সাহিত্য

স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং জর্জ অরওয়েলের ‘মারাকেচ’

স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং জর্জ অরওয়েলের ‘মারাকেচ’

ভূমিকা ও অনুবাদ: মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

Advertisement

ইতিহাসকে ফিরে দেখার মতো দৃষ্টিভঙ্গিপ্রসূত একটি রচনা ‘মারাকেচ’। অবিভক্ত ভারতের বাংলা প্রদেশের মতিহারিতে ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেওয়া এরিক আর্থার ব্লেয়ার নামের শিশুটি মাত্র ছেচল্লিশ বছর আয়ুষ্কালে বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে জর্জ অরওয়েল ছদ্মনামে কালোত্তীর্ণ ইংরেজ সাহিত্যিক ও বিখ্যাত রাজনৈতিক লেখক হয়ে উঠলেন। তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের বহুবর্ণ ও ক্রিয়াশীল ভ্রমণের একটি অংশ ‘মারাকেচ’। তার আগের পটভূমিটি পাঠকের জানা প্রয়োজন।জর্জ অরওয়েল ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুন এলিন ও’শাওনেসিকে বিয়ে করেন। এর কিছুদিন পরেই স্পেনে রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়। স্পেনীয় রাজতন্ত্রের দুর্বলতা স্পেনকে রাজনৈতিক ক্ষমতাদখলের কুরুক্ষেত্রে পরিণত করে। রাজা আলফানসোর ক্ষমতাচ্যুতি, রিভেরার সামরিক একনায়কত্ব, প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের নির্বাচনী সাফল্য এবং দক্ষিণপন্থী জোটের প্রতিক্রিয়া স্পেনের রাজনীতিতে তুমুল অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদী সেনাপ্রধান ফ্রান্সিস ফ্রাঙ্কো’র অংশগ্রহণ স্পেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা করে (১৯৩৬-১৯৩৯ খ্রি.)। প্রজাতন্ত্রকে উৎখাত করে আবার পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ফ্রাঙ্কো তার মরক্কোর সেনাবাহিনী নিয়ে স্পেনে পৌঁছেন। শুরুতে ভাবা হয়েছিল ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদ কখনোই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হারাতে পারবে না। স্পেনের কৃষক ও শ্রমিকগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁদের অধিকারকে রক্ষা করবার জন্য একজোট হয়েছিলেন। আশা করা হয়েছিল যে পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স কিছুতেই মুখ বুজে ফ্রাঙ্কোর এই স্পর্ধাকে প্রশ্রয় দেবে না। কিন্তু প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে যেতেই দেখা গেল সশস্ত্র হস্তক্ষেপ না করার অজুহাতে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স পরোক্ষভাবে ফ্রাঙ্কোকেই সাহায্য করেছে। আর ফ্রাঙ্কোকে মদত দেবার জন্য ইতালি ও জার্মানি সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েছে। অচিরেই বোঝা গেল যে, স্পেনের গৃহযুদ্ধ আদতে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহড়া।স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম কবি, নাট্যকার ও মঞ্চনির্দেশক ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা ‘প্রজন্ম ২৭’-এর একজন সদস্য হিসেবেই মূলত বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। কবিদের সম্মিলনে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘প্রজন্ম ২৭’-এর সদস্যগণ স্প্যানিশ সাহিত্যে ইউরোপিয়ান বিপ্লব আনার চেষ্টা করেন। লোরকার রচিত অসংখ্য রচনা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীর পাঠকদের কাছে। ধীরে ধীরে তাঁর কাব্য-সাহিত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বতন্ত্র এক ধারায়। তাঁকে স্পেনে ‘জনগণের কবি’ বলে ডাকা হয়। লোরকা ১৯৩৬ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময়ে নিজগৃহ কায়েহোনেস দেগারসিয়াতে অবস্থান করছিলেন। ফ্রান্সিস ফ্রাঙ্কোর সৈন্যরা লোরকাকে তুলে নিয়ে যায় এবং বন্দী করে রাখে। ১৯ আগস্ট ঘাতকেরা তাঁকে কবরস্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করার পর তাঁর মৃতদেহ গুম করে ফেলে। তাঁর মৃতদেহ আর কখনো পাওয়া যায়নি। নাটকের মাধ্যমে স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার জন্য তিনি রোষানলে পতিত হন। ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার মৃত্যু ছিল সত্যিই হৃদয়বিদারক। লোরকাকে হত্যা করা হয়েছিল তাঁর স্বাধীনতাকামী কবিতার জন্য। কবি লোরকার মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত রচনা পুড়িয়ে দেওয়া হয়।অরওয়েল প্রজাতন্ত্রের পক্ষের হয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশ নিতে স্পেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্যারিসে আমেরিকান ঔপন্যাসিক হেনরি ভ্যালেন্টাইন মিলারের সঙ্গে দেখা করেন। নিউইয়র্ক এবং প্যারিসে বসবাসের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা মিলারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ট্রপিক অব ক্যানসার, ব্ল্যাকস্প্রিং, ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্ন প্রভৃতির কারণে তিনি বিখ্যাত ও বিতর্কিত ছিলেন। মিলার অরওয়েলকে বলেন যে, কিছু বাধ্যবাধকতা বা অপরাধবোধ থেকে গৃহযুদ্ধে লড়াই করা হলো ‘নিছক মূর্খতা’। তিনি আরও বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, গণতন্ত্র রক্ষা করা ইত্যাদি ইত্যাদি সম্পর্কে ইংরেজদের ধারণাসমূহ একধরনের বেহায়াপনা’। মিলারের সঙ্গে খাবার খেয়ে অরওয়েল স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কয়েকদিন পর তিনি বার্সেলোনা শহরে ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবারপার্টি (আইএলপি) অফিসের জন ম্যাকনায়ারের সঙ্গে দেখা করেন। অরওয়েল কাতালোনিয়ার একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পা রাখেন। বেশ কয়েকটি উপদল রিপাবলিকান সরকারকে সমর্থন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এদের সমরাস্ত্র ও সাহায্য দিয়ে সমর্থন করেছিল। অরওয়েল এরকম একটি উপদল পিওইউএমে যোগ দেন। বার্সেলোনার লেনিন ব্যারাকে কিছুদিন থাকার পর তাঁকে জর্জেস কপের অধীনে অপেক্ষাকৃত শান্ত আরাগন ফ্রন্টে পাঠানো হয়। ফ্রন্টে ফিরেই তিনি এক রাতে লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। তিনি একজন শত্রু সৈন্যকে বেয়নেট উঁচিয়ে তাড়া করেন এবং শত্রুর রাইফেল ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেন।এপ্রিল মাসে অরওয়েল বার্সেলোনায় ফিরে আসেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে তিনি আরাগন ফ্রন্টে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরার পর তিনি আহত হন। একদিন স্নাইপারের একটি বুলেট গলায় বিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন তিনি। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি দীর্ঘ শরীরের অরওয়েল স্প্যানিশ যোদ্ধাদের চেয়ে যথেষ্ট লম্বা ছিলেন। তাই তাঁকে ট্রেঞ্চের সামনের আত্মরক্ষামূলক দেওয়ালের উল্টোদিকে না দাঁড়াতে সতর্ক করা হয়েছিল। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কথা বলতে অক্ষম অরওয়েলের মুখ থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে থাকে। তাঁকে স্ট্রেচারে করে সিয়েটামোতে নিয়ে যাওয়া হয়। বারবাস্ট্রো হয়ে একটি অস্বস্তিকর পথ পাড়ি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স তাঁকে নিয়ে লেইডা হাসপাতালে পৌঁছে। একটু সুস্থ হয়ে ওঠার পর ১৯৩৭ সালের ২৭ মে তাঁকে টাররাগোনায় এবং এর দুইদিন পর বার্সেলোনার শহরতলির একটি স্যানাট্যারিয়ামে পাঠানো হয়। বুলেটটি তাঁর প্রধান ধমনীর খুব কাছাকাছি হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাঁর কণ্ঠস্বর অস্ফুট শোনা যাচ্ছিল। ক্ষত সারিয়ে তুলতে সংক্রমণরোধে অবিলম্বে ক্ষার জাতীয় পদার্থের দ্বারা স্থানটি পুড়িয়ে দেবার মতো জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ইলেক্ট্রো থেরাপি চিকিৎসা দেবার পর তাঁকে চিকিৎসার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল।গৃহযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লেখেন ‘হোমেজ টু কাতালোনিয়া’ গ্রন্থটি। জর্জ অরওয়েল তাঁর উপন্যাস ‘হোমেজ টু কাতালোনিয়া’র চূড়ান্ত খসড়া সম্পন্ন করেন ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসে। এ বছরেই মার্চ মাসের ৮ তারিখে ওয়ালিংটনে থাকার সময় তিনি ফুসফুসের রক্তক্ষরণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৫ মার্চে তিনি কেন্টের আইলেসফোর্ডের প্রিস্টন হল স্যানাটোরিয়াম হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রকাশনা সংস্থা সেকার অ্যান্ড ওয়ারবার্গ ২৫ এপ্রিলে ‘হোমেজ টু কাতালোনিয়া’ প্রকাশ করে। জুন মাসে অরওয়েল ইনডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টিতে যোগ দেন। ‘নিউ লিডার’ পত্রিকার ২৪ জুন সংখ্যায় ‘কেন আমি ইনডিপেনডেন্ট লেবার পার্টিতে যোগ দিয়েছি’ শিরোনামে তাঁর লেখা ছাপা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে তিনি নতুন উপন্যাস ‘কামিং আপ ফর এয়ার’-এর কাজ শুরু করেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে মরক্কোতে শীত কাটানোর উদ্দেশ্যে প্রিস্টন হল স্যানাটোরিয়াম ছেড়ে যান। অরওয়েল দম্পতি ১১ সেপ্টেম্বর মরক্কো পৌঁছান এবং মারাকেচের অদূরেই একটি ভিলা ভাড়া নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। একটু খুলে বলা যাক, ১৯৩৮ সালে অরওয়েল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পর চিকিৎসকেরা তাকে কোনো উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে শীত কাটাতে পরামর্শ দেন। এই ভ্রমণ বাস্তবায়ন করতে ঔপন্যাসিক এল এইচ মায়ার্স বেনামে তিনশ পাউন্ড দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যায়। যা-ই হোক, অরওয়েল তার স্ত্রী আইলিনকে সঙ্গে নিয়ে উত্তর আফ্রিকার ফরাসি কলোনি মরক্কোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তিনি প্রধানত মরক্কোর মারাকেচে ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৩৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত অবস্থান করেন। জর্জ অরওয়েলের ভ্রমণগদ্য ‘মারাকেচ’ একটি চিন্তা উদ্দীপক এবং দুঃখজনক রচনা। অরওয়েল তার প্রবন্ধে ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য দ্বারা শোষিত মরোক্কোর স্থানীয় জনগণের ওপর নির্মম নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন। এই রচনায় উপাখ্যান এবং চিত্রকল্পের শক্তিশালী ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যবাদের ব্যর্থতার কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্য এবং বৈষম্যকে প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি এর অনিবার্য সমাপ্তির ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন। তার সৎ এবং সপ্রতিভ অনুধাবন পাঠককে আবেগপ্রবণ করে তোলে এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্বতা ও তাদের প্রতি শোষণের ধ্বংসাত্মক ক্ষতিকে তুলে ধরেছে। ডিসেম্বরে মারাকেচ রচনাটি ‘নিউ রাইটিং’-এ প্রকাশিত হয়।