সাহিত্য

লালন ফকিরের দর্শনই তুলে আনার চেষ্টা করেছি: আবু ইসহাক হোসেন

লালন ফকিরের দর্শনই তুলে আনার চেষ্টা করেছি: আবু ইসহাক হোসেন

আবু ইসহাক হোসেন একজন কবি, গীতিকার ও লালন গবেষক। বাংলা-ইংরেজি ভাষায় সবমিলিয়ে তার ৩৪টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে দেশ-বিদেশের প্রকাশনী থেকে। এর মধ্যে ১৯টির মতো সিরিয়াস একাডেমিক গবেষণাগ্রন্থ। বাকি প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস, ছড়া ও সংকলন। তার উল্লেখযোগ্য বই হলো—‘লালনের তত্ত্বদর্শন’, ‘বাংলা লোকগান’, ‘বাউল দর্শন ও লালনতত্ত্ব’, ‘সাহিত্যের সাতকাহন’, ‘বাংলার মরমি মানস’ প্রভৃতি।

Advertisement

২০২২ সালে ইংরেজি ভাষায় রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘সেন্স অব সেন্স’ ইংল্যান্ডের অলিম্পিয়া পাবলিশার এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশের শোভা প্রকাশ থেকে ‘পোয়েট প্রোফেট লাভার’ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া শোভা প্রকাশ থেকে ২৬০টি গানের ইংরেজি অনুবাদসহ লালন ফকিরের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ ‘মেরিয়াড মিরাকেলস: লালন ফকির অ্যান্ড হিস সংস’ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৯ সালে পলল প্রকাশনী থেকে লালন ফকিরের ওপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগ্রন্থ ‘লালন শাহ: দ্য গ্রেট পোয়েট’ প্রকাশিত হয়।

সম্প্রতি তার গবেষণাকর্ম ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। এই লালন গবেষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কবি ও গবেষক বঙ্গ রাখাল—

জাগো নিউজ: আপনার জন্ম এবং বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই। লেখক জীবনে সেই পরিবেশের প্রভাব কতটা আছে?আবু ইসহাক হোসেন: পারিবারিক তথ্য মোতাবেক ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমার জন্ম। যখন গ্রাম পর্যায়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধের মধ্যে জন্ম হওয়ায় সঠিক তারিখ লিখে রাখা হয়নি। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ থানার তালম ইউনিয়নের তালম গ্রামে জন্ম। শৈশব খুবই নির্মল এবং পবিত্র ছিল। পরিবার বাউল ও সুফি দর্শনে দীক্ষিত হওয়ায় একটা সুচিন্তার পরিবেশের ভেতর দিয়েই বেড়ে ওঠা। প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে সাধুসঙ্গ হতো। বহুকাল আগে থেকেই আমাদের বাউল সাধনা এবং সুফি দর্শনের সাথে আধ্যাত্মিক পরিচয়। শৈশব থেকেই বাউল দর্শন ও সাধনার সাথে পরিচয় ঘটে। এলাকায় আমাদের পরিবারের মাধ্যমেই বাউল দর্শন পরিচিতি লাভ করে। পুরো পরিবার গুরুমুখি বাউল সাধনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল। বাউল ফকির ও পীররা নিয়মিত আমাদের বাড়িতে আসতেন এবং বেশ কিছুদিন অবস্থান করতেন। এ নিয়ে নানা ধরনের ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হতো। সবাই আমাদের পরিবারকে নাড়ার ফকির বলে অবজ্ঞার চোখে দেখতো। কখনো কখনো আমাদের বাড়িতে আগত গুরু-গোসাঁইয়ের ওপর চড়াও হতো। তবুও পরিবারের লোকজন সব প্রতিকূল অবস্থাকে মোকাবিলা করে নিয়মিত সাপ্তাহিক সাধুসঙ্গ চালিয়ে যেতেন।

