ড. ফোরকান আলী
Advertisement
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মেছিলেন ১৮৬১ সালে। ২০২৫ সালটা ধরলে বয়সটা ১৬৪ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে নতুন কিছু তো লেখার নেই, অথচ বলা চলে তিনি চির নূতনই থেকে যাবেন। ১৯৩৬-১৯৩৮ সাল, শান্তিনিকেতনে পাঠভবনে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে। এমন একজনের সাথে আমার সখ্য গড়ে শান্তিনিকেতনেই। তার কথায়, সেদিন আশ্রমে (আমরা শান্তিনিকেতনকে আশ্রমই বলতাম) ওই দিন পালনের কথাটাই আজ বলবো।
এ বছর, প্রতি বছরই মে মাসে ২৫ বৈশাখ আসে। শান্তিনিকেতনে তখন গরমের ছুটি। আমি যে সময়ের কথা বলছি; সে সময় গরম দুঃসহ ছিল। আশ্রমের জলাধারে যথেষ্ট জল থাকতো না। সেই জন্য নববর্ষের দিনই ২৫ বৈশাখটা পালন করা হতো।
পাতার নাচে মেতে আছে আমলকি কানন যে শান্তিনিকেতনে; সেখানে বৈশাখের দাবদাহ কল্পনা করা যেতো না। সেদিনের শান্তিনিকেতন তো যথেষ্ট ছোট পরিসরে। ছাত্র-ছাত্রী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, কর্মী ও শিক্ষক, সব মিলিয়ে জনসংখ্যা ১০০০ তো নয় হয়তো ৩০০ থেকে ৪০০ এমনই হবে। কিংবা তার থেকেও কম। সেদিনের শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব হতো। পৌষ মেলা হতো।
Advertisement
কবির জীবিতকালের কথাই বলছি। কিন্তু সে সময়ে কলকাতা থেকে বেশি মানুষ যেতেন না। সব উৎসবই আশ্রমিকদের নিয়ে। জন্মদিনের উৎসবের পরেই গরমের ছুটি। শান্তিনিকেতনে আমরা অভ্যস্ত হয়েছিলাম ঘণ্টা শুনে সময় অনুযায়ী কাজ করতে। সিংহসদনে বড় ঘণ্টা বাজতো ঢং ঢং করে। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠতাম। শীতকালে সেটা খুব কষ্টের অভিজ্ঞতা। কিন্তু স্বভাবে ঢুকে গিয়েছিল শিক্ষা—সময়ের কাজ সময়ে করো। তাই পাঁচটার সময়েই উঠে পড়তাম।
তারপর দৌড়োও, দৌড়োও। আজ নববর্ষ। আম্রকুঞ্জে যেতে হবে। সেদিন ভোরবেলা স্নান করে তৈরি হয়ে ঘণ্টার নির্দেশে শ্রীভবনের খিড়কির দোর খুলে লাইন বেঁধে চললাম কিচেনে। যাবার পথে বাঁদিকে পড়ে আশ্রমের শাক-সবজির বাগান, জলের ট্যাঙ্ক আর কালোর দোকান। পরে কালো দিনে দিনে বিখ্যাত হয়েছে। আমার ছোটবেলার কালোর দোকানটি ছোটখাট। চা, বেকারির বিস্কুট পাওয়া যায়।
আমরা ছোট। ওদিকে তাকানো নিষেধ। আমরা সেদিন যে যার আসন নিয়েছি শুধু। নববর্ষের দিন কিচেনে সরোজিনী দিদির নির্দেশে বড় বড় আটার লুচি, ঘন ছোলার ডাল আর পানতুয় খেতাম। তারপর বৈতালিকের ঘণ্টা। প্রভাতী বৈতালিকে নববর্ষের গান ছিল ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’, নয়তো ‘নব আনন্দে জাগো’। বৈতালিক দিয়ে আশ্রমের জীবন শুরু হয় প্রত্যহ।
