুসারে সিক্রেট এ উড়ন্ত পথের নাম ‘ভাসারি করিডোর’। এটি আর্কিটেকচারাল দিক থেকে উচ্চাভিলাষী। প্রায় পুরোটা প্যাসেজই শহরের ওপর দিয়ে এলিভেটেড হয়ে চলে গেছে।

যাত্রায় একঘেয়েমি বা বিরক্তি না আসার জন্য অসংখ্য পেইন্টিং এঁকে রেখেছে করিডোরের মাঝে। আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আত্মপ্রকৃতির সংগ্রহ। এলিভেটেড ওয়াকওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় এসব পোর্টাল দেখে বুঝতে পারে, তারা এখন শহরের কোথায় আছেন।

কিছু দূর পর পর করিডোরের ভিউইং পয়েন্ট থেকে নিচের শহর-প্রকৃতি দেখা যায়। এক কিলোমিটারের কাছাকাছি দৈর্ঘ নিয়ে। ববোলি গার্ডেনের পূর্ব কোণ থেকে পন্তে ভেক্কিও অতিক্রম করে সর্পিলভাবে উফিজ্জি গ্যালারির মধ্য দিয়ে চলে গেছে পুরোনো প্রাসাদ পর্যন্ত। মনে হয় বিশালাকার সাপ, পুরোনো শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে অসংখ্য বাড়িঘর পাশ কাটিয়ে পিত্তি প্যালেসে হানা দিয়েছে।

সংকীর্ণ আর সাদা রং করা প্যাসেজওয়েটি নবাগত কারোর জন্য, ডানে-বামে মোড় নেওয়া যেন অনন্ত এক যাত্রাপথ। বর্তমানে ভাসারি করিডোর নিরাপদ প্যাসেজওয়ে হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে সেটি সম্ভ্রান্ত মেডেসিদের জন্য নয় বরং আর্টওয়ার্কের জন্য। এর দীর্ঘ এবং নিরাপদ দেওয়ালের অভ্যন্তরে সংরক্ষিত আছে বিরল সব পেইন্টিং। বিখ্যাত উফিজ্জি গ্যালারির মধ্য দিয়ে চলে গেছে। তাই গ্যালারির বাড়তি সব ছবি রাখা আছে এখানে। উফিজ্জি, পালাৎসো ভেক্কিও, পিত্তি প্যালেস বর্তমানে মিউজিয়াম। সাথে ভাসারি করিডোরও।

এসইউ/জেআইএম