Advertisement

১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা আসার পূর্ব পর্যন্ত আমি নিয়মিত সাধুসঙ্গে অংশগ্রহণ করতাম। আমার চাচার কোনো সন্তান না থাকায় তিনি আমাকে পালক নেন এবং অনেক আদর করতেন। সে কারণে আমাকে ছেড়ে তিনি কোথাও যেতে পারতেন না। প্রথম কৈশোরে আমি গুরুর কাছে দীক্ষা নেওয়া শুরু করি। বলা চলে আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে লেখাপড়া আর বাউল দর্শনের পাঠ ও বাউল সাধনার ভেতর দিয়ে। এ ছাড়া পরিবারের মেয়েরা নিরক্ষর হওয়ায় বাউল দর্শন ও তত্ত্ব বিষয়ক বই ও পুঁথি তাদের পড়ে শোনাতাম। এ ক্ষেত্রে পাঞ্জু শাহ রচিত ‘ছহি গওহর এস্কে ছাদেকী’ পুঁথিটি ছিল নিয়মিত পাঠের তালিকায়। যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি; তখনই এ পুঁথি পাঠ করে গূঢ়ার্থ আলোচনা করতাম মা-চাচিদের সাথে। এভাবেই মূলত বাউল গান, পুঁথি আমার অবচেতন মনে লেখনির একটি উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে। তাই বলা চলে, আমার পারিবারিক আবহ আমার লেখনির মূল প্রেরণা।

জাগো নিউজ: লালন ফকিরের ওপর কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টি হলো কীভাবে?আবু ইসহাক হোসেন: লালন ফকির, তাঁর দর্শন, তাঁর সাধনা আমার পারিবারিক উত্তরাধিকার। যৌবনে এসে যখন দেখলাম নানা অপচিন্তা, অপসাধক লালন ফকিরের দর্শনের গায়ে নানা ভুল রং লাগাচ্ছে; তখন মনোস্থির করে ফেলি—লালন ফকিরকে নিয়ে কথা বলা ও লেখার বিষয়ে। এভাবেই লালন ফকিরকে নিয়ে গবেষণায় আসা। আমার গবেষণায় একটা জিনিস লক্ষ্য করে থাকবেন—অন্যান্য গবেষণা থেকে একেবারেই আলাদা। আমি লালন ফকিরের বানানো জীবনী বা বানানো গালগল্পকে পাশ কাটিয়ে তাঁর দর্শনটাকেই তুলে আনার চেষ্টা করেছি। যদিও আমি দর্শনের ছাত্র নই কিন্তু লালনকে পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়ার কারণে তাঁর দর্শন বুঝতে এবং বোঝাতে আমার তেমন বেগ পেতে হয়নি বা হচ্ছে না। বলতে পারি, লালন ফকিরের দর্শন সম্পর্কে নতুন ন্যারেটিভ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। আমার গবেষণার মাধ্যমে লালন দর্শনের সৌন্দর্য ও সার্বজনীনতার ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছি।

জাগো নিউজ: কবিতা ও গীতিকবিতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কী বলে মনে করেন?আবু ইসহাক হোসেন: কবিতা ও গীতিকবিতার মধ্যে ভাবগত বা অলংকারগত কোনো পার্থক্য নেই। যা আছে, তা হলো আঙ্গিক। কবিতায় স্বাধীনতা বেশি কিন্তু গীতিকবিতায় ছকের ভেতর থেকে ভাবকে প্রকাশ করতে হয়। বলা চলে প্রত্যেক গীতিকবিতাই স্বার্থক কবিতা হতে পারে কিন্তু প্রত্যেক সার্থক কবিতা গীতিকবিতা না-ও হতে পারে। গীতিকবিতায় বিন্দু দিয়ে সিন্ধুকে উপস্থাপনের দায় রয়েছে। কবিতায় সেটা না করলেও চলে। কবিতা হলো শব্দের মুক্ত আকাশ। গীতিকবিতা খাঁচা। একটি নির্দিষ্ট চৌহদ্দির ভেতরেই গীতিকবিতার ভাব ও শব্দকে চলাফেরা করতে হয়। বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই অনেক গীতিকবি আঙ্গিকের খাঁচাটা ভাঙার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য গীতিকবিতা এখন অনেকটাই স্বাধীন।