মারাকেচমূল রচনা: জর্জ অরওয়েলপাশ দিয়ে শবদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মাছির ঝাঁক রেস্তোরাঁর টেবিল ছেড়ে ওটার পিছু নেয়। কয়েক মিনিট পরে তারা আবার ফিরে আসে। নারীবিহীন শবানুগামীদের এই ছোট্ট দলটির সবাই পুরুষ এবং বালক। বিলাপের সুরে অদৃশ্যের নামকীর্তন গাইতে গাইতে নগর-চত্বর জুড়ে থাকা ডালিমের স্তূপ, ট্যাক্সি এবং উটের পালের মধ্যে দিয়ে পথ বের করে নিয়ে তারা এগিয়ে চলে। এখানে শবদেহগুলোর ভাগ্যে কখনোই কফিন জোটে না, মাছিদের কাছে যা সত্যিই লোভনীয়। শবদেহকে কেবল এক টুকরো ন্যাকড়ায় মুড়িয়ে অমসৃন কোনো কাঠের খাটিয়ায় চারজন স্বজনের কাঁধে বহন করা হয়। সমাধিস্থলে পৌঁছে স্বজনরা এক বা দুই ফুট গভীর একটি আয়তাকার গর্ত খুড়ে সেই গর্তে মৃতদেহটি রেখে তার ওপর ভাঙা ইটের মতো ডেলা-পাকানো কিছুটা শুকনো মাটি ছড়িয়ে দেয়। কোনো সমাধিপ্রস্তর বা কোনো নামফলক তো দূরে থাক; কোনো প্রকারের শনাক্তকরণ চিহ্নও থাকে না। সমাধিস্থলটি নিছক একটি পরিত্যক্ত দালানের ভগ্নাবশেষের ন্যায় ঢিবি মাটির এক বিশাল বর্জ্যভূমি। এক বা দুই মাস পরে নিজের আত্মীয়দের কবর কোথায় তা নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারে না।দুই লাখ বাসিন্দার মধ্যে অন্তত বিশ হাজার মানুষ আক্ষরিক অর্থে জীর্ণবস্ত্র পরে বেঁচে আছে। এইরকম একটি শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আপনি দেখতে পাবেন যে, লোকেরা কীভাবে বেঁচে থাকে এবং আর কত সহজে তারা মরেও যায়। বিশ্বাস করা সত্যি কঠিন যে, আপনি মানুষের মাঝে হাঁটছেন। বাস্তবে সেই সত্যের ওপরই সমস্ত ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত। জনতার পিঙ্গলবর্ণ মুখ—এ ছাড়া তারা সংখ্যায়ও অজস্র! ওরা কি সত্যিই আপনার মতো রক্ত-মাংস দিয়ে তৈরি? ওদেরও কি কোনো নাম আছে?নাকি ওরা নিছক এক ধরনের নির্গুণ বাদামিবর্ণ জঞ্জাল, মৌমাছি বা প্রবাল পোকামাকড়ের মতো স্বতন্ত্র? তারা মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে, তারা ঘাম ঝরায়, কতিপয় বছর তারা অনাহারে থাকে এবং একসময় তারা আবার গোরস্থানের নামহীন ঢিবিগুলোতে তলিয়ে যায়। তাদের চলে যাওয়া কেউ লক্ষ্য করে না। এমনকি তাদের কবরগুলোও শিগগিরই আবার মাটিতে মিশে যায়।কখনো কখনো বাইরে হাঁটতে বেরিয়ে কাঁটাযুক্ত নাশপাতি গাছের মধ্য দিয়ে পথ চললে পায়ের তলায় ভীষণ এবড়োথেবড়ো মাটি টের পাওয়া যায়। এই অসমতল পথের একটি নির্দিষ্ট নিয়মিততার ফলে টের পাবেন যে, আপনি প্রাণীদেহের কঙ্কালের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন।গণ-উদ্যানে আমি একটি গজলা-হরিণকে খাওয়াচ্ছিলাম।গজলা-হরিণই মনে হয় একমাত্র প্রাণী যাদের জীবিত অবস্থায় খাদ্যগ্রহণকালীন ভালো দেখায়। বাস্তবে, তাদের পশ্চাদ্ভাগের দিকে তাকালে পুদিনা সসের কথা মনে পড়ে যেতে বাধ্য। আমি যে গজলা-হরিণটিকে খাওয়াচ্ছিলাম; ওটি মনে হয় আমার মনের এই ভাবনাটি জেনে গিয়ে থাকবে। কারণ রুটির টুকরোটি আমি ধরে রেখেছিলাম সত্যি কিন্তু হরিণটি স্পষ্টতই আমাকে পছন্দ করেনি। এটি রুটিতে দ্রুত একটি ঠোকর দিলো, তারপর মাথা নুইয়ে আমাকে ঢুঁ মারতে চেষ্টা করল, তারপর আরেকটি ঠোকর দিলো এবং তারপর আবার ঢুঁ মারল। সম্ভবত ওটার ধারণা ছিল যে, আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারলে রুটিটি অলৌকিক ভাবে শূন্যে ঝুলে থাকবে।