মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী কূটনীতি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘স্মার্ট ওয়ার’ নীতি— সব মিলিয়ে এক জটিল ভূরাজনৈতিক নাট্যমঞ্চের জন্ম হয়েছে, যার প্রেক্ষাপটে কিছুটা হলেও বদলে গেছে আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভাষা ও কৌশল।
Advertisement
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা সিদ্ধান্তে ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) থেকে সরে দাঁড়ায় ট্রাম্প প্রশাসন। সেসময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ইরানের সাথে যে পরমাণু চুক্তি করা হয়েছে সেটি বজায় থাকলে দেশটি পারমাণবিক শক্তি অর্জন করবে। তিনি বলেন, এ ধরনের চুক্তি কখনোই করা উচিত হয়নি। এর পরপরই শুরু হয় চাপে রাখার কৌশল—‘ম্যাক্সিমাম প্রেশার ক্যাম্পেইন’। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, সোলাইমানি হত্যাকাণ্ড এবং ইরানের সামরিক ঘাঁটিতে হামলার মতো পদক্ষেপে ট্রাম্প ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েল মনে করেছিল, ইরান হয়তো ভেঙে পড়বে—লিবিয়া কিংবা ইরাকের মতো।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ইরান ছিল প্রস্তুত। যুদ্ধের প্রথম ধাক্কা সামলে ইরান কৌশলী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা এবং আঞ্চলিক প্রভাব ব্যবস্থাপনার নেপথ্যে ছিল দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং এক আঞ্চলিক জোট, যা ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনের হুথি মিলিশিয়াদের অন্তর্ভুক্ত করে গড়ে উঠেছে। আর সেজন্যই হয়তো ট্রাম্পের ইরানে ইউরেনিয়াম ধ্বংসের স্বপ্ন, বাস্তবতার কাছে শেষ পর্যন্ত ইউটার্ন নিতে বাধ্য হয়। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানকে ‘অ্যামেচার থিয়েটারে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির’ চেষ্টা করা রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিশ্লেষকরাও জানতেন—ইরাক নয়, ইরান একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রযন্ত্র এবং কঠিন ভূরাজনৈতিক অবস্থানে থাকা দেশ। একে দমন করা অতটা সহজ নয়।
পরিস্থিতি যখন ভয়াবহতার দিকে যাচ্ছিল, তখন নিজেই যুদ্ধবিরতির বার্তা দিলেন ট্রাম্প। কারণটা স্পষ্ট—হরমুজ প্রণালির মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ দিয়ে তেল সরবরাহ বন্ধ হলে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্ব অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হতো। তেল ও গ্যাসের দাম লাগামছাড়া হয়ে গেলে তা বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারত। এই বাস্তবতা ট্রাম্পও বুঝেছিলেন—শুধু ব্যবসায়ী হিসেবেই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবেও।
Advertisement
এদিকে ইসরায়েলের জন্য পারমাণবিক ইরান এক দুঃস্বপ্ন। কারণ, ইরান যদি সত্যিই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তবে তা ইসরায়েলের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ আশঙ্কা থেকেই ইসরায়েল চায় ইরানে রেজিম পরিবর্তন। কিন্তু ইরান নিজেকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যেখানে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ আর সহজ নয়। বরং তা ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে—মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধ তা-ই দেখিয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বকে ।
সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ দেখেছে ইরানকে, দেশটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে, অন্যদিকে মুসলিম বিশ্ব এতে একটা অভ্যন্তরীণ বার্তা পেয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস করতে হয় । মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন মিত্র রাষ্ট্রগুলো—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন প্রমুখ—যারা এতদিন আমেরিকার ছায়াতলে নিজেদের নিরাপদ রেখেছিল, তারা এখন ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে নিজেদের ভীত-সন্ত্রস্ত মনে করবেই। ইরান যে শুধু সামরিক নয়, কৌশলগত ও রাজনৈতিকভাবেও শক্তিশালী, সেটা আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইরানে রেজিমবিরোধী বিক্ষোভ যতই থাকুক না কেন, সাধারণ মানুষও বিদেশি হামলার বিপক্ষে। যুদ্ধ কোনো দিন শান্তি বয়ে আনে না—সে শিক্ষা তারা পেয়েছে প্রতিবেশী ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ার কাছ থেকে। সেই কারণেই, অভ্যন্তরীণ গণ-আন্দোলনের মধ্যেও ইরানের জনগণ সামগ্রিকভাবে বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকে।
এই সাম্প্রতিক সংঘর্ষ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় একটি বিষয় মোটা দাগেই আমরা লিখে রাখতে পারি—জাতীয় নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা ছাড়া আর কিছুই জনগণের মূল আকাঙ্ক্ষা নয়। জনগণ চায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা। ধর্ম, মতাদর্শ বা আধিপত্যবাদ—এসব বড় কথা যতই উচ্চারিত হোক না কেন, নিরাপত্তাহীনতা যখন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়, তখন জনগণের কাছে সব মতাদর্শই পরাজিত হয়। ইহুদিবাদ হোক বা ইসলামী বিপ্লব—জনগণ নিরাপদ জীবন চায়। আর সেই চাহিদা মেটাতে হলে যুদ্ধ নয়, প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি ও স্বকীয় প্রতিরক্ষা সক্ষমতা।
Advertisement
লেখক : ব্রিটেনপ্রবাসী কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম