কালের বিবর্তনে ঈদ উপলক্ষে কোরবানির পশু হাটে আনা নেওয়ায় এসেছে ভিন্নতা। আগে গরুর গলায় রঙিন কাগজের মালা পরিয়ে, গলার রশি ধরে ক্রেতা-বিক্রেতারা হেঁটে গরু আনা নেওয়া করতেন। তবে সময়ের ব্যবধানে বদলে গেছে সেই পুরোনো চিত্র। বর্তমানে কোরবানির হাটের অধিকাংশ পশুই পরিবহন করা হয় ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে। ফরিদপুরে কোরবানির পশু বহনে কদর বেড়েছে পিকআপ-মিনিট্রাক ও নসিমন-করিমনের।
Advertisement
ক্রেতা-বিক্রেতারা এক হাট থেকে অন্য হাটে ছুটছেন। অনেকে নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য উপজেলার হাটে গিয়েও গরু-ছাগল কিনছেন। আর কোরবানির সেই পশু বাড়িতে নেওয়ার জন্য ভাড়া করছেন মিনি পিকআপ, মিনি ট্রাক, নসিমন-করিমন গাড়ি। এসব গাড়ির মধ্যে নসিমন-করিমন সাধারণত গ্রামের রাস্তায় চলাচল করে। শহরে চলে পিকআপ ও মিনি ট্রাক।
কোরবানির ঈদ উপলক্ষে বাড়তি আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন পিকআপ-মিনিট্রাক ও নসিমন-করিমনের মালিক ও শ্রমিকরাও। ফলে চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন এসব পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা। হাটবাজারে পশু বহনে বেশ কদর বেড়েছে তাদের। ঝামেলামুক্ত আর স্বল্প সময়ে পশু আনা নেওয়া করতে পারায় ক্রেতা-বিক্রেতারাও খুশি। তবে সুযোগ বুঝে বাড়তি ভাড়া হাতানোরও অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
বিভিন্ন হাট ঘুরে দেখা যায়, ঈদুল আজহা উপলক্ষে ফরিদপুরে জমে উঠেছে পশু কেনা-বেচার স্থায়ী-অস্থায়ী হাট। সকাল থেকেই বিভিন্ন সাইজের গরু-ছাগল হাটে তুলছেন বিক্রেতারা। পছন্দের পশু কিনে বাড়ি ফিরছেন ক্রেতারা। এসব হাট থেকে কোরবানির গরু কিনে ক্রেতারা খুঁজতে থাকেন পিকআপ-মিনিট্রাক ও নসিমন-করিমন। গরুর সাইজ অনুযায়ী এসব পরিবহন প্রয়োজন হয়।
Advertisement
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় ৯টি উপজেলায় মোট ৪০টি স্থায়ী গরুর হাট রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে অস্থায়ী হাট বসেছে। এবার ফরিদপুরে কোরবানির জন্য পশুর চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ৮ হাজারের বেশি। ৯টি উপজেলায় ৮ হাজার ১৭৮টি ছোট-বড় খামার ও কৃষকের গোয়ালে এর থেকে আরও ৩ হাজার বেশি পশু বিক্রির জন্য রয়েছে। কোরবানির ঈদে জেলায় মোট ৫১ হাজার ১৬৭টি গরু, ৫৪ হাজার ৯২৫টি ছাগল, ৪ হাজার ৫৯৭টি ভেড়া ও ১০৫টি মহিষ প্রস্তুত রয়েছে।
সালথা হাটে গরু কিনতে আসা বারিক শেখ বলেন, হাটে এসেছি কোরবানির গরু কিনতে। এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছি। এখান থেকে বাড়ির দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। এত দূরে গরুর দড়ি ধরে হেঁটে যাওয়া খুবই কষ্টকর। গরু বহন করার জন্য একটা নসিমন ভাড়া করেছি। এতে খরচ হলেও ঝামেলা ও কষ্ট ছাড়াই গরুটি বাড়িতে নিতে পারবো।
আরেক ক্রেতা শরিফুল ইসলাম বলেন, সহস্রাইল হাট থেকে একটি গরু কিনেছি। গরুটিকে হাঁটিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিতে অন্তত সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময় লাগতো। এরজন্য দুই-তিনজন লোকেরও প্রয়োজন হতো। সেখানে অল্প ভাড়ায় মিনি পিকআপে মাত্র আধা ঘণ্টায় গরু নিয়ে বাড়ি পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আলফাডাঙ্গার গোপালপুর হাটের গরু ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, যানবাহনে করে পশু পরিবহনে বেশ সুবিধা আছে। এক হাটে গরুর দাম ভালো পাওয়া না গেলে পরিবহনে করে দ্রুত অন্য হাটে নিয়ে যাওয়া যায়। তাছাড়া পশুগুলোর কষ্ট হয় না। আবার একসঙ্গে অনেক পশু বহন করা যায়।
Advertisement
