দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি ক্রমশই অবনতি হচ্ছে বলে মত প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এলসি সমন্বয়ের দীর্ঘসূত্রতা, ডলার মূল্যের অস্থিরতা, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চ হার, ভ্যাট দিতে হয়রানি, ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়ার জটিলতা ও উচ্চ ফি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং অসহনীয় যানজটের কারণে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে।
Advertisement
বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর তৃণমূল পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সমস্যা চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত আয়কর, ভ্যাট, শুল্ক, যানজট ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শীর্ষক মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ীরা এসব কথা বলেন।
ডিসিসিআই গুলশান সেন্টারে অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় গুলশান, মহাখালী, বনানী এবং বাড্ডা অঞ্চলের ১৪টি অ্যাসোসিয়েশনের নেতা ও বেশকিছু ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক (বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ-এফইপিডি) মো. সাইয়েদুল ইসলাম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রথম সচিব (মূসক বাস্তবায়ন) মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম এবং ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (গুলশান বিভাগ) মো. তারেক মাহমুদ।
Advertisement
অনুষ্ঠানের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে আমাদের উদ্যোক্তাদের ক্রমশই কঠিনতর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে কর ও ভ্যাট ব্যবস্থার জটিলতা ব্যবসায়ীদের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষ করে কর ও ভ্যাটের নিয়মিত পরিবর্তন, অগ্রিম আয়কর ও রেগুলেটরি ডিউটির অতিরিক্ত বোঝা, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতার কারণে দেশের বেসরকারি খাতের ওপর অতিরিক্ত অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
এছাড়াও সাম্প্রতিক অস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যানজট পরিস্থিতির অবনতির কারণে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য অনুকূল পরিবেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে না বলে অভিমত জ্ঞাপন করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
তাসকীন আহমেদ বলেন, ঋণপত্র খোলার জটিলতা, এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রাপ্তিতে পদ্ধতিগত প্রতিবন্ধকতা এবং উচ্চ সুদ হার আমাদের স্থানীয় শিল্পায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ অবস্থায় দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারিখাতের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ এবং কার্যকর বাস্তবায়ন একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।
Advertisement
বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক (বৈদেশিক মুদ্রা নীতি বিভাগ) সাইয়েদুল ইসলাম বলেন, এলসি মার্জিন শতভাগ হবে কি না এটি নির্ভর করে ব্যাংক ও ভোক্তার সম্পর্কের ওপর এবং এলসি মার্জিনের বিষয়টি সব পণ্যের ক্ষেত্রে এক নয়।
তিনি বলেন, কোভিড মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে মার্কিন ডলারের মূল্যের অস্বাভাবিক ওঠানামার কারণে আমাদের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সামগ্রিক আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা আনায়নে সরকারি-বেসরকারিখাতের সমন্বিত উদ্যোগ জরুরি বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
এনবিআরের প্রথম সচিব (মূসক বাস্তবায়ন) মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বেশ চ্যালেঞ্জিং এবং এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তিনি ব্যবসায়ীসহ সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
তিনি বলেন, সম্প্রতি স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের নিবন্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং প্রান্তিক পর্যায়ে করজাল বিস্তারের লক্ষ্যে এনবিআর কাজ করছে। এছাড়াও সার্বিকভাবে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে একটি অটোমেটেড এবং স্বচ্ছ রাজস্ব ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি তিনি অভিমত জ্ঞাপন করেন।
ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (গুলশান বিভাগ) তারেক মাহমুদ বলেন, রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর জনগণের আস্থা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
তবে চাঁদাবাজি, হয়রানি ও ফুটপাত দখল মুক্ত করতে ব্যবসায়ীসহ সব স্তরের জনগণকে তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহায়তার আহ্বান জানান এবং সবার সম্মিলিত উদ্যোগে বিদ্যমান অচলাবস্থা নিরসন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে গুলশান ১ নম্বর ডিএনসিসি দক্ষিণ পাঁকা মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি আবু তাহের বলেন, এলসি খোলা হতে সমন্বয় পর্যন্ত প্রায় তিন মাস সময় লেগে যায়, দীর্ঘসময়ের জন্য টাকা আটকে থাকার কারণে ব্যবসায়ীদের মূলধন স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি ডলারের মূল্যের অস্থিরতার কারণেও ব্যবসায়ীরা এলসির মূল্য পরিশোধে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
মহাখালী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফিরোজ আলম স্বপন জানান, ভ্যাট হার বৃদ্ধি, ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের উচ্চ ফি এবং দীর্ঘসূত্রতার কারণে ব্যবসায়ীরা প্রতিনিয়ত নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন।
আমিন হোসেন অ্যান্ড কোং-এর পার্টনার মোহাম্মদ আল আমিন জানান, আয়কর আইনের ১৬৩ ধারা এবং অগ্রিম আয়কর সমন্বয়ের দীর্ঘসূত্রতার জন্য ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ের মূলধন থেকে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
অনুষ্ঠান শেষে ২৫টি প্রতিষ্ঠানকে ডিসিসিআইর সদস্যপদ দেওয়া হয় এবং ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির হাতে ডিসিসিআই’র মেম্বারশিপ সার্টিফিকেট হস্তান্তর করেন।
এসআরএস/এমআইএইচএস