প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। একই সঙ্গে ঘাটতি বাজেট মেটাতে গত বছরের থেকে বেশি মাত্রায় ব্যাংক নির্ভর হওয়া একটি নেতিবাচক দিক বলে জানায় সংগঠনটি।
Advertisement
সোমবার (২ জুন) বাজেটপরবর্তী তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা জানান ঢাকা চেম্বার সভাপতি তাসকীন আহমেদ।
তিনি বলেন, ঘাটতি বাজেট মেটাতে গত বছরের থেকে বেশি মাত্রায় ব্যাংক নির্ভর হওয়া একটি নেতিবাচক দিক। বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে করজালের আওতা বাড়িয়ে রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের আয়কর হিসেবে বিয়োজনের পরিমাণ সাড়ে ৪ লাখ টাকা হতে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করা হয়েছে। আয়করের জন্য প্রসপেকটিভ করের বিধান চালু করা হয়েছে। কিন্তু ৫ শতাংশ স্ল্যাব তুলে দেওয়া এবং শুরুতে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে পরবর্তী ৩ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ করারোপ করা হয়েছে। ব্যক্তি করদাতার গ্রস প্রাপ্তির ওপর ০.২৫ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ টার্নওভার কর নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে ঢাকা চেম্বার জানায়, মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকট বিবেচনায় করমুক্ত আয়ের সীমা অপরিবর্তিত রাখা হতাশাজনক। আমরা করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লাখ টাকা করার দাবি করছি। আয়কর হিসেবে বিয়োজনের পরিমাণ বৃদ্ধি করাকে ইতিবাচক মনে করছি। প্রসপেকটিভ করের বিধান ইতিবাচক, তবে কর স্ল্যাবে পরিবর্তন মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবীদের ওপর করের বোঝা বৃদ্ধি পাবে। টার্নওভার করের হার বৃদ্ধি করায় ব্যক্তিশ্রেণির করহার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
Advertisement
করপোরেট কর নিয়ে ডিসিসিআই জানায়, ব্যক্তিশ্রেণির পাশাপাশি কোম্পানি করদাতাদের অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোম্পানির অনুমোদনযোগ্য বিয়োজনের আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। টার্নওভার কর ০.৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। অনলাইনে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করার ঐতিহাসিক উদ্যোগ ও অনুমোদনযোগ্য বিয়োজনের আওতা বৃদ্ধির জন্য সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এতে করে ব্যবসায়ীরা কর প্রদানে কিছুটা স্বস্তি পাবেন বলে আশা করছি। টার্নওভার কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে আমরা পুনর্বিবেচনার দাবি করছি।
মূসক নিয়ে ডিসিসিআই জানায়, প্রয়োজনীয় ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনে মূসক হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। মোবাইল ফোন তৈরিতে ভ্যাট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ সসব ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে স্থানীয় শিল্প ঝুঁকিতে পড়তে পারে। এই প্রস্তাবকে পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।
অগ্রিম কর ও উৎসে কর নিয়ে ঢাকা চেম্বার জানায়, শিল্পখাতে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপর ৩ শতাংশ আগাম কর কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। ন্যূনতম করের কারণে কোনো করদাতা নিয়মিত করের যে পরিমাণ অতিরিক্ত কর প্রদান করবে তা পরবর্তী করবর্ষসমূহে সমন্বয় করার সুযোগ রাখা হয়েছে। করমুক্ত প্রায় ১৫২টি পণ্যের ওপর আমদানি পর্যায়ে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ করা হয়েছে।
তাসকীন আহমেদ বলেন, আগাম কর কমানোর ফলে ব্যবসায়ীদের কার্যকর মূলধন বৃদ্ধি পাবে। ন্যূনতম কর ভবিষ্যতে সমন্বয় করার সুযোগ থাকায় ব্যবসায়ীদের খরচ কমবে। আমদানি পর্যায়ে করমুক্ত পণ্যের ওপর ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপকে আমরা ভালো মনে করছি না। এতে করে ব্যবসায়ের কার্যকরী মূলধন কমে যাবে।
Advertisement