কাছাকাছি পথে কাজ করা খাল-খননকারী একজন আরব তার ভারী কোদাল নামিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। সে একধরনের শান্ত বিস্ময়ের সাথে গজলা-হরিণ থেকে পাউরুটির দিকে এবং পাউরুটি থেকে গজলা-হরিণের দিকে তাকাল। তার ভাবটি এমন যেন সে আগে কখনো এরকম কিছু দেখেনি। অবশেষে সে ফরাসি ভাষায় লাজুক স্বরে বলে উঠল:‘আমি যদি রুটিটার একটি টুকরো পেতাম’।আমি রুটির একটি টুকরো ছিঁড়ে তাকে দিলাম। কৃতজ্ঞচিত্তে লোকটি তার ন্যাকড়ার নিচে কোনো গোপন জায়গায় টুকরোটি রাখল। লোকটি স্থানীয় পৌরসভার কর্মচারী।ইহুদিদের বসতির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আপনি মধ্যযুগীয় ইহুদি মহল্লাগুলোর স্বরূপ সম্পর্কে কিছু ধারণা পেয়ে যেতে পারেন। উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার মরক্কোর শাসকদের অধীনে থাকা ইহুদিদের শুধু নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধ এলাকায় জমির মালিকানার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে এভাবে শাসিত হতে হতে তারা ভিড়-ভাট্টা বিষয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করে দিয়েছে। অধিকাংশ রাস্তা ছয় ফুটেরও কম চওড়া, ঘরগুলো একদম জানালাবিহীন। সবখানে মাছির ঝাঁকের মতো অবিশ্বাস্য সংখ্যায় কালশিটে পড়া চোখের শিশুদের দল। রাস্তার মাঝ বরাবর প্রস্রাবের ক্ষুদ্রকায় নদীপ্রবাহ খুবই সাধারণ দৃশ্য।বাজারের ভেতর দিকটায় ইহুদিদের অজস্র পরিবার। সবাই লম্বা কালো আলখাল্লা এবং কালো রঙের ছোট খুলি-টুপি মাথায় দিয়ে মাছি ভনভন করা অন্ধকার গুহার মতো খুপড়িসমূহে কাজ করছে। প্রাগৈতিহাসিক একটি কুঁদকলে আড়াআড়ি পায়ে বসে একজন কাঠমিস্ত্রি বিজলি গতিতে চেয়ারের পায়া ঘুরাচ্ছে। সে তার ডানহাতে একটি ধনুক দিয়ে কুঁদকলটি চালনা করছে এবং বাম পা দিয়ে ছেনিটি চেপে ধরে আছে। সারাজীবন এই একই অবস্থানে বসে থাকার কারণে তার বাম পায়ের আকারই বিকৃত হয়ে গেছে। পাশে বসে থাকা তার ছয় বছর বয়সী নাতিটি ইতোমধ্যেই কাজের সহজতর অংশগুলো রপ্ত করা শুরু করেছে।তাম্রকারের ঝুপড়ি চালার পাশ দিয়ে যাওযার সময় কেউ একজন আমাকে সিগারেট জ্বালাতে দেখে ফেলেছিল। আর সেই মুহূর্তেই চারপাশের অন্ধকার গুহাগুলো থেকে ইহুদিদের একটা উন্মত্ত ভিড় দেখা গেল। তাদের মধ্যে অনেকেই বহতা ধূসর দাড়িওয়ালা বুড়ো দাদু। এরা সবাই একটি সিগারেটের জন্য হাহাকার করছে।এমনকি একটি ঝুপড়ির পেছনের দিকের কোথা থেকে যেন এক অন্ধ লোক সিগারেটের গুজব শুনে হামাগুড়ি দিয়ে শূন্যে হাতড়াতে হাতড়াতে বেরিয়ে এলো। প্রায় এক মিনিটের মধ্যে আমার পুরো প্যাকেটটির সদ্ব্যবহার সম্পন্ন হলো। এই লোকদের মধ্যে কেউই দিনে বারো ঘণ্টার কম কাজ করে বলে আমার মনে হয় না। অথচ এদের প্রত্যেকেই সিগারেটকে কম-বেশি দুরূহ বিলাসিতা হিসাবে গণ্য করে।স্বভাবতই ইহুদিরা স্বয়ংসম্পূর্ণ সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে বাস করে এবং কৃষিকাজ ব্যতিত তারা আরবদের অনুরূপ ধরনের পেশা অবলম্বন করে থাকে। ফল-বিক্রেতা, কুমোর, কামার, রৌপ্যকার, কসাই, চর্মকার, দর্জি, ভিস্তিওয়ালা, ভিক্ষুক, দারোয়ান–যেদিকেই তাকাবেন, ইহুদি ছাড়া আর কাউকেই চোখে পড়বে না। প্রকৃতপক্ষে তাদের সম্প্রদায়ের তেরো হাজার লোক আছে, সবাই মিলে মাত্র কয়েক একর জায়গায় তাদের বাস। এটা সুখবর যে হিটলার এখানে নেই, যদিও সে তার পথেই এগোচ্ছে। কেবল আরবদের কাছ থেকেই নয়, দরিদ্র ইউরোপীয়দের কাছ থেকেও ইহুদিদের সম্পর্কে প্রচলিত তমসাচ্ছন্ন গুজব শোনা যায়।‘হ্যাঁ, মহাশয়, তারা আমার চাকরি কেড়ে নিয়ে একজন ইহুদিকে সেই কাজ দিয়েছে। ইহুদিরা! আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে যে, তারাই এই রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক। তারাই সব অর্থের মালিক। ব্যাংক, অর্থকড়ি সবকিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণে।’