জাগো নিউজ: শিল্পের কোন কোন বিষয় আপনাকে আলোড়িত করে? কেন করে?আবু ইসহাক হোসেন: শিল্প হলো আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংস্কারের মাধ্যম। শিল্পের মাধ্যমে ব্যক্তির আত্মোৎকর্ষ লাভ হয়। তাই শিল্পের সব মাধ্যমই আমার কাছে আকর্ষণীয়। কারণ কোনো ব্যক্তিকে তার আপন সত্তার সর্বমাঙ্গলিক দিকটাকে আবিষ্কার করার জন্য শিল্পচর্চার কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রতিটি মানুষের জীবনে শিল্পচর্চা অপরিহার্য সেটা যে ফর্মেই হোক না কেন। আমার জানামতে, কেবল মানুষেই সর্বমাঙ্গলিক বোধ প্রখর। তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটে শিল্পচর্চার মাধ্যমে। সে কারণে আমার কাছে শিল্পের সব ফর্মই সমান। তবে কবিতা ব্যক্তি-আমিকে বেশি টানে। তার কারণ আমার কাছে কবিতা ঘোমটার আড়ালে লুকানো রহস্যময় সুন্দরী রমণি। ঘোমটার আড়ালটা সরানোর সক্ষমতা তাকে সৌন্দর্য ও রহস্যের স্বাদ দিয়ে থাকে। মানবজীবন একই সাথে সুন্দর ও রহস্যে ঘেরা। তাই মানবজীবনকেও আমার কাছে কবিতার সমার্থক মনে হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন বই থাকলে সভ্যতা-সংস্কৃতি টিকে থাকবে: শফিক হাসান  নিরাশ হয়েছি কিন্তু ভেঙে পড়িনি: অঞ্জন হাসান পবন 

জাগো নিউজ: লালনের সাধনাচার কিংবা গান আমাদের কী শিক্ষা দেয়?আবু ইসহাক হোসেন: লালন ফকিরের গান আমাদের মূলত মুক্তির দিশা দেয়। এই মুক্তি মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তি। আমরা মনে করি ভৌগলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিস্বাধীনতাই মানুষের প্রকৃত মুক্তি। আসলে কিন্তু তা নয়—মানুষ ভৌগলিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রাণী নয়, মানুষ সামাজিক প্রাণী। ভৌগলিক সীমা দ্বারা মানুষ আবদ্ধ নয়। মানুষ আবদ্ধ তার সমাজ দ্বারা। তার নিজেকে আবিষ্কারের অক্ষমতা দ্বারা। তাই মানুষের মুক্তি ভৌগলিক মুক্তির মধ্যে নয় বা রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক মুক্তির মধ্যে নয়। মানুষের প্রকৃত মুক্তি তার আত্মাবিষ্কার ও সামাজিক বন্ধন মুক্তির ভেতরে। লালন ফকিরের গান মূলত মানুষের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির সোপান। অর্থাৎ মানুষ সত্তার প্রকৃত মুক্তির গান হলো লালন ফকিরের গান।

জাগো নিউজ: মহাজন সাধক-ফকিরদের জীবন-যাপন নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?আবু ইসহাক হোসেন: লালন ফকিরের দর্শনে সত্বঃগুণে সাধু। যিনি রজঃ, ও তমঃ গুণকে জয় করতে পারেনি। তিনি সাধু নন। তাই সাধু নির্বাচনে আমাদের প্রথমেই যেটি মানদণ্ড ধরতে হবে—তা হলো তার সাত্বিকগুণ। যিনি সাত্বিক গুণের অধিকারী—তার আচার-বিচার শুদ্ধ ও সত্য। লালন ফকির তাই বলেছেন, ‘সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন/ সত্য সুপথ না চিনিলে পাবিনে মানুষের দরশন’। যার মধ্যে সাত্বিক গুণ নেই, যিনি সত্য সুপথের পূজা করেন না; তিনি ধ্বজা ধরে যতই মজা লুটুক—তাকে সাধু বলা চলে না। আজকাল ধ্বজা ধরে মজা লোটা সাধুর সংখ্যাই বেশি—এসব সাধুরা সেলিব্রেটি। নগরে বিকানো পণ্য।

