রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, অবহেলা এবং অব্যবস্থাপনার কারণে অকার্যকর হতে বসেছে পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন (আইআরডি) প্রকল্প। এতে ফসল উৎপাদন খরচ বেড়ে কৃষকের আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে। রক্ষণাবেক্ষণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও মিলছে না প্রত্যাশিত সেচ সুবিধা। ভেস্তে যাচ্ছে প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সব মিলিয়ে এ প্রকল্প যেন এক শ্বেত হস্তিতে পরিণত হয়েছে।
Advertisement
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, কৃষি উৎপাদন খরচ কমানোর লক্ষ্যে ১৯৯২ সালে ৩৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে যাত্রা শুরু হয় পাবনা সেচ প্রকল্পের। বেড়া উপজেলার হুরাসাগর নদ ও যমুনা নদীর পাড়ে পানি উত্তোলন ও নিষ্কাশনে নির্মাণ করা হয় শক্তিশালী দুটি পাম্প স্টেশন। খনন করা হয় ছোট-বড় অসংখ্য সেচ ও নিষ্কাশন খাল এবং নির্মাণ করা হয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, জলকপাট, কালভার্টসহ বিভিন্ন অবকাঠামো। প্রকল্প এলাকার ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যে খনন করা হয় সাড়ে ৪২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের প্রধান সেচ খাল, ১৯টি অপ্রধান, ৪৭টি শাখা এবং ৪ শতাধিক ছোট সেচ খাল। তবে কালের পরিক্রমায় নিয়মিত সংস্কারের অভাবে অধিকাংশ খালে ঠিকমতো পানিই পৌঁছায় না। ভরাট হয়ে অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে অনেক খালের। কোথাও কোথাও খাল দখল করে মাছচাষ করছেন প্রভাবশালীরা। এতে বিপাকে পড়েছেন সেচ খালের ওপর নির্ভরশীল হাজার হাজার কৃষক।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, সেচ প্রকল্পের পানির জন্য কৃষকদের সারা বছর প্রতি বিঘায় পাউবোকে দিতে হয় ১৮০ টাকা। অথচ চলতি রবি মৌসুমে এখনও সেকেন্ডারি ও শাখা সেচ খালগুলোতে পানি ছাড়েনি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। ফলে গভীর-অগভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দিতে শুধু বোরো আবাদেই প্রতি বিঘায় কৃষককে গুণতে হচ্ছে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেড়া পাউবোর এক কর্মকর্তা জানান, পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প এখন একটা শ্বেত হস্তি প্রকল্পে পরিণত হয়েছে। প্রকল্পের শুরুর দিকে বেড়া ও সাঁথিয়ায় প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া হতো। পর্যায়ক্রমে খননের মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা থাকলেও এখন দুই হাজার হেক্টর জমিতেও পানি সরবরাহ করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। এ বছর এখনো পানিই ছাড়া হয়নি। অথচ রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হয় কোটি কোটি টাকা। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।
Advertisement
তিনি আরও জানান, কথা ছিল বছর বছর সেচ প্রদানের এলাকা বাড়িয়ে লক্ষ্যমাত্রার ১৮ হাজার হেক্টরে পৌঁছানো। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো কমতে থাকে সেচের জমি। অবহেলা ও অব্যবস্থাপনায় গত ৩২ বছরে সেচ খাল ও এর অন্যান্য অবকাঠামো দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়তে থাকে। ছোট সেচ খালগুলো (টার্শিয়ারি খাল) ভরাট হয়ে অকার্যকর হয়ে পড়ে। কোনো কোনোটি আবার মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে অস্তিত্বই হারিয়ে ফেলেছে।
সরেজমিনে সাঁথিয়ার পুণ্ডরিয়া, শামুকজানি, বায়া, পানিশাইল, বেয়াইলমারী, গাগড়াখালি, ছেচানিয়া, বড়গ্রাম, বেড়া উপজেলার চাকলা, দমদমা, খাকছাড়া, মোহনগঞ্জ, হরিরামপুর, নতুন পেঁচাকোলা, মাছখালিসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জমির পাশ দিয়ে যাওয়া সেচ খালগুলোতে পানি নেই। দেখে মনে হয় না এগুলো সেচ খাল। অনেক স্থানে সেচ খাল মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
পুণ্ডরিয়া গ্রামের কৃষক শরিফুল, লুৎফর, শাহীন, নাসির প্রামাণিকসহ কয়েকজন কৃষক বলেন, এক সময় আমরা সেচ খালের পানি দিয়ে সব ধরনের ফসল আবাদ করতাম। নামমাত্র খরচ হতো। এখন ঠিকমতো পানি না পাওয়ায় সবাই সেচযন্ত্র দিয়ে সেচ দিচ্ছেন। এতে খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সবাইকে।
সম্প্রতি বেড়া উপজেলার দমদমা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ডি-৫ সেচ খালে ১৫ বছর ধরে পানি না আসায় বিলীন হওয়ার পথে। সেচ খালের পাশেই স্থাপনা গড়েছেন অনেকে। বেদখল হয়ে গেছে অনেক জায়গা।
Advertisement
জানতে চাইলে পাউবোর বেড়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম বলেন, রবিশস্য মাঠে থাকায় চলতি মৌসুমে কৃষকদের অনুরোধেই অপ্রধান খালে পানি সরবরাহ বন্ধ ছিল। আমরা এরইমধ্যে পানি ছাড়তে শুরু করেছি। প্রকল্পের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সংস্কারের জন্য এরইমধ্যে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এতে বন্ধ সেচ খালগুলো যেমন পুনরুজ্জীবিত হবে, তেমনি নতুন নতুন এলাকায় সেচ খালও নির্মাণ করা হবে। এটা চালু হলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমি সেচের আওতায় আনা সম্ভব হবে। তখন ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে।
এফএ/জেআইএম