কুমিল্লায় আলুর বাম্পার ফলন হলেও সংরক্ষণ ও ন্যায্যদাম নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। নিজেদের উৎপাদিত আলু এখন গলার কাটা। স্থানীয় কোল্ড স্টোরেজগুলোতেও জায়গা না পাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে কোনো রকম ত্রিপল টানিয়ে সংরক্ষণ করছেন। অনেকের আলুতে পচনও ধরেছে। দাম বাড়ার আশায় দীর্ঘ দেড় মাসেরও বেশি সময় অপেক্ষার পরও এখন কম দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেক কৃষক।
Advertisement
সরেজমিনে জেলার বুড়িচংয়ের মিথলমা, আবিদপুর, মনঘাটা, শিকারপুর, পাঁচকিত্তা, হালাগাও, লোয়ার চর, কাকিয়ার চর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খোলা জায়গায়, গাছতলায়, বাড়ির উঠোন ও ঘরের ভেতর আলুর স্তূপ। অনেকেই আবার জমিতেই স্তূপ করে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রেখেছেন আলু। কেউ আবার ত্রিপল খুলে বেছে বেছে পচা ও পোকায় খাওয়া আলু ফেলে দিচ্ছেন।
একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিমণ আলু উৎপাদন করতে সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ৭৫০-৮০০ টাকা। অথচ বাজারে এক মণ আলু পাইকারি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫৫০-৬০০ টাকা দরে। যার কারণে বাধ্য হয়ে দেশীয় কায়দায় তারা আলু সংরক্ষণ করছেন। তবে বৃষ্টি হলে অপরিকল্পিত সংরক্ষণের কারণে কৃষকের স্বপ্ন পচে যাবে।
কৃষক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বীজ, হাল চাষ, সার, ওষুধ ও কামলা খরচসহ সব মিলিয়ে প্রতি মণ আলু উৎপাদন করতে খরচ প্রায় ৭৫০ টাকা। অথচ এখন বাজারে আলু বিক্রি করতে চাইলে পাইকাররা বলছে এক মণের দাম ৫৫০-৬০০ টাকা। যার কারণে আলু বিক্রি করতে পারছি না আমরা। আমার বাড়ির উঠানে ৫০০ মণ আলু ত্রিপল দিয়ে ডেকে রেখেছি। অনেকেই আমর মতো ঝুঁকি নিয়েই বাড়ির উঠোনে আলু জমা করে রেখেছে। যদি একটু দাম বাড়ে তাহলেই ছেড়ে দেবে। আর যদি এরমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয় তাহলে সব শেষ। এবার যে শিক্ষা হয়েছে সামনের দিকে আর আলু চাষ করা যাবে না।
Advertisement
মোস্তফা মিয়া নামে এক কৃষক বলেন, প্রতি কেজি আলু ১৩ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি করছি। অথচ বাজারে খুচরা আলু বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা। আমরা আলু উৎপাদন করে কি দোষ করে ফেলেছি? মৌসুম শেষে মজুত কমে এলে ১৩ টাকার আলুই বিক্রি হবে ৫০-৬০ টাকা দরে। আমরা যদি নিজেরা এই আলু সংরক্ষণ করতে পারতাম, তাহলে মজুতদারদের পরিবর্তে লাভবান আমরাই হতাম।
আলু চাষি সুমন মিয়া বলেন, শখের বসে এ বছর ৪২ শতক জমিতে আলু লাগিয়েছি। ফলনও ভালো হয়েছে। বর্তমানে আমার কাছে প্রায় ৬০ মন আলু রয়েছে। অন্যান্য বছর দেখি পাইকাররা বাড়িতে এসে আলু নিয়ে যায়, কিন্তু এবার কেউই আসছে না। শুনেছি নিমসার বাজারে উত্তরবঙ্গ থেকে আনা আলু বেশি বিক্রি হচ্ছে। গ্রাম থেকে আলু সংগ্রহ করতে হলে শ্রমিক খরচ এবং পরিবহন দুটোই লাগে, তাই তারা এদিকে আগ্রহ দেখায় না।
কৃষকদের অভিযোগ, উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আনা আলু পরিবহন খরচসহ অন্যান্য খরচে দেখিয়ে বেশি দামে বিক্রি করা যায়। যারা ট্রাকে করে আলু পাঠান সে আলুর সংরক্ষণের দায়িত্ব তাদেরই থাকে। বিক্রি না হলে পচে যাওয়ার ক্ষতির দায় না থাকায় আড়তদাররা বাইরে থেকে আসা আলু ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেন বেশি। অন্যদিকে যারা আলু বেসরকারিভাবে মজুত করেন তাদের আলু দিয়ে ভর্তি হয়ে গেছে স্থানীয় কোল্ড স্টোরেজগুলো।
নিমসার বাজারের আলুর আড়তদার মো. আজিম বলেন, সারা বাংলাদেশের কোল্ড স্টোরেজের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। জানামতে কোথায়ও জায়গা নেই। তারপরও সরকার যদি খোঁজ নিয়ে কোল্ড স্টোরেজগুলোতে জায়গা করতে পারে, তাহলে আমাদের স্থানীয় আলুগুলো রাখার ব্যবস্থা করলে কৃষক বেঁচে যাবে। এই বিপুল পরিমাণ আলু পচনের হাত থেকে বাঁচানো গেলে আলুর দাম মানুষের নাগালের মধ্যে সারা বছরই থাকবে।
Advertisement
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আইউব মাহমুদ বলেন, এবছর জেলায় আলু চাষে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ২৫৪ হেক্টর জমি। উৎপাদন হয়েছে ৯ হাজার ৬১ একর জমিতে। ফলন উৎপাদন হয়েছে ২২ লাখ ৯০ হাজার ৭৮ টন, যা গত বছরের তুলনায় বেশি। আমরা ২০২৪ সালের বন্যার পর চেষ্টা করেছি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে আলু চাষ করতে হয়। যেসব জমিতে আলু চাষ হয়েছে ফলন খুবই ভালো। কিন্তু যে পরিমাণ আলু এখনো অবিক্রীত রয়ে গেছ এসব বিষয় নিয়ে কাজ করবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।
জাহিদ পাটোয়ারী/জেডএইচ/জেআইএম