রহমত, বরকত, নাজাতের তিন মহাসুযোগ পবিত্র মাহে রমজানে। তা সকল মুসলিম উম্মাহর জন্যই। অন্যদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার পড়েছে ভিন্ন তিন পরীক্ষায়। পয়লা নম্বরেই নিত্যপণ্যের বাজার, দ্বিতীয় আইনশৃঙ্খলা। আর তৃতীয় নম্বরে সড়ক-মহাসড়ক ব্যবস্থাপনা, মানে যানজট পরিস্থিতি । এ তিন পরীক্ষাতেই সরকারের স্টাডি তথা আগাম চেষ্টা ও সতর্কতা স্পষ্ট। নানান মন্দের মাঝে এটি অন্যতম ভালো দিক। রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে মানুষের কাছাকাছি যেতে রমজানে বরাবরই কিছু কর্মসূচি থাকে। ইফতার পার্টি, ইফতার ও উপহারসহ জরুরি সামগ্রী বিতরণ, কোলাকুলি- মোলাকাতে নানা সেক্টরের সঙ্গে সংযোগের একটা সুযোগ প্রথাগতভাবেই তারা নেয় এ মাসটিতে। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ইউনূস সরকারের ক্ষমতার পাটাতন, মানে চব্বিশে বিপ্লব ঘটানোর ফ্রন্টলাইনার ছাত্রদের নতুন দল তা করছে আরো ব্যতিক্রমভাবে। ছিন্নমূলসহ বিভিন্ন প্রান্তিক শ্রেণির সঙ্গে ইফতার করছে ঘাটে মাঠে। চেষ্টা করছে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের আরো নানা পথ নিয়ে। রমজান মৌসুমের অন্যতম যন্ত্রণা যানজট নিরসনে আবার রাস্তায় নামার চিন্তাও আছে তাদের। সেইসঙ্গে স্যোশাল মিডিয়ায় চমৎকার তৎপরতাও রয়েছে। নিয়মিত দিচ্ছে সতর্কতামূলক পোস্ট।
Advertisement
একজন সমন্বয়ক তথা নাগরিক পার্টির শীর্ষ নেতার দেয়া পোস্ট ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে। তিনি মানুষকে জরুরি সতর্কতা দিয়ে লিখেছেন, রমজান মাসে সারাদেশে গণডাকাতির পরিকল্পনা করতে পারে দুর্বৃত্তরা। তারাবির নামাজের সময় রাত ৮টা থেকে ১০ টার মধ্যে ডাকাতির প্রস্তুতি নিতে পারে তারা। এই সময়ে পুরুষরা মসজিদে তারাবির নামাজে ব্যস্ত থাকবে-তখন বাসা বাড়ি পুরুষ শূন্য থাকবে। বাসা বাড়িতে ডাকাতির ফাঁকে হত্যাকাণ্ড, এমন কি ধর্ষণের ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করতে পারে দুর্বৃত্তরা।
দায়িত্বশীলতার প্রশ্নে এটি অবশ্যই উত্তম সতর্কতামূলক বার্তা। বলার তো অপেক্ষা রাখে না, সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে দেশ অস্থির করার হেন কাজ নেই, যা পরাজিত-বিতাড়িতরা না করতে পারে। সেই দক্ষতা-অভিজ্ঞতায় তারা আনপ্যারালাল। এর বাইরে এবারের রমজানে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও যানজট নিরসন সরকারের জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় সরকারকে পাস করতেই হবে। নইলে নির্বাচন, সংস্কারসহ সামনের কাজগুলোতে অন্ধকার নামবে। এতে কেবল সরকার নয়, গোটা দেশই চরম নাকানিচুবানিতে পড়বে।
বিশেষ চক্র বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও করে দিয়েছে। রমজান মাস এলে কৃত্রিমভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ছাড়াও অপরাধী চক্র সক্রিয় হয় ছিনতাই, চুরি, ডাকাতিসহ নানা নৈরাজ্য কর্মকাণ্ডে। অতীতে সরকারের মদদপুষ্ট সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজ গ্রুপ ও দলীয় সন্ত্রাসীরা জড়িত থাকত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্দিষ্ট কোনো দলের সরকার নয়। তাদের মদদপুষ্ট সিন্ডিকেট বা চাঁদাবাজ গ্রুপ অবশ্যই নেই। এর সুফল বাজারে পড়ুক সেটিই আমাদের কাম্য।
Advertisement
রমজানে আইনশৃঙ্খলা, যানজট নিরসনসহ সারাদেশে যোগাযোগব্যবস্থায় জনভোগান্তি দূর করতে বিশেষ উদ্যোগও কাম্য। এরইমধ্যে সরকারের সে ধরনের কিছু পদক্ষেপ মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে। ভোজ্য তেলসহ কিছু পণ্যে শত চেষ্টা করেও কুলাতে পারছে না সরকার। চিনি, ছোলা, আলু, পেঁয়াজসহ রমজানের অন্যান্য জরুরি পণ্যের বাজার পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত সন্তোষজনক। যানবাহন পরিস্থিতি গতানুগতিক। রমজানের প্রথম কয়েকদিন রাজধানীর রাস্তাগুলোতে গাড়ির চাপ থাকলেও যানজট এখনো তীব্র নয়।
