সাহিত্য

হারানোর পর বুঝেছি মা আমার পৃথিবী

হারানোর পর বুঝেছি মা আমার পৃথিবী

ফারদিন খান আনিস

Advertisement

বুকের ভেতরটা একটু হাহাকার করে ওঠে। চারদিকে যখন সন্তানেরা মায়ের হাত ধরে রেস্টুরেন্টে যায়, ছবি তোলে, ফেসবুকে স্টোরি দেয়; আমি তখন কেবল চুপ করে একটি ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। ছবিতে আমার মা, যার চোখে ছিল অনন্ত মমতা। কপালে ছিল আমার জীবনের ছায়া। কণ্ঠে ছিল এমন আশীর্বাদ—যা আমাকে সব সময় আগলে রাখতো। আজ তিনি নেই। তিনি নেই মানে শুধু একজন মানুষ নেই; এমনটি নয়। তিনি নেই মানে আমার অস্তিত্বের ছায়াটুকুও হারিয়ে গেছে।

ফাহমিদা আক্তার স্বপ্না—আমার মা। যাঁকে সমাজ চিনতো একজন শিক্ষিকা হিসেবে। আমি চিনতাম আমার পৃথিবী হিসেবে। ঊনপঞ্চাশ বছর, এগারো মাস আটাশ দিনের এক অনন্য জীবনযাত্রা। যার সমাপ্তি ঘটে ২০২৪ সালের ১১ এপ্রিল। কিডনি ইনফেকশন আর লো প্রেসার আমার বুকটিকে ফাঁকা করে দেয়।

আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন ছিল; যেদিন আমি আমার উপার্জনে মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম সাভার নন্দন পার্কে, বনভোজনে। পঁচিশ বছর পর সেই প্রথম মা বাড়ির বাইরে গেলেন। তা-ও বাবাকে ছাড়া। সেই হাসিটা আমি আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই—যেন কতদিন পর মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মায়ের হাত ধরে হাঁটার সেই মুহূর্তগুলো আজ স্বপ্নের মতো লাগে। সেই প্রথমবার মায়ের জন্য উপহার কিনেছিলাম—তাঁর চোখে পানি আর মুখে যে শান্তির রেখা দেখেছিলাম; তা কোনোদিন ভুলতে পারবো না।

Advertisement

মা ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু। তিনি শুধু আমাদের জন্য বেঁচে ছিলেন। নিজের কোনো শখ, কোনো চাওয়া-পাওয়া রাখেননি। কিছু কিনে দিলে বলতেন, ‘এই টাকা তো পরে কাজে লাগতো।’ তিনি বলতেন, ‘সৎ উপার্জনের ডাল-ভাত অসৎ উপার্জনের দামি খাবারের চেয়েও বরকতময়।’ এ কথা এখন আমার জীবন চলার পথের দিশা।

আরও পড়ুন ফাতেমাতুজ জোহুরার গল্প: বাড়ি নয়, স্মৃতির ধ্বনি  গল্পের ছোটকাগজ ‘গপ্পো’র সাহিত্য আড্ডা 

আজ মা নেই কিন্তু আমার প্রতিটি সকালে তাঁর অভাব জাগ্রত করে। নামাজে মোনাজাত ধরলেই চোখ ভিজে যায়। সারাদিনের ক্লান্তির পর বাসায় ফিরে দেখি, কেউ নেই গামছা দিয়ে মুখ মুছিয়ে দেওয়ার। কেউ নেই তিনবেলা খাওয়ার খবর নেওয়ার। সামাজিক মাধ্যমে কারও মায়ের সঙ্গে ছবি দেখলে চোখ শুধু ভেজে না—ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে।

মা না থাকা মানে শুধু একজন মানুষকে হারানো নয়। মা না থাকা মানে একটি জীবনভর চলা অন্ধকার পথে হাঁটা। যেখানে আলো নেই, আশ্রয় নেই, শুধু বোঝা আর দুঃখের পাহাড়। এখন বুঝি, মা থাকা মানে ছিল এক শান্তিপূর্ণ জীবন, মা না থাকা মানে এক যুদ্ধের মঞ্চ।

তাঁর মৃত্যুর পর আমি শুধু আমার মাকে হারাইনি, হারিয়েছি আমার সবচেয়ে বড় শক্তিকে, আমার আদর্শকে, আমার জীবনের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়কে। কিন্তু আমি আজীবন চেষ্টা করে যাবো তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে—আমার প্রতিটি ভালো কাজের মাধ্যমে, তাঁর স্বপ্ন পূরণ করে, তাঁর আদর্শ ধারণ করে।

Advertisement

যারা এখনো মাকে কাছে পেয়েছেন—তাদের কাছে আমার অনুরোধ, আজ নয়, প্রতিটি দিনই হোক মা দিবস। তাঁর হাতে হাত রাখুন, তাঁকে সময় দিন, ভালোবাসুন। কারণ একদিন হয়তো আর বলার সুযোগ থাকবে না—‘মা, তোমাকে অনেক ভালোবাসি।’

মা, তুমি ছিলে আমার জান্নাত। তুমি ছিলে বলেই আমি ছিলাম। আজ তুমি নেই কিন্তু আমি এখনো তোমার ছায়ায় বেঁচে আছি। যদি শুনতে পাও—জানো, তোমাকে প্রতিটি নিঃশ্বাসে মিস করি। আমার মা—আমার পৃথিবী।

এসইউ/জিকেএস