স্থানীয়, আমদানি ও রপ্তানিমুখী শিল্প নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়, বাজেটে শুল্ক ও কর কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমদানি শুল্কে একটি নতুন ৩ শতাংশ স্তর যুক্ত হওয়া এবং সম্পূরক শুল্কে ৪০ শতাংশের একটি নতুন স্তর যোগ করা হয়েছে। দেশীয় সফটওয়্যার রপ্তানি উৎসাহিত করতে প্রযুক্তিপণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। দেশীয় টেক্সটাইল মিলে উৎপাদিত প্রতি কেজি কটন সুতা ও ম্যান মেইড ফাইবারে তৈরি সুতার সুনির্দিষ্ট কর ৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করা হয়েছে।
‘সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যারহাউস’ ও ‘ফ্রি জোন বন্ডেড ওয়্যারহাউস’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের এককালীন বন্ডিং ক্যাপাসিটির বিদ্যমান প্রাপ্যতা এক-তৃতীয়াংশ হতে বৃদ্ধি করে অর্ধেক করা হয়েছে। আমদানি পণ্যের শুল্ক-কর পর্যায়ক্রমে হ্রাস করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সংলাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ৬২৬ পণ্যের সিডি (কাস্টমস ডিউটি) সম্পূর্ণ প্রত্যাহার ও হ্রাস এবং এসডি (সম্পূরক শুল্ক) সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার এবং হ্রাস করা হয়েছে। অটোমোবাইল খাতের বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশের আমদানিতে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে ঢাকা চেম্বারের অবস্থান
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ২২ হাজার ৫২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ০.৮১ শতাংশ কম। গ্যাস বিতরণে নিযুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তনের হার ২ শতাংশের স্থলে ০.৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এলএনজির আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। যেহেতু বিদ্যুতের প্রায় ৬৫ শতাংশ গ্যাস নির্ভর, সেহেতু স্থানীয় পর্যায়ে আমাদের প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। এলএনজির আমদানি পর্যায়ে গ্যাসের উৎসে কর কমানোর ও ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে শিল্প, বিদ্যুৎ ও পরিবহন খাতে ব্যয় কমাতে সহায়ক হবে, তবে তা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধান নয়। আমরা জ্বালানি খাতের বাজেটে অফ-শোর ও অন-শোর উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ ও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করছি। পক্ষান্তরে বিদ্যুৎ খাতের বাজেট বরাদ্দ কমানোর দাবি করছি।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে ৮২ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। গত বছর এ বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা। শিক্ষাখাতের এই বাজেট বৃদ্ধি, উৎপাদন ও কর্মমুখী শিক্ষা বিস্তারের জন্য সহায়ক হবে। এ বরাদ্দ গবেষণা ও উন্নয়ন আরও বেশি ব্যয় করা প্রয়োজন বরে জানায় ঢাকা চেম্বার।
কৃষি ও সিএসএমএসএমই
ঢাকা চেম্বার জানায়, স্বাভাবিক ব্যক্তির ‘কৃষি হইতে আয়’ অনধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত করমুক্ত রাখা হয়েছে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে মূসক বা টার্নওভার কর দাখিলপত্র পেশ না করার ব্যর্থতা বা অনিয়মে জরিমানার হার ৫ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার টাকা করা হয়েছে। এসএমই উন্নয়নে ১৫ হাজার নতুন উদ্যোক্তা তৈরি এবং ২৫ হাজার উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
কৃষি উৎপাদনকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি করা ইতিবাচক পদক্ষেপ। জরিমানার হার কমানো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সুবিধা প্রদান করবে, জরিমানা প্রদান না করতে পারলেও পরবর্তী মাসের রিটার্ন/জিরো রিটার্ন জমা প্রদান করার সুযোগ রাখার জন্য প্রস্তাব করছি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, চলমান বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সংকটকালে আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বিভিন্ন খাতের কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হলেও সিএসএমএসএমইয়ের জন্য কোনো রোডম্যাপ নেই, যা নেতিবাচক প্রভাব রাখবে।
ইএআর/ইএ/এএসএম