ভ্রমণ

একলা পথে এক শান্তির খোঁজে

একলা পথে এক শান্তির খোঁজে

সফিউল ইসলাম

Advertisement

জীবনের ক্লান্তিকর ছকে বন্দি হয়ে যখন মন চিৎকার করে ওঠে একটু মুক্ত হাওয়ার জন্য; তখন একটুখানি সমুদ্রের ঢেউ, একটু নীলাকাশ আর এক চিমটি নীরবতা অনেকটা শান্তি এনে দিতে পারে। ঠিক এমন এক সন্ধ্যায়, অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় হেলান দিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ফেসবুকে চোখে পড়ল আকিলপুর সমুদ্রসৈকতের একটি ছবি। ছবির পেছনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, নরম সোনালি আলো পানির গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তখনই মনে হলো– জায়গাটায় আমাকে যেতেই হবে! সীতাকুণ্ড নামটা চট্টগ্রামের মানুষদের কাছে নতুন কিছু নয় কিন্তু আকিলপুর? আমার জানা ছিল না। তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখি, এখনো পর্যটকদের ভিড়ে বিরক্ত হয়নি জায়গাটা। নিরিবিলি, শান্ত, যেন এক অলিখিত প্রতিজ্ঞায় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে।

পরিকল্পনা ও প্রস্তুতিসিদ্ধান্তটা নেওয়ার পর শুরু হলো ছোট্ট প্রস্তুতি। এটি ঠিক কোনো ট্রেকিং নয়, তাই ভারী ব্যাগপত্র নেওয়ার দরকার পড়েনি। কিন্তু সমুদ্রের ধারে সময় কাটানো, কিছু ছবি তোলা আর সন্ধ্যায় বালি ভেজানো হেঁটে বেড়ানোর মতো কিছু সময় নিজের জন্য রাখার পরিকল্পনা ছিল। সঙ্গে নিলাম—হালকা কটন জামা, ক্যামেরা, সানস্ক্রিন, স্ন্যাক্স, ফাস্ট এইড। গন্তব্য আকিলপুর, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।

যাত্রা: চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড হয়ে আকিলপুরসকালে আমি চট্টগ্রাম শহর থেকে রওয়ানা দিলাম। যেহেতু সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয় (প্রায় ৪০ কিলোমিটার)। তাই বাস কিংবা সিএনজি করেই যাওয়া যায়। আমি স্থানীয় বাস নিলাম–‘সীতাকুণ্ড এক্সপ্রেস’। সকাল ৮টা নাগাদ বাস ছাড়ল। জানালার পাশে বসে আমি বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম, একটু একটু করে শহরের কোলাহল পেছনে পড়ে যাচ্ছে আর প্রকৃতি আপন রূপে ধরা দিচ্ছে। সীতাকুণ্ড বাজারে পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। সেখান থেকে সিএনজি বা অটো করে যাওয়া যায় আকিলপুর পর্যন্ত। স্থানীয় লোকজন বেশ সহৃদয়। আমি একজন দোকানদারের সাহায্যে অটো খুঁজে পেলাম। আমার গন্তব্য জানাতেই তিনি বললেন, ‘আকিলপুর? ভাই, অসাধারণ জায়গা! এখনো মানুষের ভিড়ে নষ্ট হয়নি। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরে আসেন।’ কথাগুলো আমার ভেতরের আগ্রহটা আরও বাড়িয়ে দিলো।

Advertisement

আকিলপুরে প্রথম পা রাখার মুহূর্তযখন পৌঁছালাম, তখন প্রায় দুপুর ১২টা। কিন্তু রোদটা ছিল বেশ সহনীয়। সামনে বিস্তীর্ণ বালুর চর, আর দূরে একটানা ঢেউ এসে বালি ছুঁয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে। কানে আসছিল সমুদ্রের মৃদু গর্জন, আকাশটা যেন এক বিশাল নীল ক্যানভাস–তার মাঝে ছোট ছোট কিছু সাদা মেঘ এঁকে দিয়েছে প্রকৃতি নিজ হাতে। আমি এক মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়িয়ে রইলাম। জীবনের সমস্ত যান্ত্রিকতা ভুলে শুধু সেই ঢেউয়ের শব্দ শুনছিলাম। সেই সময়টুকু যেন একান্তই আমার ছিল।

খাবারের গল্পঅবশ্য এতটা ভ্রমণের পর ক্ষুধা চেপে বসেছিল বেশ। আকিলপুরে তেমন কোনো বড় হোটেল নেই। তবে ছোট ছোট কয়েকটি চা দোকান, ভাজি-পারোটা পাওয়া যায়। আমি একটা ছোট্ট দোকানে ঢুকলাম–নাম ছিল ‘সৈকত টি স্টল’। চায়ের সঙ্গে গরম সিঙারা, বেগুনি আর এক প্লেট ভেজিটেবল খিচুড়ি। বিশ্বাস করুন, শহরের দামি হোটেলের খাবারের চেয়ে কম নয় স্বাদে–হয়তো পরিবেশ আর ক্ষুধার কারণে এমন লেগেছে। তবে আসলেই খুব ভালো লেগেছিল। দোকানের এক আন্টি রান্না করছিলেন। আমি বললাম, ‘আপনার রান্না খুব মজার!’ তিনি হাসলেন, ‘ভাই, এখানে আসা মানুষদের মনটা ভালো থাকে, তাই খাওয়াও ভালো লাগে।’

মানুষ ও পরিবেশআকিলপুরের মানুষ খুব সরল, অতিথিপরায়ণ। আমি বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি–একজন জেলে বলছিলেন, ‘ভোরবেলা সমুদ্র একেবারে অন্যরকম হয়, পাখিরা গান গায় আর সূর্য উঠতে উঠতে পানির ওপর সোনার রং লাগে।’ একটি পরিবার এসেছিল সীতাকুণ্ড থেকে পিকনিকে। তারা পাতা বিছিয়ে খাবার খাচ্ছিল আর বাচ্চারা বালি নিয়ে খেলা করছিল। এসব দৃশ্য মনটা আরও প্রশান্ত করছিল।

ছবির খেলা ও স্মৃতি তৈরিআমি আমার মোবাইল নিয়ে বের হলাম সৈকতের ধারে ছবি তুলবো বলে। জলের ছিটায় ভেজা পাথর, বালুর ওপর ছায়া, আকাশের প্রতিচ্ছবি–সবকিছুই এত ছবির মতো লাগছিল যে, কোনটা ফ্রেমে রাখি আর কোনটা ছেড়ে দিই, বুঝতে পারছিলাম না। একটা সময় পায়ের জুতা খুলে পানির ধারে হেঁটে গেলাম। ঢেউ এসে পায়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। একধরনের খুনসুটি যেন–প্রকৃতি তার মতো করে খেলছে আমার সঙ্গে।

Advertisement

সূর্য যখন নামতে শুরু করেবিকেলের দিকে আকিলপুর তার আরেক রূপ দেখাতে শুরু করল। সূর্য যেন আস্তে আস্তে জলরঙে আঁকা ছবির মতো লালচে, সোনালি আভা ছড়িয়ে দিতে লাগল। চারপাশে যেন এক মায়াবী আলোর পর্দা। পেছনের পাহাড় চূড়াগুলো রং বদলাতে লাগল–একবার হালকা বেগুনি, কখনো লালচে ধূসর। আমি বালিতে বসে ছিলাম একদম সৈকতের ধারে। পাশে বসে থাকা আরেকজন ভ্রমণপিপাসু তরুণ বলল, ‘ভাই, এই জায়গাটায় সূর্যাস্ত দেখার সময় মনটা অন্য জগতে চলে যায় না?’ আমি শুধু মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, মনে হয় যেন কিছুই ভাবতে হচ্ছে না, কিছুই বলতে হচ্ছে না–শুধু থাকলেই সব কিছু হয়ে যায়।’ ঢেউগুলো যেন তখন একটু বেশি আলগা হয়ে বয়ে যাচ্ছিল। সূর্য একসময় ঢেউয়ের পেছনে লুকিয়ে গেল কিন্তু তার আলো থেকে গেল বালির মাঝে। সেই আলো যেন আমাকে কানে কানে বলল, ‘তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছো।’

আরও পড়ুনরাতারগুল ও জাফলংয়ে হাসির স্রোতব্রহ্মপুত্রের বুকে শান্ত বিকেল

রাতের প্রস্তুতি ও থাকার ব্যবস্থাআকিলপুরে থাকার জন্য বড় হোটেল নেই। তবে আশপাশের এলাকায় কিছু গেস্ট হাউজ ও স্থানীয়দের ঘরভাড়া ব্যবস্থা আছে। আগেই খোঁজ নিয়েছিলাম–স্থানীয় একজনের ঘরে থাকা যায় সামান্য খরচে। সেই ঘরটি ছিল একদম সমুদ্রের ধারে, ছাউনি দেওয়া ছাদে সাদা-নীল পর্দা, বারান্দা থেকে সামনের সমুদ্র দেখা যায়। বিকেলের দিকে সেই ঘরটিতে উঠলাম। ঘরের ভেতর বেশ পরিষ্কার–খাট, একটা ছোট টেবিল আর জানালার পাশে একটা চেয়ার। মালিক কাকা বললেন, ‘আপনি এখানে এক রাত থাকুন, সকালে সমুদ্রটা একদম অন্যরকম লাগে।’ আমি তখনই ঠিক করে ফেললাম–হ্যাঁ, আজ রাতটা এখানেই কাটাবো।

