সাহিত্য

সফিউল ইসলামের গল্প: অপেক্ষা

সফিউল ইসলামের গল্প: অপেক্ষা

আজ তার চলে যাওয়ার দিন। এই দিনই আমাদের পরিচয়ের প্রথম দিন এবং সম্পর্কের ইতি টানার দিন।

Advertisement

বলছিলাম আমার প্রিয় মানুষ, আমার দেওয়া নাম মায়াবতীর কথা। একটি ইভেন্টে টুকিটাকি কথা হয়। কাকতালীয় ভাবে কলেজে এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়। সেই থেকে আমাদের প্রণয় এবং পরিণয়।

আজ তার চলে যাওয়ার দুই বছর। ঠিক দুই বছর আগে তার খুব মাথা ব্যথা হয়। তখনো আমাদের বিয়ে হয়নি। তার আব্বা আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে জানেন বেশ কিছুদিন পর। আমাকে তার আব্বার পরিচিত একটি রেস্টুরেন্টে ডাকেন। আমি কোনো ভয় না পেয়ে যাই। তিনি খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে বলেন, আমি তার মেয়ের যোগ্য নই। ঠিক সে সময়টা আমার মনে হচ্ছিলো, আমি কোনো সিনেমার শুটিংয়ে আছি। কিন্তু যখন বলে উঠলেন, আমার সাথে বিয়ে হবে না। তা কখনোই সম্ভব নয়। তখন আমার গায়ে যেন কেউ আগুনের তেজ দিচ্ছে। আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরছে অবিরত। আমি জিজ্ঞেস করি, কেন? তিনি বলেন, তুমি মায়াবতীর যোগ্য না। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করি, যোগ্য হতে হলে আমার কী করতে হবে? তিনি ভালো চাকরি ও সম্পদের পরিমাণ জানান। তখন উত্তরে শুধু এটুকুই বলেছিলাম, আপনার মেয়ের যোগ্য হতে তেমন দেরি হবে না। শুধু আপনি কথা দিন, আমি যোগ্য হয়ে আসার আগপর্যন্ত ওকে জোর করে বিয়ে দিবেন না। যদি না সে নিজ ইচ্ছায় চায়। তিনি রাজি হোন। তবে শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন, কথা বলা যাবে না ওর সাথে। তখন বলি, এটা সম্ভব না। তিনি মাসে একটি দিন আমাদের কথা বলার অনুমতি দেন। তা-ও অল্প সময়।

সেই থেকে মায়াবতীর সাথে কথা কম হতো। এর মাঝে অনেক দিন কেটে যায়। বেশ কিছুদিন আমাদের কথা হয়নি। আমি দেশের বাইরে ছিলাম ব্যবসায়ের কাজে। দেশে আসার পর দিনই হঠাৎ তার আব্বার কল। রিসিভ করা হয়নি। তখন আমি নামাজ পড়ছিলাম। নামাজ শেষে মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নম্বর দেখে একটু অবাক হই। এরপর কিছু না ভেবেই কল দিই। জানতে পারি, মায়াবতী অসুস্থ। তারা চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে যাচ্ছেন। সে আমাকে দেখতে চায়।

Advertisement

আমি বাড়ি এসে তাড়াহুড়ো করে বের হই। গাড়িতে উঠেছি ঠিক কিন্তু অপেক্ষার প্রহর যেন শেষই হচ্ছে না। আমি যাওয়ার পর থেকে ওর সাথে থাকতে হয়েছে সারাক্ষণ। প্রথম দিন কেটে গেল। ওর মুখ থেকে কোনো কথা শুনতে পাইনি। বুকটা যেন ভারী হয়ে আসছে। ডাক্তারও কিছু বলছেন না। কিছুক্ষণ পর পর নার্স আসেন। কী যেন পুশ করে আবার চলে যাচ্ছেন। অনেকক্ষণ পর ডাক্তার আসেন। তিনি ধৈর্য ধরে আল্লাহকে ডাকতে বলে চলে গেলেন।

হাসপাতালের দ্বিতীয় দিন। ডাক্তার বলেছেন, ওর ব্রেন টিউমার হয়েছে। হাতে সময় কম। আমি ওর বাবার সাথে কথা বলি। ওর অপূর্ণ ইচ্ছেগুলোর কথা বলি। মায়াবতীর একটি ইচ্ছা ছিলো, জীবনের শেষদিন হলেও সেদিন ও আমার বউ সাজবে। খুব বেশি মানুষ থাকবে না। কয়েকজন নিয়েই আমাদের বিয়ে হবে। অপেক্ষার প্রহরও শেষ হওয়ার সময় যেন এসেছে। তখন তার বাবার দেওয়া শর্ত পূরণ হয়েছে। তিনিও এককথায় রাজি হোন।

হাসপাতালের সপ্তম দিন। মায়াবতী কথা বলা এবং উঠে বসার শক্তি পায়। ওর সম্মতিক্রমে আমার এবং মায়াবতীর বিয়ে হয় হাসপাতালের কেবিনে। ডাক্তার বলেন, আপনারা রোগিকে কেয়ার করুন, যতদিন বাঁচে। আপনাদের কেয়ার ও ভালোবাসায় হয়তো আরও কয়েকটা দিন বেশি বাঁচতে পারেন।

আমরা বাড়ি চলে আসি। চলছে আমাদের সংসার জীবন। একদিন মায়াবতী বলে, আমার খুব ইচ্ছে তোমার কোলে মাথা রাখবো। আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েছিল সে রাতে। সুস্থ মানুষের মতো সুন্দর করে কত কথা বলছিল ঘুমানোর আগে।

Advertisement

পরদিন শরীরটা আবার খারাপ হতে থাকে। হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার চেকআপ করে বলেন, সময় একেবারে সন্নিকটে। ভয় আরও বাড়লো। রাত অনেক গভীর। ওর জ্ঞান ফেরে। আমাদের অনেক কথা হয়।

সকালবেলা আজান শুনে আমাকে বলে, যান নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করে আসেন। আমি আপনার দোয়ার অপেক্ষায় রইলাম। নামাজ পড়ে এসে ওর সাথে সকালের নাস্তা শেষ করি। কিছুক্ষণ পর ওর প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হচ্ছিলো। ডাক্তার এলো। ও তখন আমার হাত ধরে আছে। কিছুক্ষণ পর আমার হাত ছেড়ে দেয়। ডাক্তার জানান, উনি আর আমাদের মাঝে নেই। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

জ্ঞান ফেরার পর তার মরদেহ নিয়ে রওয়ানা হই। আমার কানে বাজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে ও বলেছিলো, আমার স্থানটা কখনো পূরণ করবেন না। কথা দিন। সে দিনের ওই কথার পর আমি বলেছিলাম, ধুর পাগলি, তোমার স্থান কখনোই শূন্য হবে না।

আমি কখনো মানতে পারতাম না, ও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। এটি মনে হয় সব ভালোবাসার মানুষেরই মনে হয়। এরপর আর কথা হয়নি। শূন্যস্থান আজও পূর্ণ করিনি। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তার আগমন ও প্রস্থানের মাস হিসেবে আমার কাছে পরিচিত। তবে আনন্দের বিষয়, আমিও অপেক্ষায় মায়াবতীর সাক্ষাতের জন্য। আজ আমিও ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফেনী সরকারি কলেজ, ফেনী।

এসইউ/জিকেএস