মো. কামরুল হাসান হৃদয়
Advertisement
পৃথিবীর সব সৌন্দর্য যদি এক মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়ায়, তবে তা হয়তো চর আব্দুল্লাহর মতো এক অপার্থিব জায়গায় থেমে থাকবে। নিঃশব্দ, মুগ্ধকর প্রাকৃতিক রূপের আবাস, যেখানে বাতাসও যেন মধুর গীত গায়। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর আলেকজান্ডারের দক্ষিণে মেঘনার পানিতে জন্ম নেওয়া এই সবুজ টিলা এখন আর শুধুই একটি চর নয়—এটি হয়ে উঠেছে প্রকৃতিপ্রেমীদের স্বপ্নের ঠিকানা। কেউ তাকে অভিহিত করছেন ‘গরিবের কাশ্মীর’, কেউ আবার ডাকার চেষ্টা করছেন ‘উপকূলের সুইজারল্যান্ড’ নামে।
সবুজে মোড়া একখণ্ড স্বর্গচর আব্দুল্লাহ যেন মেঘনার বিশাল জলরাশির বুকে ভাসমান এক শান্ত দ্বীপ। যেখানে নেই শহরের কোলাহল, নেই মানুষের ভিড়—রয়েছে প্রকৃতির স্নিগ্ধ ছায়া আর নীরবতায় ভরা নিসর্গের মায়াজাল। পাখির কিচিরমিচির, দূরে দূরে পশুদের নির্বিঘ্ন গমনাগমন আর নদীর হাওয়ায় দুলতে থাকা লম্বা লম্বা চরজোড়া ঘাস, যা প্রকৃতির এক অপূর্ব ছন্দ সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে কাঠের তৈরি উঁচু মাচা ঘর, যেখানে রাখালরা বসে থাকেন। তারা প্রাণীদের নিরাপত্তা ও সুস্থতা রক্ষায় নিয়োজিত। এই ঘরের চারপাশে গড়ে উঠেছে এক গ্রামীণ জীবনযাপন, যা শহুরে জীবনের ধূসর কোলাহলের বাইরে এক অনন্য শান্তির দিগন্ত।
প্রতিটি ঋতু নতুন এক রূপগ্রীষ্মের তাপে চর যেন সোনালি ঘাসে ঢাকা এক সমতল ভূমি, বর্ষায় মেঘনার জলের সাথে মিশে যায় চর। যেন স্বপ্নের এক জলমগ্ন রাজ্য আর শীতে আসে শীতল বাতাসের সুরভি, মিশে যায় শান্ত নিস্তব্ধতায়। এখানে প্রতিটি ঋতু নতুন এক চিত্রশালা খুলে দেয়। ভ্রমণকারীর মনে হবে প্রতিবারই যেন প্রথমবারের মতো চর আবিষ্কার করেছেন।
Advertisement
লক্ষ্মীপুর শহর থেকে শুরু করে রামগতির আলেকজান্ডার বাজার পর্যন্ত বাস বা সিএনজিতে যাওয়া যায়। তারপর স্পিড বোট বা নৌকা ধরে মাঝিদের সঙ্গে মধুর দরদাম করে যেতে হয়। বিশাল মেঘনার নীল জলের বুক চিরে পাড়ি দিতে লাগে মাত্র ৩০ থেকে ৬০ মিনিট। তারপর চোখের সামনে ছড়িয়ে পড়ে এক অপরূপ প্রকৃতির রূপসী গহ্বর।
পর্যটকের নজর নতুন দিকেএকদিনের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র ছিল চর আলেকজান্ডার কিন্তু এখন যেন সবার মন সেই সবুজ দ্বীপে, চর আব্দুল্লাহর দিকে। ঢাকার অতি ব্যস্ততম পথ থেকে শুরু করে নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, এমনকি রাজশাহীর মানুষ ছুটে আসছে এই নৈসর্গিক মোহনায় হারিয়ে যেতে। ঢাকা থেকে আসা পর্যটক মুনতাসির আহমেদ বলেন, ‘ফেসবুকে ছবি দেখে মোহিত হয়েছিলাম, বাস্তব চোখে দেখে মনে হলো ক্যামেরাও এই সৌন্দর্যের পূর্ণরূপ ধারণ করতে ব্যর্থ। এ যেন এক ধরনের আত্মিক প্রশান্তির ভুবন।
আরও পড়ুন
ব্রহ্মপুত্রের বুকে শান্ত বিকেল সবুজের ঢেউ তোলা বরইচাড়া গ্রাম ভাইরাল হয়েছে নৈসর্গিক ছবিসম্প্রতি আশরাফুল ইসলাম শিমুল নামের একজন পর্যটক ও ফটোগ্রাফারের চোখে ধরা পড়া চর আব্দুল্লাহর চমৎকার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তার ছবিগুলোতে চর আব্দুল্লাহর স্বপ্নিল প্রকৃতির রূপগুলো এত নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছে যে, ভ্রমণপিপাসুদের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাইরাল হওয়া এই ছবি যেন চর আব্দুল্লাহর অপরূপ সৌন্দর্যের নতুন দরজা খুলে দিয়েছে।
Advertisement
চরের গরু-ভেড়া পালনের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় রাখালরা বলছেন, ‘আগে শুধু গরুদের জন্যই আমরা ছিলাম। এখন মানুষ আসে। ছবি তোলে, গল্প শোনে, কিছু কিনেও নেয়। এতে আমরা আনন্দ পাই। পর্যটনের বাড়বাড়ন্তে আশেপাশের বাজারের দোকান, নৌকার মাঝি এবং কৃষকেরা সবাই লাভবান হচ্ছেন।
প্রশাসনের দৃষ্টিরামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আমজাদ হোসেন জানান, চর আব্দুল্লাহ প্রকৃতির এক অমূল্য ধন। আমরা চাই এটি পর্যটনের আওতায় নিয়ে আসতে। তবে অবশ্যই পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। তিনি জানান, এরই মধ্যে বিষয়টি জেলা পর্যায়ের পর্যটন উন্নয়ন কমিটির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থালক্ষ্মীপুর শহরে রয়েছে বেশ কিছু আরামদায়ক গেস্ট হাউজ, যেমন- সোনার বাংলা, এনআর, ভিআইপি ও স্টার গেস্ট হাউজ। খাবারের জন্য রয়েছে রাজমহল, সোনার বাংলা, মোহাম্মদিয়া ও নুরজাহান হোটেল। যেখানে পাওয়া যায় স্থানীয় নদীর মাছের স্বাদেভরা ঘরোয়া রান্না।
অপার সম্ভাবনার দ্বারচর আব্দুল্লাহ যেন এক অপার সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে লক্ষ্মীপুরবাসীর জন্য। পর্যটন আর স্থানীয় জীবনযাত্রার মধ্যে সুন্দর সমন্বয়, প্রশাসনিক নজরদারি আর পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে, চরটি হতে পারে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম পর্যটন রত্ন। চর আব্দুল্লাহ আজ আর শুধু একটি চর নয়, এটি মানুষের স্বপ্ন দেখা, প্রকৃতির সঙ্গে মেলামেশা করার এবং নিজেদের নতুন করে আবিষ্কারের এক জীবন্ত ঠিকানা।
এসইউ/এমএস