রাতের সমুদ্র ও নীরবতারাতের খাবার খেতে গেলাম স্থানীয় একটি টিনের চালের রেস্তোরাঁয়–‘সামুদ্রিক খাবার ঘর।’ সেখানে যে রান্নাটা পেলাম, তার কথা না বললে অন্যায় হবে। সেদিনের মেন্যু ছিল: ভুনা চিংড়ি, নারকেল দুধে রান্না করা মাছের ঝোল, কুমড়া ভাজি, গরম ভাত। আবহাওয়ার ঠান্ডা হাওয়ায় এমন গরম খাবার খাওয়া যেন আত্মার খোরাক! খাওয়ার পর আমি আবার বের হলাম সৈকতের ধারে–এবার আর কোনো কোলাহল নেই। শুধু ঢেউয়ের শব্দ আর একটাই চাঁদের আলো চারপাশে। বসে বসে আমি ভাবছিলাম, এত শহরের জীবন পার করে আমরা ভুলে যাই প্রকৃতির এমন সহজ রূপ কতটা প্রয়োজন। এই সমুদ্র, এই বালু, এই নীরবতা–এগুলো জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় থেরাপি।

ভোরের আকিলপুর–এক নতুন রূপপরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো। ঘুম ভাঙতেই শুনি পাখির ডাকা, সঙ্গে মৃদু হাওয়ার শব্দ। বাইরে গিয়ে দেখি, সূর্য উঠছে ধীরে ধীরে। সমুদ্রের জলে তখন একধরনের নীলাভ সোনালি প্রতিচ্ছবি–যেন স্বর্গের কোনো দরজা খুলেছে। স্থানীয় কিছু জেলে তখন মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি একটু হাঁটতে বের হলাম। বালু তখন ঠান্ডা, বাতাসে একধরনের লবণাক্ত স্নিগ্ধতা। মনে হচ্ছিল যেন আমি হাঁটছি সময়ের বাইরে কোনো এক পরিমণ্ডলে।

ফিরে আসার মুহূর্তপ্রকৃতির এমন কোলে সময় কাটিয়ে শহরে ফেরার ভাবনা মাথায় আনতেই মনটা ভারী হয়ে উঠল। কিন্তু ফিরতে তো হবেই। সকাল ১০টার দিকে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় অটো ঠিক করলাম সীতাকুণ্ড বাজার পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। ফেরার পথে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম আকিলপুরকে–যেন শেষবারের মতো চোখে রাখি এর রূপ। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে আবার বাসে চড়ে চট্টগ্রাম শহরে ফিরে এলাম।

ভ্রমণের শেষে কিছু অনুভব, কিছু ভাবনাভ্রমণটা আমার কাছে শুধু একটা ঘোরাঘুরি নয়, এটা ছিল এক ধরনের ‘মন খুঁজে পাওয়া’র গল্প। আমরা যারা প্রতিদিন মেট্রো, অফিস, দায়িত্ব এবং ব্যস্ততার মাঝে ডুবে যাই। তাদের জন্য এমন একটা জায়গা দরকার হয় যেখানে সময় থেমে থাকে। আকিলপুর সে রকম এক জায়গা। এখানে আপনি নিজের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে যাবে আপনার ক্লান্তি আর সূর্যের আলো মুছে দেবে সমস্ত অবসাদ।

ভ্রমণ টিপসযদি কখনো আপনি আকিলপুর ঘুরতে যেতে চান, তাহলে এই কিছু টিপস মাথায় রাখুন: যাবার সময়: অক্টোবর থেকে মার্চ–আবহাওয়া আরামদায়ক। থাকার ব্যবস্থা: স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরভাড়া বা সীতাকুণ্ডে থাকা।খাবার: সামুদ্রিক খাবার পাবেন স্থানীয় দোকানে; ভর্তা, ভাজি, মাছের ঝোল অসাধারণ।নিরাপত্তা: একা গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলুন; পরিবেশ মোটামুটি নিরাপদ। ক্যামেরা ও চার্জার: অবশ্যই সঙ্গে রাখবেন, কারণ এমন দৃশ্য প্রতিদিন আসে না। পরিচ্ছন্নতা: দয়াকরে প্যাকেট, প্লাস্টিক, বোতল ফেলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করবেন না।

ইতিকথায়আকিলপুর আমার কাছে হয়ে উঠেছে একটা অনুভূতির নাম। সেখানে ফেলে এসেছি একটু শান্তি, একটু নীরবতা আর অনেকগুলো স্মৃতি। একদিন আবার ফিরবো, ঠিক যেমন সমুদ্রের ঢেউ বারবার ফিরে আসে তীরের কাছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী।

এসইউ/এমএফএ