খেলাধুলা

ছেলেদের সাথে শখে ফুটবল খেলা সেই ঋতুপর্ণা এখন দেশের সেরা

ছেলেদের সাথে শখে ফুটবল খেলা সেই ঋতুপর্ণা এখন দেশের সেরা

কিছু প্রাপ্তি প্রত্যাশার সীমানাও ছাড়িয়ে যায়। আর সেই সাফল্যের সাথে জড়িয়ে থাকে কিছু কীর্তিমানের গল্পগাঁথা। এই যেমন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল প্রথমবারের মতো এশিয়ার সর্বোচ্চ আসর এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো। আগামী প্রজন্মের কাছে কেউ সে গল্প করলে সেখানে সবার আগে উঠে আসবে ঋতুপর্ণা চাকমার নাম। ৭৩ ধাপ এগিয়ে থাকা মিয়ানমারের বিপক্ষে বাংলাদেশের ২-১ ব্যবধানের অবিস্মরণীয় জয়ে জোড়া গোল উপহার দিয়েছে রাঙ্গামাটির এই যু্বতীর জাদুময়ী বাম পা।

Advertisement

কথায় আছে, মানিকে মানিক চেনে। ঋতুপর্ণাকে প্রথম চিনেছিলেন রাঙ্গামাটির মগাছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বীরসেন চাকমা। এরপর নারী ফুটবলের প্রধান কোচ পিটার বাটলার।

তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মাঝে মধ্যে ছেলেদের সাথে শখে ফুটবল খেলেছেন ঋতুপর্ণা। তখন তিনি জানতেনই না, মেয়েরা ফুটবল খেলে। শখের ফুটবল খেলতে খেলতে একবার পায়ে ব্যথা পেয়ে চিন্তা করেছিলেন আর খেলবেন না।

তবে বীরসেন চাকমা তার মধ্যে দেখেছিলেন প্রতিভা আর সম্ভাবনার ছায়া। বীরসেন চাকমা বুঝিয়ে-সুঝিয়েই তাকে ফুটবল খেলতে নামাতেন। ছেলেদের সাথে খেলে ফুটবলে হাতেখড়ি হওয়া ঋতু ২০১১ সালে বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে নিজের স্কুলকে ফাইনালে তুলতে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তারপর থেকেই বড় হতে থাকে ঋতুর ফুটবল দুনিয়া।

Advertisement

সংসার যেখানে চলে না সেখানে ফুটবলে মন বসে কি করে? ২০১৬ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হন ঋতুপর্ণা। ওই বছরই তিনি ডাক পান বাফুফের জুনিয়র ক্যাম্পে। সেখান থেকে মাত্র ৯ বছরে ঋতু এখন দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবলার। বাংলাদেশকে দুটি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ এনে দিতে রেখেছেন বড় ভূমিকা। সর্বশেষ সাফের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও উঠেছে তার হাতে। তিনি এখন দক্ষিণ এশিয়ার স্বীকৃত সেরা খেলোয়াড়।

২০২৪ সালের সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে যে ১৮ ফুটবলার বিদ্রোহ করেছিল, সেখানে নেতৃত্বে থাকাদের অন্যতম ছিলেন ঋতুপর্ণা। প্রকাশ্যে গণমাধ্যমে ঋতু কোচের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন- তিনি তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারেও হস্তক্ষেপ করেন, ‘আমরা এখন প্রাপ্ত বয়স্কা। বিরতির দিনে মন চাইলে বন্ধুবান্ধবের সাথে কফি খেতে যেতে পারি। এটা স্বাভাবিক। কোচ এটা নিয়ে কথা বলতেন। আমাকেও এমনও বলেছিলেন, আমার নাকি ট্রেনিংয়ে মনযোগ নেই। আমার নাকি অন্যদিকে মনোযোগ।’

কোচের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করার পরও পিটার বাটলার কিন্তু ঋতুপর্ণাকে দলের বাইরে রাখেননি। যেমন রেখেছেন সাবিনা, কৃষ্ণা, মাসুরা, সানজিদাদের। কারণ, পিটার জানতেন ঋতুই এখন দেশের সেরা ফুটবলার। কোচের সেই আস্থার প্রতিদান এর চেয়ে আর কীভাবে দিতে পারতেন ঋতু?

