বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী বলেছেন, সমন্বয়ের অভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। বিটিআরসিকে প্রথমে স্বাধীন সংস্থা করা হলেও পরে আইন সংশোধন করে বলা হলো, তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের (মন্ত্রণালয়ের) অনুমতি লাগবে। অর্থাৎ স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিজেই সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এ কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কঠিন হচ্ছে।
Advertisement
সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মহাখালী ব্র্যাক সেন্টার ইনে ‘রিকমেন্ডেশনস বাই দ্য টাস্ক ফোর্স অন রিস্ট্র্যাটেজাইজিং দ্য ইকোনমি’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে। সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে ‘ডিজিটাল রূপান্তর এবং এমএসএমই বৃদ্ধির মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ বিষয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান বলেন, অনেকগুলো ধাপ পার হয়ে ভোক্তাদের কাছে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছায়। প্রতিটি ধাপেই ভালো অঙ্কের অর্থ কেটে রাখা হয়। ইন্টারনেটের দাম না কমার পেছনে এটি অন্যতম বাধা। আমরা নেটওয়ার্ক সিস্টেমের জটিলতা কমিয়ে তা সহজ করার কাজ করছি। আশা করছি, আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে এ বিষয়ে কিছু অগ্রগতি দেখা যাবে। এছাড়া স্টারলিংকের বিষয়ে বিটিআরসি কাজ করছে।
Advertisement
আরও পড়ুন
রপ্তানি বহুমুখীকরণে অভ্যন্তরীণ বাজারে মনোযোগ দিতে হবে ‘সরকার করহার না কমালে ইন্টারনেটের দাম কমবে নাদ্বিতীয় অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর ও বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন। তারা দুজনেই টাস্ক ফোর্সের সদস্য।
ফাহিম মাশরুর বলেন, বাংলাদেশে একজন ব্যবহারকারী গড়ে সাড়ে ছয় গিগাবাইট (জিবি) মোবাইল ডেটা ব্যবহার করেন। যেখানে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা গড়ে ১৫০ জিবি ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এতে ধারণা করা যায়, শহরের তুলনায় গ্রামে ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ অনেক কম। এর পেছনে তিনটি প্রধান কারণ হচ্ছে- ব্যবহারকারীদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা, সরবরাহ শৃঙ্খলে অধিক ধাপ এবং ডেটা পরিবহনের উচ্চ ব্যয়।
অন্যদিকে, ছোট উদ্যোক্তাদের জন্য একটি আলাদা এসএমই ব্যাংক করার পরামর্শ দিয়েছেন মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, এসএমএস নীতিমালায় আলাদা এসএমই ব্যাংকের কথা বলা থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এসএমই বিভাগ থাকলেও সেগুলো পুরোপুরি এসএমইবান্ধব না। অথচ দেশে এসএমএস খাতের পরিসর বাড়ছেই। এমন বাস্তবতায় আলাদা একটি এসএমই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
Advertisement
মনজুর হোসেন বলেন, আমার বিবেচনায় দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংককে এসএমই ব্যাংকে রূপান্তর করা যায়। কারণ এসএমইদের নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের।
তবে এ ক্ষেত্রে ভিন্ন মত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস বিভাগের পরিচালক নওশাদ মোস্তাফা। তিনি বলেন, কর্মসংস্থান ব্যাংক উদ্যোক্তা পর্যায়ে ভালোভাবে কাজ করছে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের পরিবর্তে কর্মসংস্থান ব্যাংককে এসএমই ব্যাংকে রূপান্তর করা যেতে পারে।
নওশাদ মোস্তাফা বলেন, এসএমই প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থায়ন প্রক্রিয়া আরও সহজ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করছে। এসএমই উদ্যোক্তারা এখন জামানত ছাড়া পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। এ ঋণ দেওয়া হবে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে। শিগগির এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া কোনো স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান বিদেশি বিনিয়োগ আনতে পারলে প্রতিষ্ঠানকেও নির্দিষ্ট পরিমাণ ‘ম্যাচিং ফান্ড’ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এসএমইদের আকার ছোট হওয়ায় ঋণ বিতরণের খরচ অনেক বেশি হয়। এই প্রক্রিয়াকে ডিজিটাল করা না গেলে এসএমই ঋণের আওতা বাড়ানো সম্ভব হবে না।
এসএমই ফাউন্ডেশনের মহাব্যবস্থাপক নাজিম হাসান সাত্তার বলেন, দেশে এসএমই-দের জন্য অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। আমাদের হিসাবে প্রায় ৩৬টির বেশি সরকারি সংস্থা এসএমই নিয়ে কাজ করছে। তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। একই কাজ একই সময়ে অনেকে করছে। আবার একই উদ্যোক্তা একই সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ফলে দিনশেষে আসল কাজ হচ্ছে না।
এছাড়া, এসএমই সংজ্ঞায়নেও ত্রুটি আছে বলে জানান নাজিম হাসান। তিনি বলেন, বিদ্যমান সংজ্ঞায় তৈরি পোশাক খাতের ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এসএমইর অন্তর্ভুক্ত। তাহলে পিছিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো এদের সঙ্গে কীভাবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে? তাই এসএমই প্রতিষ্ঠানের সংজ্ঞায়ন পুনরায় করতে হবে এবং পিছিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আলাদা ফ্রেমওয়ার্ক করতে হবে।
ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা একদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, অন্যদিকে, উচ্চ করারোপের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ডিজিটাল সুবিধা নেওয়া থেকে দূরে রাখছি। মুঠোফোনের ডেটা ও কলরেটে ৪০ শতাংশের বেশি কর নেয় সরকার। এটি সরাসরি ভোক্তাদের থেকে নেওয়া হয়। এভাবে বাড়তি শুল্ক থাকলে মানুষ ফোন, ইন্টারনেট ব্যবহার তো কমাবেই।
শেয়ারট্রিপের প্রধান নির্বাহী সাদিয়া হক বলেন, বর্তমানে ব্যবসা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে। তাই এসএমই খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু আমরা এই বিনিয়োগ আসার মতো পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি। এই পরিবেশ তৈরি করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে হবে।
এসআরএস/ইএ