১৯ মে ২০২৫। সকাল সাড়ে ছয়টা। আমি দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিন্দুতে। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। মাথার ওপরে বিশুদ্ধ নীল আকাশ থাকার কথা ছিল কিন্তু প্রকৃতি সেটা চায়নি। চেয়েছিল চরম পরীক্ষা। পায়ের নিচে ছিল অসীম শূন্যতা। ৮,৮৪৮.৮৬ মিটার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি শুধু একজন পর্বতারোহী নই; আমি তখন হাজারো আবেগ, ত্যাগ, সংগ্রাম আর স্বপ্নের প্রতিনিধি।
Advertisement
এ পথ সহজ ছিল না। হিমালয়ের অতল গভীর বরফের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে আমাদের জীবনবিন্দু। প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য। যমুনা নদীর উত্তাল খরস্রোতা ঢেউ, অনিশ্চয়তার দীর্ঘ পথ, খুম্বু আইসফল, লোৎসে ফেস, সাউথ কল, হিলারি স্টেপ একেকটা জায়গা যেন একেকটা মানসিক যুদ্ধক্ষেত্র ও মৃত্যুর চোখ রাঙানি।
অক্সিজেনশূন্য উচ্চতায় কৃত্রিম অক্সিজেন মাস্কবদ্ধ মুখে প্রতিবারই মনে হয়েছে, ‘আর পেরে উঠবো না।’ কিন্তু হৃদয়ে বাজতে থাকা বাংলাদেশের নাম আর ‘সি টু সামিট’ অভিযানের অঙ্গীকার আমাকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।
এভারেস্ট জয়ের এই অভিযান ছিল ‘সি টু সামিট’ নামের একটি বৃহৎ মিশনের অংশ। যার মূল লক্ষ্য ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পর্বতশিখর পর্যন্ত এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া যে, ‘পৃথিবী আমাদের, আমাদেরই দায়িত্ব প্লাস্টিক দূষণ ও কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে টিকিয়ে রাখা আমাদের ভবিষ্যৎ।’
Advertisement
আমার এই যাত্রা শুরু হয়েছিল বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে। যেখানে প্লাস্টিক বর্জ্যে দমবন্ধ হয়ে আসছে সাগর, সমতল, পাহাড়ের জীবন। আমি সেই দূষণ আর পরিবর্তনের বার্তা নিয়েই পর্বতমুখী হয়েছিলাম, যেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়িয়ে বলতে পারি, ‘আমরা যদি পাহাড় জয় করতে পারি, তবে নিজের ভেতরের অসচেতনতাকেও জয় করতে পারি।’
পর্বতারোহণ আমার কাছে কেবলই অ্যাডভেঞ্চার নয়। এটি দায়িত্ব, প্রতিবাদ এবং প্রজন্মের প্রতি এক প্রতিজ্ঞা। সমুদ্র থেকে শুরু করে বরফাচ্ছন্ন শিখরে উঠে আমি বলতে চেয়েছি, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সময় এখনই। আজ যদি আমরা সচেতন না হই, কাল হয়তো কোনো এভারেস্টই থাকবে না। থাকবে না আমাদের হাঁটার মতো পথ, বাঁচার মতো বাতাস।
আরও পড়ুন কেমন ছিল শাকিলের প্রথম অভিযান বিশ্বরেকর্ড গড়ে শাকিলের এভারেস্ট জয়এভারেস্টের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমি কেঁদেছি-কৃতজ্ঞতায়, আনন্দে আর দায়িত্ববোধে। এই আরোহণ শুধু আমার একার নয়। এটি আমার দেশের, আমার মানুষদের আর সেই সকল তরুণের; যারা আজও স্বপ্ন দেখে নিজের সীমা ভেঙে কিছু করে দেখানোর। এটা তাঁদের, যারা বিশ্বাস করেছিল আমার স্বপ্নে। এটা তাঁদের, যারা আমাকে শিখিয়েছে, ‘অসম্ভব’ শব্দটা শুধুই একটি দেরিতে মানা ব্যর্থতা। এভারেস্টের চূড়া থেকেই বলছি, সাহস থাকলে, পরিশ্রম থাকলে আর দেশের জন্য ভালোবাসা থাকলে, কোনো স্বপ্নই দূর থেকে যায় না।
আমার যাত্রা থেমে যায়নি। এটি কেবল শুরু। কারণ ‘সি টু সামিট’ কেবল একটি অভিযান নয়, এটি একটি বার্তা, একটি বিপ্লব।
Advertisement
তাশি গ্যালজেন শেরপা, আমার শুধু গাইড না। একজন ভাই ও বন্ধু। তার কারণেই এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছি। বছর দুয়েক আগে দুজনে পরিকল্পনা করেছিলাম একসাথে দুইটা রেকর্ডময় অভিযান করবো। সেটাই করেছি, আমি ‘সি টু সামিট’ আর গ্যালজেন ২০ দিনে চারবার এভারেস্ট সামিট। আমারটা সফল ভাবে শেষ এবং তার তিনবার শেষ হয়েছে। এখন সে আছে ৪র্থ সামিটের পথে। আশা করি ২৩ মে সকালে নেপালের পতাকা ওড়াবে। ওর জন্য শুভ কামনা।
আমি কৃতজ্ঞতা জানাই সেই সকল মানুষদের; যারা এই অভিযানের পেছনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আমাকে এগিয়ে নিতে। একবারের জন্যও হাল ছেড়ে দেননি, আমার প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন এবং সাহস জুগিয়েছেন।
কৃতজ্ঞতা জানাই প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রাণ গ্রুপ, ইউএনডিপি, মাকালু ই ট্রেডার্স, সিস্টেমা টুথব্রাশ, মি. নুডলস, অদ্রি, ৮কে এক্সপেডিশন, সাকেব নাজিম শুভ্র ও আরও অনেকের ভালোবাসাকে। এই যাত্রাপথের রেডিও পার্টনার ছিল জাগো এফএম, নিউজ পার্টনার ছিল জাগোনিউজ২৪.কম।
এসইউ/জিকেএস