পিটার বাটলার বিদ্রোহী ১৮ ফুটবলারের মধ্যে মাত্র ৫ জনকে দলের বাইরে রেখেছেন। তার এই সিদ্ধান্ত যে ব্যক্তিগত ক্রোধের কারণে নয়, পারফরম্যান্সভিত্তিক, তা বোঝার জন্য ইন্দোনেশিয়া ও জর্ডানের পর মিয়ানমারের তিন ম্যাচের ফলই যথেষ্ট।

Advertisement

বছর এগারো আগে ঋতুপর্ণা চাকমার বাবা বরজবাঁশি চাকমা ক্যান্সারে মারা গেছেন। তার মা বোজপুতি চাকমা কষ্ট করে সংসার চালাতেন। সেও এখন অসুস্থ্। বাংলাদেশ এশিয়ান কাপের টিকিট নিশ্চিতের পর ঋতুপর্ণা প্রথম ফোন করেছিলেন তার মায়ের কাছে। সেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ঋতুপর্ণা বলেছেন, ‘মা যখন জানলেন, আমরা কোয়ালিফাই করেছি এবং আমি জোড়া গোল করেছি তখন তিনি বলছিলেন, নিজেকে এখন আর অসুস্থ মনে হয় না। তিনি অনেক খুশি হয়ে নিজে যে অসুস্থ তাও ভুলে গিয়েছিলেন।’

১১ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। বছর তিনেক আগে হারিয়েছেন একমাত্র ভাই পার্বন চাকমাকে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মর্মান্তিভাবে প্রাণ হারান তার ভাই। এখন তিন বোনের সাথে মাকে নিয়ে তার সংসার। তবে বড় তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে এরই মধ্যে। বোজপতি চাকমার বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা এখন ঋতুপর্ণা চাকমা। সেই সাথে গর্বেরও। রাঙ্গামাটির গহীন জঙ্গল থেকে ঋতুর মাকে খুঁজে বের করেন গণমাধ্যমকর্মীরা। ঋতুর বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, খেলা এবং সংসারের টানাপড়েনের গল্প লেখেন অনেকে।

অস্বচ্ছ্বল সংসারকে স্বচ্ছ্বলতা এনে দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ঋতুপর্ণা। তার চেয়েও বড় কথা, এখন কে না চেনেন এই বাঁ-পায়ের জাদুকরকে? প্রতিপক্ষের দর্শকদের চুপ করিয়ে দেওয়ায় পারদর্শী ঋতুর সেই উদযাপন তো সবার চোখে লেগে আছে।

গত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে নেপালের বিপক্ষে ৮১ মিনিটে বাঁ-পায়ে জয়সূচক গোল করেই তিনি মুখে আঙ্গুল দিকে চুপ হওয়ার সংকেত দিয়েছিলেন। আসলেও তাই, কাঠমান্ডুর দর্শকদের গর্জন থেমে গিয়েছিল ঋতুর করা গোলে। এই তো মিয়ানমারের বিপক্ষে দ্বিতীয় গোল করেও স্বাগতিক দর্শকদের গলা ফাটানো চিৎকার থামিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। আর গোলের পর দুই হাতে মুখ ঢেকে উদযাপন করেছিলেন।

ওই উদযাপন কেন করেছিলেন ঋতুপর্ণা? এর ব্যাখ্যা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার এই সেরা ফুটবলার বলেছিলেন, ‘আসলে মুখ ঢাকার পেছনে কোনো কারণ ছিল না। আমি যখন দ্বিতীয় গোলটি করি তা নিয়ে কি বলবো! এই অনুভূতি আমি বলে প্রকাশ করতে পারবো না। আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম।’

গত রাতে (রোববার) হাতিরঝিলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে দেশের মানুষকে আরো স্বপ্ন দেখিয়েছেন ঋতু। তাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মেয়েরা ভালো করে জানেন কঠিন পরিস্থিতে কিভাবে লড়াই করতে হয়। আপনারা আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখবেন। আমরা আপনাদের নিরাশ করবো না। শুধু এশিয়া নয়, আমরা বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চাই।’

দেশকে দারুণ অর্জন এনে দিয়ে সোমবার সকালে ভুটান চলে গেছেন তার বর্তমান ক্লাব পারো এফসিতে খেলতে। ভুটানে পৌঁছানোর পর সতীর্থরা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সেখানে ঋতুর সাথে বড় করে উচ্চারিত হয়েছে বাংলাদেশের নামও। বাংলাদেশ যে এখন এশিয়ার সেরা ১২ দলের একটি! লক্ষ্য এখন সেরা ৮-এ উঠে বিশ্বকাপ ও অলিম্পিক ফুটবলে খেলার স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা।

আরআই/আইএইচএস/