আইন-আদালত

দায়ী আইনজীবীদের সনদ বাতিলসহ তিন দাবি বিজেএসএ’র

আইনজীবীদের আন্দোলনের মুখে চারদিন বিচারকাজ বন্ধ থাকা ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে লিখিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ)। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের সনদ বাতিলসহ তিন দফা দাবি জানিয়েছে বিচারকদের এ সংগঠন।

Advertisement

বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম ও মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ট্রাইব্যুনালের অচলাবস্থার প্রকৃত ঘটনা, এর পেছনের মূলকারণসহ বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আমরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে কতিপয় আইনজীবীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণে গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্য পুরোপুরি স্থবির হয়ে পড়েছে, বিচারপ্রার্থী মানুষ অবর্ণনীয় হয়রানির শিকার হচ্ছে। ওই আইনজীবীরা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ায় অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে বিচারকের মানহানি করারও চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অত্যন্ত ধৈর্য ও সতর্কতার সঙ্গে এতদিন পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু পরিস্থিতি যে পর্যায়ে যাচ্ছে তা সারাদেশের বিচারকদের মনে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। এমতাবস্থায়, সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ এবং সারাদেশের মানুষের অবগতির জন্য সবার সামনে আমরা প্রকৃত ঘটনা, এর পেছনের মূলকারণ এবং বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের অবস্থান তুলে ধরছি।

Advertisement

ঘটনার সূত্রপাত গত ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলার শুনানিকে কেন্দ্র করে। ঢাকা আইনজীবী সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদধারী কয়েকজন আইনজীবী ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষে জামিন শুনানি করেন, যা বিচারক গুণাগুণের ভিত্তিতে শুনানিপূর্বক নামঞ্জুর করেন। ওই গুরুত্বপূর্ণ পদধারী আইনজীবীরা শুনানি করার পরেও আসামিকে জামিন না দেওয়ার ঘটনাকে তারা নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেন।

এর আগে বিভিন্ন সময়ে তারা আইনজীবী সমিতিতে তাদের পদকে ব্যবহার করে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলার গুণাগুণের ভিত্তিতে আদেশ দেওয়ায় অর্থাৎ তাদের বিশেষ সুবিধা না দেওয়ায় তারা আগে থেকেই বিচারকের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।

প্রকাশ্য আদালতে তারা এটাও উল্লেখ করেন যে, ‘এটা জেলা বার না, ঢাকা বার’। ঢাকা আইনজীবী সমিতির গুরুত্বপূর্ণ পদধারী ব্যক্তিরা আদালতে শুনানি করলে তাদের পক্ষে আদেশ দেওয়া ঢাকা কোর্টের রীতি উল্লেখ করে তারা আদেশ পরিবর্তনের জন্য বিচারকের ওপর এজলাসেই চাপ সৃষ্টি করেন। একপর্যায়ে বিচারক এজলাস থেকে নেমে যেতে বাধ্য হন।

এরপরেও চাপের কাছে নতিস্বীকার না করায় অর্থাৎ আদেশ পরিবর্তন না করায় পরদিন ১০ ফেব্রুয়ারি বিচারক এজলাসে ওঠলে ওই আইনজীবীরা বিচারককে এজলাসে থেকে নেমে যেতে বলেন। বিচারক এজলাস থেকে নামতে না চাওয়ায় তারা এজলাসে হট্টগোল, বিশৃঙ্খলা, বিচারককে হুমকি ও এজলাস রক্তাক্ত করার ভয় দেখান। একপর্যায়ে আদালতের কর্মচারীকে এজলাসেই মারধর করেন যার ভিডিও ফুটেজ বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

Advertisement

আদালতের আইনানুগ আদেশকে কেন্দ্র করে আইনজীবী সমিতির কতিপয় স্বার্থান্বেষী আইনজীবীর ইন্ধন ও প্রত্যক্ষ মদদে কিছু আইনজীবী বিগত কয়েকদিনে যে আচরণ প্রদর্শন করেছেন তা অসদাচরণ, বিচারকাজে বাধা সৃষ্টি, বিচারকের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ এবং বিচারকের নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। আইনজীবীদের ওই আচরণ শুধু ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল নয় বরং সারা দেশের বিচারক তথা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বলে আমরা মনে করি।

একজন বিচারক সাংবিধানিকভাবে আদালতে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার আদেশ একপক্ষের অনুকূলে এবং অপর পক্ষের প্রতিকূলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আইনজীবী সমিতির কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদধারী ব্যক্তি মামলায় শুনানি করলে তার পক্ষে আদেশ দিতে হবে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের এই মানসিকতা স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য অশনি সংকেত।

আদালতের আদেশ দ্বারা কেউ সংক্ষুব্ধ হলে আইনগতভাবে সেই আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি বিচারকের বিরুদ্ধে কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধেও কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়েরের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দেশের বিদ্যমান আইন ও বিচারকের সাংবিধানিক স্বাধীনতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পদ ও পেশি শক্তি প্রদর্শন করে নিজের পক্ষে রায় বা আদেশ পাওয়ার লক্ষ্যে আইনজীবী কর্তৃক এজলাস ও আদালত প্রাঙ্গণে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা ফৌজদারি অপরাধ। এতে আদালতের স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, বিচারপ্রার্থী সাধারণ জনগণ হয়রানির শিকার হচ্ছে এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা সৃষ্টি হচ্ছে।

বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন শুরু থেকেই ঘটনাটি শান্তিপূর্ণ ও স্থানীয়ভাবে সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। এ লক্ষ্যে সব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। এছাড়া ঢাকার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং মহানগর দায়রা জজরা ঢাকা আইনজীবী সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি সুরাহার চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আইনজীবী সমিতি ওই প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট বিচারকের অপসারণের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ট্রাইব্যুনাল বর্জনের ডাক দিয়েছে। আদালতে বিচারক নিয়মিত বসবেন এটা স্বাভাবিক, আইনজীবীরা আদালত বর্জন করতেই পারেন, কিন্তু বিচারককে আদালত থেকে নেমে যাওয়ার জন্য চাপ বা ভয়ভীতি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন এবং ওই রোডম্যাপ বাস্তবায়নে যেসব ঐতিহাসিক উদ্যোগ হাতে নিয়েছেন জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও সারাদেশের বিচারকরা ওই রোডম্যাপ বাস্তবায়নে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে কাজ করে যাচ্ছেন। ঠিক এমন সময়ে কতিপয় আইনজীবীর এরূপ আচরণ ও কর্মকাণ্ডের দ্বারা প্রধান বিচারপতি কর্তৃক ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন মনে করে। আদালতের আইনানুগ আদেশকে কেন্দ্র করে এজলাস ও আদালত প্রাঙ্গণে এমন অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা পুরো বিচার ব্যবস্থার প্রতি হুমকি বলে অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।

বিচারালয়ে এরূপ অরাজকতা সৃষ্টি, বিচারককে ভয়ভীতি দেখানো এবং বিচারকাজ পরিচালনায় সরাসরি বাধা সৃষ্টি সভ্য সমাজে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে সংঘটিত এসব কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আমরা তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি।

এর আগে গত মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সভা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সাইবার ট্রাইব্যুনাল বর্জনের ডাক দেওয়া হয়।

এফএইচ/এমএএইচ/জিকেএস