রমজানে অফিস সময়সূচি পরিবর্তন, ঈদের বাড়তি কেনাকাটা ও বাড়িফেরার সময় হয়ে এলে চাপ বাড়ে সড়কে। প্রতি বছর রমজানের প্রথম দিনে সাধারণত অসহনীয় যানজটে পড়তে হয় নগরবাসীকে। তবে এবার প্রথম দু-দিন চিত্র কিছুটা ভিন্ন। মহানগরীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, ট্র্যাফিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং যানজট নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি। রমজানে যানজট নিরসনে বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত সব কটি থানার মোবাইল টিম সড়কে কাজ করবে। একই সময়ে সড়কে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অতিরিক্ত ফোর্স থাকবে আড়াই ‘শ। ৬০০ ছাত্র ভলান্টিয়ারও কাজ করবেন। রাজধানীর ট্রাফিকব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য বছরব্যাপী সড়কে কাজ করা সাড়ে চার হাজার ট্র্যাফিক সদস্য তো আছেনই। রোজার সময় শপিংমল, ব্যাংক, বিমা, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল ও সদরঘাটসহ অন্য জায়গায় মানুষের উপস্থিতি বাড়ে। এসব জায়গায় কেউ যেন নাশকতা করতে না পারে, সেই শঙ্কায় এরইমধ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। দূরের যাত্রাপথ, বিশেষ করে বাসে কোনো দুর্ঘটনা যেন না ঘটে সে জন্য গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে আগে থেকেই ডিবির তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে।
বাস্তবতা হচ্ছে রমজান কেবল ইবাদতের বিষয় নয়। অনেক আচার-সংস্কৃতির মতো। রাজনীতিও চলে ভিন্ন আদলে। সরকার বা যে কারো কথা-কাজে গোলমাল ঘটলে সেটা হয়ে যায় বড় ইস্যু। এবারের বাস্তবতা আরো ভিন্ন। নিত্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা, বাজার সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও যানজট নিরসনকল্পে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হলে সরকারকে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। আরেক তথ্য হলো রমজান মাসের সম্মানে বিশ্বের অনেক অমুসলিম দেশেও নিত্যপণ্যের দাম কমানোর নজির আছে। ব্যতিক্রম এই দেশে। এ বছর বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রমজানের দুমাস আগেই আটটি পণ্য ৯০ দিনের সাপ্লায়ার্স বা বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় আমদানি করার সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ সুযোগে বাকিতে পণ্য আমদানি হয়েছে প্রচুর। কিন্তু, সুফলটা সেভাবে মিলছে না।
বিশেষ করে সয়াবিন তেলে। বিশেষ চক্র বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও করে দিয়েছে। রমজান মাস এলে কৃত্রিমভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ছাড়াও অপরাধী চক্র সক্রিয় হয় ছিনতাই, চুরি, ডাকাতিসহ নানা নৈরাজ্য কর্মকাণ্ডে। অতীতে সরকারের মদদপুষ্ট সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজ গ্রুপ ও দলীয় সন্ত্রাসীরা জড়িত থাকত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্দিষ্ট কোনো দলের সরকার নয়। তাদের মদদপুষ্ট সিন্ডিকেট বা চাঁদাবাজ গ্রুপ অবশ্যই নেই। এর সুফল বাজারে পড়ুক সেটিই আমাদের কাম্য। পাশাপাশি ভোক্তাদের অতীতের দুর্ভোগ বিবেচনায় রমজানে নিয়মিত বাজার তদারকি অব্যাহত থাকুক। সেখানে সরকারে পরীক্ষায় ভালোভাবে পাস করার প্রত্যাশাটা একটু বেশি হওয়াই স্বাভাবিক।
Advertisement
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
এইচআর/এএসএম