আমি বললাম, ‘তবে গড়ে একজন ইহুদি শ্রমিক ঘণ্টায় এক পয়সা মজুরিতে কাজ করে, এটা কি বাস্তব চিত্র নয়?’‘আহা, ওটা শুধু লোক দেখানো বিষয়! তারা সবাই সত্যিকার অর্থে মহাজন। তারা অর্থাৎ ইহুদিরা বড় ধূর্ত।’ঠিক একইভাবে, কয়েকশ বছর আগেও বেচারি বৃদ্ধা নারীদের ডাইনিবিদ্যার অভিযোগে পুড়িয়ে মারা হতো। অথচ তারা নিজেদের জন্য একটি গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহ করতে জাদুটোনায় একদমই অসমর্থ ছিল।দুই হাতে কাজ করা সমস্ত মানুষেরা আংশিকভাবে অদৃশ্য রয়ে যায়। যারা যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন; তারা কম দৃশ্যমান হন। তথাপি সাদা চামড়ার মানুষ সব সময় পুরোপুরি দৃশ্যমান। উত্তর ইউরোপে কোনো শ্রমিককে ক্ষেতে হালচাষ করতে দেখলে আপনি সম্ভবত তাকে কটাক্ষপাতই করবেন। অথচ জিব্রাল্টারের দক্ষিণে বা সুয়েজের পূর্বদিকের উষ্ণ অঞ্চলের কোনো জায়গায় আপনি তাকে ওরকম নজরে দেখবেনই না।আমি এটা বারবার লক্ষ্য করেছি। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের অভ্যন্তরীণ ভূমির দৃশ্যসমূহ অবলোকন করার সময় মানুষের দৃষ্টি মানুষ ব্যতীত আর সব বস্তুকেই দেখে। নীরস মাটি, কাঁটাযুক্ত নাশপাতি বন, পাম-গাছ এবং দূরের পাহাড়শ্রেণী তাদের দৃষ্টিতে এলেও এক টুকরো জমিতে গাইতি চালানো কৃষক সব সময় উপেক্ষিত রয়ে যায়। মেটে রঙের কৃষক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কম আকর্ষণীয় বলে দৃষ্টিতে অধরাই থেকে যায়।এ কারণেই এশিয়া ও আফ্রিকার অনাহারে থাকা অঞ্চলসমূহ পর্যটকদের গন্তব্য সাধারণ্যে স্বীকৃত হয়। সংকটাপন্ন এলাকায় সস্তা ভ্রমণে বের হতে কেউ চাইবে না। কৃষ্ণকায় চামড়ার মানুষগুলো যেখানে বসবাস করে; সেখানে তাদের দারিদ্র্য সহজভাবে ঠাহর করা যায় না। একজন ফরাসি নাগরিকের কাছে মরক্কো মানে কী? একটি কমলা-কুঞ্জ বা সরকারি চাকরির হাতছানি। কিংবা একজন ইংরেজের কাছে মরক্কো মানে কী? উট, প্রাসাদ, তালগাছের সারি, বিদেশি স্বেচ্ছাসেবক সেনাদল, পিতলের বারকোশ এবং দস্যুবাহিনী। বছরের পর বছর এ এলাকায় বসবাস করার পরও হয়তো এখানকার নয়-দশমাংশ মানুষের জীবনের বাস্তবতা দৃষ্টিগোচর না-ও হতে পারে। অনুর্বর ভূমি থেকে সামান্য খাদ্য উৎপাদনের তরে তারা অবিরাম হাড়ভাঙা খাটুনির লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।মরক্কোর অধিকাংশ এলাকা এতটাই ঊষর যে, খরগোশের চাইতে বড় কোনো বন্যপ্রাণী বেঁচে থাকা দুষ্কর। একসময় ঘন বনাঞ্চল আচ্ছাদিত বিশাল এলাকাগুলো বৃক্ষহীন আবর্জনায় পরিণত হয়েছে, এখানে মাটি অবিকল ভাঙা ইটের বর্জ্যের মতো। তা সত্ত্বেও ব্যাপক এলাকাজুড়ে ভয়াবহ শ্রমসাধ্য চাষাবাদ হয়। চাষাবাদের ক্ষেত্রে কৃষকের দুই হাতই প্রধান অবলম্বন।ফসলের মাঠজুড়ে সারিবদ্ধ নারীরা ধীরে ধীরে কাজ করে চলেছে। ইংরেজি বড় হাতের বর্ণমালার উল্টে থাকা এল-এর ন্যায় দ্বিগুণ নুয়ে পড়ে তারা হাত দিয়ে কাঁটাযুক্ত আগাছা উপড়ে ফেলছে। তারা চাষিদের গৃহপালিত প্রাণিদের খাবার জোগানের তরে রোপিত জমির উর্বরতা বৃদ্ধিকারী ত্রিপত্রবিশিষ্ট উদ্ভিদগুলোকে কাটার পরিবর্তে টেনে ছিড়ে নিচ্ছে। প্রতিটি ডাঁটা থেকে এক বা দুই ইঞ্চি টেনে ছিড়ে নিয়ে তারা সংরক্ষণ করছে। কাঠের তৈরি হতচ্ছাড়া লাঙলটি এতটাই পলকা, যে কেউ এটিকে সহজেই কাঁধে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। লাঙলটির নিচের দিকের রুক্ষ লোহার তীক্ষ্ণ ফলাটি মাটিকে প্রায় চার ইঞ্চি গভীরে চিরে ফেলে। পশুদের যতটুকু শক্তি ততখানি গভীরেই চাষ হয়। একই জোয়ালে একটি গরু এবং একটি গাধাকে বেঁধে চাষ দেওয়া এখানকার নৈমিত্তিক দৃশ্য। চাষ দেওয়ার