শুভ। নামটি শুনলেই মনে হয় এক সৌভাগ্যের নাম। অথচ ১৭ বছর বয়সেই তার জীবনে নেমে এসেছে অন্ধকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে চিরদিনের জন্য হারালেন একটি চোখ। আরেকটি চোখও অন্ধ হওয়ার পথে। এছাড়া শরীরের ভেতরে চামড়ার নিচে এখনো রয়েছে ‘১৭০টি ছররা গুলি’। সব মিলিয়ে জীবন দুর্বিষহ শুভর। জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করালেও পুরোপুরিভাবে সুস্থ হননি। এরমধ্যে অর্থের অভাবে ভালো চিকিৎসা করাতে পারছে না তার পরিবার।
Advertisement
মাদারীপুর পৌর শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের চর কুকরাইল এলাকার মো. সোহেল বেপারীর একমাত্র ছেলে শুভ বেপারী। তিনি মাদারীপুর সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তার পরিবারে মা-বাবা, বড় এক বোন ও ৭ বছর বয়সী এক ভাগ্নে আছে। এখন শুভর বয়স ১৮।
সংসারের হাল ধরতে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। মা লিপি বেগম লোন করে আড়াই লাখ টাকা জমা দেন এক দালালের কাছে। শহরের ইটেরপুল এলাকায় ছোট একটি মুদি দোকান করে শুভর বাবা কোনো রকমে সংসার চালাতেন। রাস্তার পাশে সরকারি জায়গা হওয়ায় সেই দোকান উচ্ছেদ করা হয়। এতে আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে পরিবারটি।
শুভর পরিবার ও স্থানীয়রা জানান, গত বছরের ১৮ জুলাই মাদারীপুর শহরের শকুনি লেকপাড়ে ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যান শুভ। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে আস্তে আস্তে এগুতে থাকেন। মাদারীপুর পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে এলে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা গুলি ছুড়তে থাকেন। এসময় ছররা গুলি তার মাথা, চোখসহ সারা শরীরে ঢুকে যায়। সেই সময় তার বন্ধুসহ আরও চারজন আহত হন। বুলেটের আঘাতে তখন শুভর কোনো জ্ঞান ছিল না।
Advertisement
এরপর শুভসহ ৪ জনকে অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রথমে মাদারীপুরের চরমুগরিয়া আধুনিক হাসপাতালে, পরে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সবশেষ ঢাকায় নেওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্সে যাওয়ার পথেও হামলার শিকার হন তারা। পরে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু ঠিকমতো চিকিৎসা না পাওয়ায় প্রাণে বাঁচলেও হারাতে হয়েছে বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি। বর্তমানে উন্নত চিকিৎসা ও অর্থের অভাবে ডান চোখটিও হারাতে বসেছেন তিনি।
পুনরায় দৃষ্টি শক্তি ফিরে পেতে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন শুভ ও তার পরিবার। এছাড়া মাথাসহ সারা শরীরে অসংখ্য ছররা গুলি রয়েছে তার। এরমধ্যে মাত্র ১০টির মতো বের করতে পারলেও বাকিগুলো বের করা সম্ভব হয়নি। ফলে এগুলোর কারণে শরীর ও মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা হয়। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেন না শুভ।
এদিকে বিদেশ যাওয়ায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার। দালালের কাছ থেকে আড়াই লাখ টাকাও এখনো ফেরত পাননি। জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করালেও বর্তমানে টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা বন্ধ হয়ে আছে। বিভিন্নভাবে দেড় লাখ টাকা পেলেও এখন পর্যন্ত চিকিৎসার জন্য ৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। অন্যদিকে কিস্তির টাকা শোধ করতে না পারায় দুটি মামলাও হয়েছে শুভর মা লিপি বেগমের নামে। তাই সব মিলিয়ে পরিবারটি এখন অসহায়।
আহত শুভ বলেন, আমাদের একটা ছোট মুদি দোকান ছিল। সেই দোকানের আয়ের টাকায় সংসারসহ চিকিৎসা খরচ চলতো। কিন্তু দোকানটি সরকারি জায়গায় হওয়ায় তা উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। পরে ওই দোকানটি আমাদের বাড়ির সামনে রাখা হয়েছে। তবে এখানে তেমন একটা বেচাকেনা হয় না। আমাদের একটি মাত্র জমি ছিল, সেটাও বিক্রি করা হয়েছে। জমি বিক্রির টাকাসহ মোট ৫ লাখ টাকা আমার চিকিৎসার খরচ চালানো হয়েছে। পরে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা করা হয়। সেই টাকাও চিকিৎসার জন্য খরচ হয়ে গেছে।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, দোকান উচ্ছেদ করে দেওয়ার পর আমার বাবা ও আমি দুজনই বেকার। কোনো রকম টেনেটুনে সংসার চলছে। এখন চিকিৎসা করাবো কীভাবে সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি। এছাড়া চিকিৎসার জন্য আমাদের একমাত্র বাড়ির জমিও বিক্রি করায় এখন আমরা নানার দেওয়া বাড়িতে থাকছি। আমার চোখ ও মাথায় ৫৭টিসহ সারা শরীরে ১৮০টি গুলি আছে। মাত্র ১০টি মতো বের করা সম্ভব হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন এগুলো রগের সঙ্গে মিশে গেছে। বের করতে হলে জীবনের ঝুঁকি আছে। তাই এখন কি করবো জানি না। খুব যন্ত্রণায় দিন কাটছে।
শুভর মা লিপি বেগম বলেন, রাতে ঘুমের ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণায় হঠাৎ চিৎকার করে উঠে শুভ। সন্তানের এমন কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। এখন তার উন্নত চিকিৎসা দরকার। কিন্তু টাকার অভাবে তা করাতে পারছি না। শুভ সুস্থ থাকা অবস্থায় বিদেশ যাওয়ার জন্য লোন করে দালালের কাছে আড়াই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। সেই টাকাও এখনো ফেরত পাইনি। আর কিস্তির টাকা ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারায় দুটি মামলা হয়েছে। এখন আমরা কীভাবেই লোন শোধ করবো আর কীভাবেই বা শুভর চিকিৎসা করাবো সেই চিন্তায় আছি।
বাবা সোহেল বেপারী বলেন, বর্তমানে আমার কোনো কর্মসংস্থান নেই। ছেলেটার দ্রুত ভালো চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন। সরকার যেন আমার কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন এবং ছেলের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয় সেই দাবি জানাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাদারীপুর জেলা কমিটির সদস্য সচিব মাসুম বিল্লাহ বলেন, শুভকে আমরা দুবার অপারেশনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। এখন তার চোখের জন্য উন্নত ও ব্যয়বহুল চিকিৎসা প্রয়োজন। তাই এ বিষয়ে সরকারসহ অন্যরা যদি এগিয়ে আসে, তাহলে ওর উন্নত চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাদারীপুর জেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক আশিকুল তামিম আশিক বলেন, আহত অনেককেই এই দেশে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের বিদেশ নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করানোর জন্য প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে সরকার। আসা করি তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, শুভর বিষয়টি আমরা জানি। তার খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে তাকে সরকারী সহযোগিতা করা হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/জেডএইচ/এএসএম