সাহিত্য

মো. তৌহিদুজ্জামানের গল্প: রফুর ঈদ আনন্দ

মো. তৌহিদুজ্জামানের গল্প: রফুর ঈদ আনন্দ

মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙে রফিজ মিয়ার। ঈদের দিন, তাই বস্তির ছেলেমেয়েদের উচ্ছ্বাস একটু বেশিই। ঘর থেকে বের হয়েই তাদের দৌড়ঝাঁপ দেখে হাসি ফোটে রফুর মুখে।

Advertisement

ও হ্যাঁ, বস্তির সবাই তাকে ‘রফু’ বলেই ডাকে। সহজ-সরল মানুষটা রিকশা চালায়। আপনজন বলতে কেউ নেই। বহু বছর আগে এক ভয়াল বন্যায় নদীর ঢেউ তার পরিবারকে কেড়ে নিয়েছে। রফু সেদিন বেঁচে গিয়েছিল কিন্তু পরিবার হারানোর ক্ষত আজও শুকায়নি।

মাধ্যমিকে পড়া থামিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু করা রফু এখন বস্তির ছেলেমেয়েদের অ আ ক খ শেখায়। তাই রিকশাওয়ালা হলেও সে তাদের কাছে শিক্ষক। ঈদের সকালে সেই ছোট্ট ছাত্র-ছাত্রীরা কেউ সেমাই, কেউবা মায়ের হাতে বানানো মোয়া নিয়ে হাজির। রফুর জন্য এটাই সবচেয়ে বড় উপহার।

গোসল সেরে দু’এক চামচ সেমাই আর মোয়া খেয়েই রফু বেরিয়ে পড়ে রিকশা নিয়ে। মোড়ের দোকানে গিয়ে রতন ময়রাকে বলে–: দাদা, দুই কেজি রসগোল্লা দিবেন?: রিকশা নিয়ে বেরিয়েছো, রসগোল্লা দিয়ে কী করবে? আত্মীয় বাড়ি যাবা নাকি?: না রে দাদা, তাড়াতাড়ি দাও।রফু রসগোল্লা রিকশার সিটের নিচে রাখে। এরপর গেয়ে ওঠে কাজী নজরুলের সেই চিরচেনা গান—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ...’

Advertisement

রফু থামে এক ট্রাফিক পুলিশের সামনে। রোদে পুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ভাইকে দেখে প্রশ্ন ছোঁড়ে–: ভাই, ঈদের দিন বাড়ি যান নাই?: আমাদের আর ঈদ কই ভাই? ডিউটি করি, ছুটি পরে দেখবো।: এই নেন রসগোল্লা।: কিসের রসগোল্লা, ভাই?: আমার তো কেউ নাই। দুই কেজি রসগোল্লা কিনেছি। পথে যাদের পাবো, তাদের দেবো। আপনার মতো যারা কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের জন্যই তো আমার এই চেষ্টা।পুলিশ ভাই প্রথমে নিতে চান না। পরে রফুর হাসিমুখের পীড়াপীড়িতে একটা রসগোল্লা নেন।

বিদ্যুৎ অফিসের সামনে দুই কর্মী বাইকে বের হচ্ছেন। রফু তাদেরও ডেকে প্রশ্ন করে–: ভাই, কই যান ঈদের দিন?: লাইনে নাকি সমস্যা হয়েছে, ঠিক করতে যাচ্ছি। নিজের আনন্দ রেখে তো মানুষের সেবায় নামছি।: এই নেন, আপনাদের জন্যই তো আমার এই আয়োজন!কর্মীরা অবাক হয়ে রফুর দিকে তাকায়। একজন বলে, ‘আপনার জন্য আজ সত্যি ঈদের আনন্দ মনে হচ্ছে, ভাই!’

সারাদিন মানুষের খোঁজ নিয়ে ক্লান্ত রফু পার্কের এক গাছতলায় বসে। হঠাৎ এক সাংবাদিক হাজির।: ভাই, বাড়ি যান নাই?: না ভাই, কুরবানির ঈদে যাবো। এইবার ছুটি পাইনি।: ও আচ্ছা, রসগোল্লা খান ভাই।: কিসের রসগোল্লা?: আমি রিকশা চালাই, থাকি বস্তিতে। আজ বের হয়েছি তাদের দেখতে, যারা নিজের আনন্দ ছেড়ে দায়িত্ব পালন করছেন। খালি মুখে তো আর কথা বলা যায় না, তাই রসগোল্লা কিনেছি। এটাতেই আমার আনন্দ, বুঝলেন ভাই?সাংবাদিক হাসিমুখে রসগোল্লা নেন। ক্যামেরাম্যানকেও দেয় রফু।

সন্ধ্যা নামে। রফু বস্তির পথে ফেরে। মোড়ের দোকান থেকে বাচ্চাদের জন্য লজেন্স কিনে নেয়। তখনই চোখে পড়ে দোকানের টিভিতে তার মুখ। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সাংবাদিকের ক্যামেরায় বন্দি রফুর মানবিকতার গল্প এখন সবার সামনে।

Advertisement

বস্তিতে ঢুকতেই ছুটে আসে বাচ্চারা। লজেন্স পেয়ে উল্লাসে মেতে ওঠে তারা। বাচ্চাদের সেই নিষ্পাপ হাসিমুখে রফু যেন নিজের হারানো পরিবারের ছায়া খুঁজে পায়। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মনে হয়, এ আনন্দ আর শেষ হওয়ার নয়। এই ঈদ আনন্দ যেন রফুর নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসার প্রস্ফুটন।

এসইউ/এমএস