জন্য দুটি গাধা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। কিন্তু অন্য বিবেচনায় দুটি গরু পালন একটু বেশিই ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। কৃষকদের নিজস্ব কোনো মই নেই। জমিকে তারা কেবল বিভিন্ন দিকে কয়েকবার চাষ করার পর সেটিকে অসমতল হলরেখা অবস্থায় ফেলে রাখে। তারপর জল সংরক্ষণের জন্য পুরো জমিটিকে কোঁদালের সাহায্যে ছোট ছোট আয়তাকার টুকরোতে ভাগ করে। কৃষিকাজের জন্য পর্যাপ্ত জলের বন্দোবস্ত নেই, বিরল বৃষ্টি-ঝড়ের পর দু-এক দিনের তরে জলের দেখা মেলে। নিম্নবর্তী ভূস্তরের গভীর থেকে চুঁইয়ে আসা জল ধরে রাখার উদ্দেশ্যে চাষের জমিগুলোর প্রান্ত বরাবর ত্রিশ বা চল্লিশ ফুট গভীরতার খাল কেটে রাখা হয়েছে। রোজ বিকেলে আমার বাড়ির সামনের রাস্তাটি দিয়ে অতিবৃদ্ধ নারীদের সারিবদ্ধ একটি দল যায়। তাদের প্রত্যেকের পিঠে থাকে জ্বালানি কাঠের বোঝা। আকারে অতি ক্ষুদ্র এই নারীদের সবাই বয়সের ভারে এবং রৌদ্রের তাপে যেন মমি হয়ে আছে। এ রকমটি সাধারণত আদিম জনসমাজে দেখা যায় যে, নারীরা একটি নির্দিষ্ট বয়স অতিক্রম করার পর শিশুদের আকারে সঙ্কুচিত হয়ে যায়। একদিন এরকম অনধিক চার ফুট দৈর্ঘের এক অসহায় বৃদ্ধা বিশাল কাঠের বোঝা পিঠে নিয়ে আমার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। আমি তাকে থামালাম এবং তার হাতে একটি পাঁচ সৌ (এক পেনির এক চতুর্থাংশের একটু বেশি) মুদ্রা রাখলাম।তিনি আনন্দের উচ্ছাসে, প্রায় চিৎকার দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। তবে ওটা ছিল আংশিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কিন্তু প্রধানত তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। তার দৃষ্টিকোণ থেকে আমার ধারণা, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার ফলে আমি হয়তো প্রকৃতির কোনো আইন লঙ্ঘন করে ফেলেছি। জনৈক বৃদ্ধা নারী হিসেবে তিনি নিজের অবস্থানকে মেনে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ বোঝাবহনকারী প্রাণী হিসেবে। একটি পরিবার ভ্রমণে বের হলে দেখা যায়, একজন বাবা এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে গাধার পিঠে করে ভ্রমণে যাচ্ছেন। পাশেই একজন বৃদ্ধা নারী পায়ে হেঁটে, মালপত্তর টেনে নিয়ে চলেছেন। কিন্তু এই মানুষদের অদৃশ্যতা বড় অদ্ভুত। বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে দিনের প্রায় একই সময়ে সারিবদ্ধ বৃদ্ধা নারীরা তাদের জ্বালানি কাঠ নিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যেত। তারা আমার চোখের দৃষ্টি আকড়ে থাকলেও আমি সত্যিই বলতে পারি না যে, আমি তাদের কতটুকু দেখতে পেয়েছি। চলমান জ্বালানি কাঠ আমাকে পেরিয়ে যাচ্ছিল, আমি এটাই দেখেছিলাম। একদিন আমি তাদের পশ্চাতে হাঁটছিলাম এবং সেই মুহূর্তে জ্বালানিকাঠের বোঝাগুলোর কৌতূহলী ওঠা-নামা চোখে পড়তেই ওগুলোর নিচে মানব দেহগুলো নজরে এলো। তারপর প্রথমবারের মতো আমি মেটে রঙের অসহায় বৃদ্ধ দেহগুলো লক্ষ্য করলাম। দেহগুলো অস্থিচর্মসার হয়ে গেছে, বিপর্যয়কর ওজনের নিষ্পেষণে দ্বিগুণ নুয়ে পড়েছে!