আরও পড়ুন
Advertisement
তারপর লাইন বেঁধে আমরা চললাম আম্রকুঞ্জে। লাইব্রেরির পেছনে আম্রকুঞ্জ। সেদিন পয়লা বৈশাখ, আবার ২৫ বৈশাখও উদযাপিত হবে সেদিনই। স্বয়ং গুরুদেব থাকবেন। আগের দিনই মাস্টারমশাইয়ের (নন্দলাল বসু) বড় মেয়ে গৌরীদি আতপ চাল গোলা দিয়ে (নাকি সাদা চক গোলা দিয়ে) আল্পনা দিয়েছেন। গোবর নিকোনে আঙিনায় আল্পনা যেন ঝলমল করছে। আমরা তো যে যার আসন পেতে জোড়াসন হয়ে বসে আছি।
ক্ষিতিমোহন সেন উপস্থিত। সেদিনের গানের দলে থাকতেন ইন্দুদি (ইন্দুলেখা ঘোষ), সংগীতভবনের ছাত্র-ছাত্রীরা (সবার নাম মনে নেই), শৈলজারঞ্জন মজুমদার এসলাজ নিয়ে বসেছেন—‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ গানটি খুব মনে পড়ছে। উত্তরায়ণের দিক থেকে মস্ত গাড়ি চলে এলো, গুরুদেব এলেন। গরদের পাঞ্জাবি আর ধুতি। অমন সুন্দর মানুষ আমি আর দেখিনি, কে-ইবা দেখেছে।
গুরুদেব বসলেন। গানের পর গান হলো। ক্ষিতিমোহন সেনের বক্তব্য আমার খুব ভালো লাগতো, বুঝি আর না বুঝি। আর সব কিছুর পর ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’ গেয়েই প্রভাতী নববর্ষ বন্দনা শেষ হতো।
বুড়িদিও (নন্দিত কৃপালনী) দরাজ গলায় গান গাইতেন। ১৯৩৬ সালেই মোহন মধুকণ্ঠী। ১৯৩৭ সালে সে রেকর্ড করেছিল—‘গান নিয়ে মোর খেলা’—সেটা রবীন্দ্রসংগীত নয়। আমাদের নববর্ষের দিন ফুরোতো রাতের বৈতালিকে ‘বিপুল তরঙ্গ রে’ গান শুনে। রবীন্দ্রনাথের জীবিতকালে, তাঁর সাক্ষাৎ উপস্থিতিতে শান্তিনিকেতনে পয়লা বৈশাখেই ২৫ বৈশাখের অনুষ্ঠানে ১৯৩৬-১৯৩৮ তিন বছর যোগ দিয়েছি। ভাবলে আজ বুঝি কী বিরল সে অভিজ্ঞতা। আর এখন, রাজ্যের মধ্যেই যখন দেখছি, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী’র সদৃশ কাণ্ড; তখন মনে হয়, তিনি স্বাধীনতা বলতে কী চেয়েছিলেন, কী বুঝেছিলেন।’
শুধু গান গেয়ে ও অনুষ্ঠান করেই কি ২৫ বৈশাখ উদযাপন করলে চলবে? আর কিছু করার ছিল না বাঙালির? আমার পরম শ্রদ্ধেয় ক্ষিথীষ মোহন লালের সৌজন্যে আমারও শান্তিনিকেতনে থাকার পরম সৌভাগ্য হয়েছিল। গুনে গুনে প্রায় ছয় মাসের অধিক সময় শান্তিনিকেতনের ছাত্র ছিলাম। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতন যেভাবে চলছিল; এখনো সে ধারায় চলা অব্যাহত আছে। নেই শুধু একজন, যিনি শান্তিনিকেতন সৃষ্টি করেছিলেন। তবে শান্তিনিকেতন এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে রবিঠাকুর বিরাজমান।
লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ।
এসইউ/এমএস