গরুর খামারি ও ব্যবসায়ী মনির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমার খামারে ছোট বড় মিলিয়ে ১২টি গরু আছে। আশপাশের হাটে তেমন দাম পাওয়া যায় না। তাই প্রতিবছর ট্রাক ভাড়া করে গাফিলতির হাটে নিয়ে যাই। কয়েকশো কিলোমিটার পথ গরু নিয়ে হেঁটে যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। শুধু আমি নই, আমার মতো খামারি ও ব্যবসায়ীদের জন্য পিক-আপ, ট্রাকই একমাত্র ভরসা। আর এসময় নসিমন-করিমন, পিকআপ, মিনি ট্রাকের মালিক ও চালকদের কদর ও ব্যস্ততা বেড়ে যায়।
মিনি ট্রাকের মালিক বাবুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমার দুইটি মিনি ট্রাক আছে। সারা বছর ভাটা থেকে ইট বহনের কাজ করি। গত ১৫ দিন ধরে দিনরাত মিলে বিভিন্ন স্থানে কোরবানির গরু আনা-নেওয়ার কাজ করছি। এতে চালকেরও বাড়তি লাভ হচ্ছে, আমিও ভালো ভাড়া পাচ্ছি।
নগরকান্দা উপজেলার বড় কাজুলী গ্রামের বাসিন্দা নসিমন চালক হাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কোরবানির গরু আনা নেওয়ার জন্য নসিমনে লোহার খাঁচা তৈরি করেছি। তাতে বড় সাইজের দুটি গরু,আর ছোট সাইজের চারটি গরু বহন করা যায়। দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া। প্রতিদিন ৪/৫টি ট্রিপ হয়। তাতে গড়ে প্রতিদিন হাজার পাঁচেক টাকা আয় হচ্ছে। ঈদের দিন পর্যন্ত এ কাজ করতে পারবো।
পিকআপ চালক রুহুল শেখ বলেন, বিভিন্ন হাটে গরু আনা নেওয়ার কাজ করছি। ঈদের সামনে আর অন্য কোনো কিছু বহন করি না। ঈদ পর্যন্ত পশু আনা-নেওয়ার কাজে ব্যস্ত আছি। ঈদের পর আবার স্বাভাবিকভাবে অন্য মালামাল বহন করবো।
তিনি বলেন, প্রতিদিন গড়ে ৫-৬টি ভাড়া পাচ্ছি। গরু ক্রেতা কিংবা বিক্রেতা সবাই এখন গাড়িতে করেই গরু আনা নেওয়া করে থাকেন। এতে করে ঈদের আগে বাড়তি আয়ের সুযোগ হচ্ছে। গরু প্রতি হাট বা রাস্তার দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া। সেক্ষেত্রে সর্বনিম্ন পাঁচশ থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হয়।
শহরের টেপাখোলা এলাকার পশুর হাটের পাশে মিনি ট্রাক নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সদর উপজেলার কানাইপুরের বাসিন্দা মো. নুরইসলাম মোল্লা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, দূরত্ব একটু বেশি হলে মানুষ এখন আর হাঁটিয়ে পশু বাড়ি নিতে চায় না। সেক্ষেত্রে মিনি পিকআপ, নসিমন-করিমনই বেছে নেন। এতে ক্রেতারা কম ভাড়ায় এবং অল্প সময়ে গরু-মহিষ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারেন। ৮০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০০ ও ৩০০০ টাকা পর্যন্ত ভাড়া। তারপরও গরুর আকার ও দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। গড়ে প্রতিদিন ৩-৪টি ট্রিপ দিই।
টেপাখোলা হাটের ইজারাদার এম এ সালাম লাল মিয়া বলেন, ঈদ উপলক্ষে প্রতিহাটে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার গরুর আমদানি হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো, বিধায় মানুষ এ হাটে বেশি ভিড় করে। জেলা ছাড়াও আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে ক্রেতা-বিক্রেতারা আসেন। গরু বিক্রেতারাতো আছেই, এ হাট থেকে গরু কেনা কমপক্ষে ৮০ ভাগ ক্রেতা পিকআপ, ছোট ট্রাক, নসিমন-করিমনে গরু বহন করে থাকে। এতে সময় কমের পাশাপাশি শ্রমও বাঁচে।
ফরিদপুর পিকআপ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক জাগো নিউজকে বলেন, জেলায় প্রায় ৬০০ পিকআপ আছে। এছাড়া মিনি ট্রাকের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। ঈদ উপলক্ষে এসব গাড়িগুলোর চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। কোরবানির পশু আনা নেওয়ায় ব্যস্ত সময় পার করছে চালকরা। দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া। তবে এসব গাড়ির জন্য বাড়তি কোনো চাঁদা দিতে হয় না। প্রশাসনের কোনো ঝামেলা নেই। পশু ক্রেতা-বিক্রেতারা খুব সহজে এসব গাড়িতে কোরবানির পশু বহন করতে পারছেন।
এফএ/এএসএম