জাগো নিউজ: লালনের গান সাধারণ মানুষকে কতটা প্রভাবিত করতে পেরেছে বলে মনে করেন?আবু ইসহাক হোসেন: সাধারণ মানুষ লালন ফকিরের গানে বিনোদন খোঁজে ও বিনোদিত হয়। লালন ফকির তো কখনো বিনোদনের জন্য কোনো গান রচনা করেননি। ভক্ত-অনুরাগী ও গবেষকগণ বলে থাকেন, লালন ফকিরের ভেতর যখন ভাবের উদ্রেক হতো, তখন তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন, ‘এই তোরা কে কোথায় আছিস, আমার পোনামাছের ঝাঁক এসেছে।’ এই বলে তিনি ভাবের ঘোরে গান গেয়ে যেতেন। তাঁর শিষ্যেরা যে যেখানে থাকুক এসে তাঁর সাথে সঙ্গত করতেন। তাহলে বিনোদনটা কোথায় পেলেন? লালন ফকিরের গান ভাবের গান, চিন্তার মুক্তির গান, আত্ম-আবিষ্কারের গান। সাধারণ মানুষ কি আত্ম-আবিষ্কারের জন্য লালন ফকিরের গান শোনেন? শুধু সাধারণ মানুষের কথাই বলছি কেন; তথাকথিত লালন ফকিরের ভক্ত-অনুরাগী যাদের আমরা বলছি—তারাই কি লালন ফকিরের গানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যময় দর্শনটি বোঝেন? উত্তর মনে হয়, না। যার কারণে লালন ফকিরের বাণিতেই বলতে হয়, ‘ঠাকুর গড়িতে বানর হলো রে।’

জাগো নিউজ: সাধক-ফকিরদের আমরা আর্থিকভাবে কতটা মুক্তি বা সম্মান দিতে পেরেছি?আবু ইসহাক হোসেন: মুক্তি কখনো দয়ার দান নয়। সম্মান বা মুক্তি দেওয়ার বিষয় নয়—এটি অর্জন করতে হয়। যিনি অর্জন করবেন এবং যারা বুঝবেন, তাদের মধ্যে একটা মানসিক সাম্যতা নির্ণয় করা গেলেই এই দেবার ও নেবার দ্বন্দ্ব ঘুচবে বলে আমার বিশ্বাস। অর্থনৈতিক মুক্তির সাথে কর্ম, উৎপাদনশীলতা, উপযোগিতা এবং ভোগের সম্পর্ক বিদ্যমান। একজন সাধক কতটা কর্মী এবং কতটা ভোগী তার ওপর নির্ভর করবে তার অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য—মুক্তির বিষয় এখানে অপ্রাসঙ্গিক।

জাগো নিউজ: লালনের জন্ম ও ধর্ম নিয়ে কতটা সঠিক কাজ হয়েছে বলে মনে করেন?আবু ইসহাক হোসেন: লালন ফকিরের জন্ম আমার কাছে গৌণ বিষয়। মুখ্য হলো তাঁর কর্ম। লালন ফকিরের সময়কাল হতে আজ অবধি কোটি কোটি মানুষ জন্মগ্রহণ করেছেন। তাদের আমরা জানি না, চিনি না। যাদের জানি, চিনি; তাদের জন্মের জন্য নয়—কর্মের জন্যই চিনি। রবীন্দ্রনাথ জমিদার পরিবারে জন্মেছেন বলে তাঁকে আমি মান্য করি না। এমন জমিদার অনেক ছিল। কিন্তু আমরা রবীন্দ্রনাথকে মান্য করি। নজরুলের বেলায়ও একই কথা। অনেকেই গরিব ঘরে জন্ম নিয়ে রুটির দোকানে, চায়ের দোকানে কাজ করেছেন—তারা কেউই আমাদের কাছে মান্য নয়। কিন্তু নজরুল আমাদের জাতীয় কবি, তাঁর কর্মের জন্য—জন্মের জন্য নয়। তাই লালন ফকিরের কর্মটাকেই প্রাধান্য দিতে চাই। এ বিষয়ে খুব সিরিয়াস কাজ যে হয়েছে, তা বলা চলে না। সম্প্রতি নিজের লেখা ‘লালনের ধর্ম’ শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে হাওলাদার প্রকাশনী হতে। গ্রন্থ রচনা করার পর দীর্ঘদিন আমি প্রকাশনায় যাইনি কিন্তু অনেক চিন্তা ভাবনা করে শেষে প্রকাশের পথে হেঁটেছি। কারণ লালন ফকির ও তাঁর দর্শন নিয়ে এত বেশি অপচর্চা হচ্ছে—আমার মনে হয়েছে এখনই বইটি প্রকাশ না করা গেলে লালন ফকিরের ধর্ম নিয়েও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। পাঠকরা বইটি পাঠ করে বলতে পারবেন, লালন ফকিরের ধর্ম নিয়ে প্রথম গবেষণাধর্মী বইটি কতটা প্রাসঙ্গিক।