তবুও আমার মনে হয়, মরক্কোর মাটিতে পা রাখার পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই আমি গাধার পিঠে মাত্রাতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিতে দেখে যারপরনাই রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠেছি। এখানকার গাধাদের সাথে প্রশ্নাতীত জঘন্য আচরণ করা হয়ে থাকে। মরোক্কার গাধাটি আকারে সেইন্ট বার্নার্ড জাতের কুকুরের চেয়ে অল্প একটু বড়। এর পিঠের বোঝাটি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পাঁচ ফুট উঁচু খচ্চরের জন্যও মাত্রাধিক বলে মনে হবে। প্রায়ই এর পিঠে বাঁধা মালবাহী জিনটি কয়েক সপ্তাহ ধরে খোলাই হয় না। এ ধরনের বিষয় দেখে যে কোনো মানুষেরই রক্ত টগবগ করে উঠবে। পক্ষান্তরে সর্বোপরি মানুষের দুর্দশা দেখলে সেরকমটি হয় না। আমি কোনো মন্তব্য করছি না, নিছক একটি বাস্তবতাকে ইঙ্গিত করছি মাত্র। পিঙ্গল বর্ণের মানুষেরা অদৃশ্যের কাছাকাছি পর্যায়ে অবস্থান করে। যে কোনো মানুষই গাধাটির পিঠে দগদগে ক্ষত দেখে ব্যথিত হতে পারে কিন্তু কোনো দৈবঘটনা না ঘটলে কাঠের বোঝার তলে থাকা বৃদ্ধাকে কারো চোখে পড়ে না।সারস পাখিরা উত্তরে উড়ে যাওয়ার সাথে সাথে দীর্ঘ ধূলিধূসর যানবাহনের সারি, পদাতিক যোদ্ধা, সারিবদ্ধ কামান নিয়ে নিগ্রোরাও কুচকাওয়াজ করতে করতে দক্ষিণ দিকে এগোচ্ছিল। তারপরে আরও চার বা পাঁচ হাজার পদাতিক বুটের তলা এবং লোহার চাকার ঝনঝন শব্দে রাস্তা দখল করে নিয়েছিল।তারা ছিল সেনেগালিজ, আফ্রিকার সবচাইতে কালো নিগ্রো। তারা এতটাই কালো যে, তাদের ঘাড়ের কোন্ অংশ থেকে চুল শুরু হয়েছে সেটি বোঝা দায়। বাজারি খাকি কাপড়ের উর্দিতে ঢাকা ছিল তাদের জমকালো শরীর। কাষ্ঠখণ্ডের মতো দেখতে বুটজুতোর ভেতর তাদের পাগুলো গাদাগাদি করে ঢুকিয়েছিল। তাদের প্রতিটি টিননির্মিত শিরস্ত্রাণকে বেশ প্রয়োজনের তুলনায় ছোট আকারের বলে মনে হচ্ছিল। খুব গরম তাপমাত্রা ছিল এবং জওয়ানরা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছিল। তারা তাদের বাক্স-পেটরার ওজনের নিচে গৌণ হয়ে পড়েছিল এবং অদ্ভুত সংবেদনশীল কৃষ্ণাঙ্গ মুখগুলো ঘামে চকচক করছিল।যখন তারা পার হয়ে যাচ্ছিল; তখন একজন দীর্ঘদেহী খুব তরুণ বয়সী নিগ্রো আমার নজরে পড়ল। কিন্তু সে আমার পানে যে রকম নজরে তাকাল সেটি ন্যূনতম প্রত্যাশিত নয়। শত্রুতাপরায়ণ নয়, অবজ্ঞাসূচকও নয়, গোমড়া-মুখো নয়, এমনকি জিজ্ঞাসুও নয়। তার তাকানোটি ছিল লাজুক, যেটি ছিল মূলত প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় তাকানো পটলচেরা চোখের নিগ্রো চাহনি। চেয়ে চেয়ে আমি দেখলাম। এই হতভাগ্য ছেলেটি একজন ফরাসি নাগরিক, তাই মেঝে ঘষতে এবং সেনানিবাস শহরে উপদংশ রোগিকে পাকড়াও করার জন্য জঙ্গল থেকে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আসলে শ্বেতাঙ্গ মানুষের প্রতি তার শ্রদ্ধাজ্ঞাপক অনুভূতি রয়েছে। তাকে শেখানো হয়েছে যে, শ্বেতাঙ্গ জাতি তার প্রভু এবং সে এখনো এটাই বিশ্বাস করে।একজন কৃষ্ণাঙ্গ সৈনিককে কুচকাওয়াজ করতে দেখলে প্রতিটি শ্বেতাঙ্গ মানুষ মনে মনে একটি ধারণা পোষণ করে। এ ক্ষেত্রে সে নিজেকে সমাজতান্ত্রিক মানুষ বলে পরিচয় দিলেও তাতে দুই পয়সার মূল্য নেই। ‘আর কতদিন ধরে আমরা এই মানুষদের নিয়ে তামাশা করতে পারি? আর কতটা সময় পার হলে পর তারা তাদের বন্দুক অন্য দিকে তাক করবে?’ সত্যিই এটি কৌতূহলের বিষয় ছিল। সেখানকার প্রতিটি শ্বেতাঙ্গ মানুষের মনের মধ্যে কোথাও না কোথাও ভাবনাটি বদ্ধমূল। আমারও ছিল, সমকালীন অন্যান্যদেরও ছিল, উপনিবেশের তরে গলদঘর্ম অফিসারদের এবং বিভিন্ন পদমর্যাদায় কাজ করা শ্বেতাঙ্গ নন-কমিশন্ড অফিসারদেরও ছিল। এটা ছিল এমন এক ধরনের গোপনীয়তা, যা আমরা সবাই জানতাম এবং বলার ক্ষেত্রে চতুর ছিলাম। শুধু নিগ্রোরাই তা জানতো না। আর সত্যিই প্রায় গবাদিপশুর পালের ন্যায় দেখতে এক বা দুই মাইল দীর্ঘ সারিতে সশস্ত্র জওয়ানরা সড়কে শান্তিপূর্ণভাবে কুচকাওয়াজে ব্যস্ত। ঠিক তখনই বিশাল সাদা পাখিগুলো কাগজের টুকরোর ন্যায় জ্বলজ্বল করতে করতে তাদের ওপর দিয়ে উল্টো দিকে উড়ে যাচ্ছে।(নিউ রাইটিং, নতুন সিরিজ নং-৩, ক্রিসমাস ১৯৩৯। অরওয়েলের মরক্কো ডায়েরি অবলম্বনে)

এসইউ/এএসএম

Advertisement