মাহমুদা আক্তার
Advertisement
মহাখালীর ওয়ারলেস মোড়। প্রতিদিন শত শত মানুষের পদচারণা এখানে। ব্যস্ততার ভিড়ে কেউ হয়তো খেয়ালও করেন না, ফুটপাতের এক কোণে বসে নিপুণ হাতে চাবি তৈরি করছেন আবুল কালাম। কেউ হারানো চাবির বিকল্প খুঁজতে আসে, কেউ তালাবন্দি ঘর খুলতে তার ওপর ভরসা করে।
সত্তর পেরিয়ে যাওয়া আবুল কালামের জীবনটাও যেন এক তালাবদ্ধ দরজার মতো-যা সময়ের ধাক্কায় বারবার আটকে গেছে, তবু নিজের হাতে চাবি বানিয়ে পথ খুঁজেছেন। মহাখালীর সাততলা বস্তিতে তার ছোট্ট ঘর। স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে, ছেলেরা বড় হয়ে আলাদা হয়ে গেছে। বাবার খোঁজ রাখে, তবে সেটা নির্ভর করে তাদের ইচ্ছের উপর। তবুও তিনি গর্ব করেন এই ভেবে যে, এই চাবি বানানোর কাজ করেই তিন ছেলেকে বড় করেছেন, তাদের বিয়ে দিয়েছেন।
তিন দশকের বেশি সময় ধরে এই মোড়ে বসে চাবি তৈরি করছেন তিনি। তার কথায়, ‘আগে অনেক গার্মেন্টস ছিল, অফিস ছিল। লোকজনের যাতায়াত ছিল বেশি, তাই চাবির কাজেরও কদর ছিল। এখন সব কমে গেছে, রোজগারও তলানিতে।’
Advertisement
দিনের শুরুতে ফুটপাতে তার ছোট্ট দোকানে কেউ না কেউ আসে। কেউ ভুলে চাবি রেখে বাইরে আটকে গেছে, কেউ বদ্ধ ঘরের তালা ভাঙতে ছুটে আসে। আবুল কালাম বলেন, চাবি হারিয়ে মানুষ যখন আমার কাছে আসে, তখন তাদের অসহায়ত্ব আমিও বুঝি। চেষ্টা করি যত দ্রুত সম্ভব নতুন চাবি বানিয়ে দিতে। অনেকে খুশি হয়ে কিছু বাড়তি টাকাও দিয়ে যায়, সেটা আমার জন্য বড় পাওয়া।
তবে আগের মতো এখন আর কাজ চলে না। আগে দিনে ৪০০-৫০০ টাকা হতো, এখন কোনো কোনো দিন ১০০ টাকাও হয় না, আক্ষেপ ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে।
ছাতার কাজও করেন, তবে সেটি তার পারিশ্রমিকের বড় অংশ নয়। ছাতা ঠিক করতে তো মানুষ এখন কম আসে, সবাই নতুন কিনে ফেলে। তবু কেউ ভাঙা ছাতা নিয়ে এলে যত্ন করে ঠিক করে দেন তিনি।
জীবনের এই কঠিন বাস্তবতা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছেন আবুল কালাম। দিনশেষে যখন বাড়ি ফেরেন, ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফুটপাতে রাখা সরঞ্জাম গুছিয়ে নেন, তখন হয়তো তার চোখে ভেসে ওঠে পুরোনো সময়গুলো-যখন তার আয়ে সংসার চলত ঠিকঠাক, স্ত্রী-সন্তানদের মুখে হাসি থাকত। তিনি বলেন, এখনো দিন চলে, কিন্তু ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তবুও প্রতিদিন নতুন চাবি বানাই-কারণ জীবন চালাতে হলে চাবির দরকার হয়।
Advertisement
লেখক: ফিচার লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী
কেএসকে/এএসএম