জাগো নিউজ: লালন ফকিরকে নিয়ে বেশকিছু কাজ করেছেন বা করে যাচ্ছেন—লালন সাধনার মূল বার্তা কী আপনার মতে?আবু ইসহাক হোসেন: বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে এ পর্যন্ত দশটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিছু পাণ্ডুলিপি শেষ পর্যায়ে আছে। এসব গ্রন্থে মূলত নানামাত্রিক লালনকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রথাগত লালনচর্চার বাইরে দাঁড়িয়ে লালন ফকিরকে নতুন চোখে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। প্রাধান্যটা লালন ফকিরের দর্শনের ওপর থাকলেও লালন ফকির যে তাঁর দর্শন ও সাধনার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছেন; সেটিও আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি। শুধু তা-ই নয়—বাংলার রেনেসাঁসেও লালন ফকিরের অবদান ছিল। সেটিও তুলে এনেছি ‘লালন ফকির ও বাংলার রেনেসাঁস’ গ্রন্থে। ঠিক একইভাবে ‘লালনের তত্ত্বদর্শন’ গ্রন্থে তাঁর সাধনা ও সংগ্রামকে তুলে আনা হয়েছে। তাই বলা চলে, তথাকথিত লালনচর্চার হুজুগকে পাশ কাটিয়ে পরিপূর্ণ লালন ফকিরকে আবিষ্কারই আমার গবেষণার সার। লালন দর্শনের মূল বার্তা সম্পর্কে পূর্বেই বলা হয়ে গেছে। মূলত মানুষের পরিপূর্ণ মুক্তিই হলো লালন দর্শনের মূল সারাৎসার।

জাগো নিউজ: আপনার আগে কে কে লালনকে নিয়ে তথ্যবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন এবং সেগুলো কী—যদি জানাতেন।আবু ইসহাক হোসেন: কাজের গুরুত্ব সময় বিবেচনা করবে। তবে শুরু থেকে এ পর্যন্ত যাঁরাই লালন ফকিরকে নিয়ে কাজ করেছেন এবং করছেন—সবার কথাই সমান গুরুত্বের সাথে তুলে ধরতে হবে। এ মুহূর্তে যাঁদের কথা মনে পড়ছে; সেই কাঙাল হরিনাথ মজুমদার থেকে শুরু করে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাই চরণ দাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দিরা দেবী, সরলা দেবী, আবদুল ওয়ালী, বসন্ত কুমার পাল, মতিলাল দাশ, অধ্যাপক মনসুরউদ্দিন, অধ্যাপক আনোয়ারুল করিম, অধ্যাপক শক্তিনাথ ঝাঁ, সুধীর চক্রবর্তী, অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরী, রিয়াজুল খোন্দকার এবং আজ যারা লালন ফকিরকে নিয়ে গবেষণা করছেন—সবার কথাই বলতে হবে। এখানে এ কথা স্বীকার করতে হবে, উল্লিখিত গবেষকগণের বাইরেও অনেকে কাজ করেছেন কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম স্মরণে আসছে না। তাদেরও ভুললে চলবে না।

এসইউ/জিকেএস