সাহিত্য

পঙ্কজ শীলের গল্প: টিকটিকির রক্ত

রাতটা ছিল অন্যরকম। চারদিকে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে। শহরের পুরোনো গলির ধারের বাড়িটা বেশ অদ্ভুত। শ্যাওলা ধরা দেওয়ালে ফাটল ধরেছে, জানালাগুলো ভাঙাচোরা। এই বাড়িটা সম্পর্কে নানা গুজব আছে। লোকে বলে, ‘এখানে যারা আসে; তারা আর ফিরে যায় না।’তবে আজকের রাতটা অন্যরকম হতে চলেছে। কারণ শহরের কুখ্যাত অপরাধী রফিক আর তার দলবল এখানে আশ্রয় নিয়েছে। একটা ব্যাংক ডাকাতির পর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা এই পরিত্যক্ত বাড়িতে লুকিয়েছে। রফিকের সঙ্গে আছে জাহিদ আর সালাম।

Advertisement

রাত তিনটা বাজে। বাইরে ঝিঁঝি পোকার ডাক। মাঝে মাঝে দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ। ছাদের ধারে একটা টিকটিকি স্থির হয়ে বসে আছে। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। রফিক সিগারেট ধরিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ায়। ‘সব ঠিক আছে তো?’জাহিদ চাপা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ ভাই। কিন্তু জায়গাটা কেমন জানি... অস্বস্তি লাগছে।’ রফিক হাসলো—‘ভূতের ভয় পাচ্ছিস?’সালাম গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘এটা ভূতের ভয় না ভাই। এই বাড়ির ইতিহাস খারাপ। লোকে বলে, এখানে একসময় এক জল্লাদ থাকতো। সে নাকি নির্দয়ভাবে অনেক মানুষ মেরেছে।’রফিক বিরক্ত হয়ে বললো, ‘আজগুবি কথা বলবি না। পুলিশ থেকে বাঁচতে এখানে এসেছি, ভূত-প্রেতের গল্প না।’

হঠাৎ ছাদের কোণ থেকে একটা টিকটিকি ছুটে এসে রফিকের গায়ের ওপর পড়লো। সে চমকে উঠে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলো—‘উফ! বিরক্তিকর জিনিস!’টিকটিকিটা দেওয়ালে গিয়ে পড়লো কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মেঝেতে লালচে কিছু একটা ছিটকে পড়লো।সালাম অবাক হয়ে বললো, ‘ওই দেখ! ওটা কী?’ জাহিদ নিচু হয়ে দেখলো, ‘রক্ত?’একটা টিকটিকির শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু তার থেকেও অদ্ভুত ছিল রক্তের রং—চকচকে লাল। তাতে যেন একটা ধাতব আভা।

রফিক বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ফালতু চিন্তা বাদ দে। ভোর হলে এখান থেকে চলে যাবো।’ এর পরপরই একটা কোল্ড ড্রাফট ঘরজুড়ে বয়ে গেল। জানালার কাচ কেঁপে উঠলো। সালাম ফিসফিস করে বললো, ‘ভাই, কিছু একটা হচ্ছে...’তাদের চারপাশে অন্ধকার যেন গাঢ় হয়ে উঠছে। সেই মুহূর্তে জানালার পাশের দেওয়ালে আরও কয়েকটি টিকটিকি হাজির হলো। তারা একসঙ্গে তাকিয়ে আছে তিনজনের দিকে।হঠাৎ করে একসঙ্গে সব টিকটিকি ফোঁসফোঁস শব্দ করে উঠলো। তাদের মুখ দিয়ে গাঢ় লাল রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল।

Advertisement

আরও পড়ুন পাঁচটা টাকা হবে?  অতঃপর গুইসাপের গল্প 

রফিক, জাহিদ, সালাম স্তব্ধ হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটলো। টিকটিকিগুলোর গা ফুলে উঠলো। চোখগুলো আগুনের মতো জ্বলতে লাগলো। তারপর একটি টিকটিকি লাফিয়ে উঠে জাহিদের গলায় কামড়ে ধরলো! সে চিৎকার করতে চাইলো, কিন্তু পারলো না। ভয়ংকর কষ্টে তার মুখ বিকৃত হয়ে গেল। তার চোখ বড় হয়ে এলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে নিস্তেজ হয়ে গেল।রফিক আর সালাম আতঙ্কে পেছনে সরে গেল—‘এগুলো কী?’

সালাম ছুরি বের করে টিকটিকিটাকে আঘাত করলো কিন্তু টিকটিকিটা যেন গলে গিয়ে ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল।রফিকের শরীর ঘামতে শুরু করলো। টিকটিকিগুলো একে একে নেমে আসতে লাগলো। তাদের চোখে একরকম নিষ্ঠুর আনন্দ।

হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর এলো—‘তোরা বের হ। দেরী করিস না!’রফিক দরজার দিকে দৌড় দিলো কিন্তু কিছু একটা তার পা চেপে ধরলো। সে নিচে তাকিয়ে দেখলো একটি বিশাল টিকটিকি। লম্বায় প্রায় তিন ফুট। তার পা ধরে আছে!সালাম দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলো কিন্তু দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা অজস্র টিকটিকি তাকে ঘিরে ফেললো।

একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ কানে এলো। রফিক পেছন ফিরে দেখলো—সালামের শরীর গলে গলে মাটিতে মিশে যাচ্ছে। সে একটা বিকট শব্দে চিৎকার দিলো কিন্তু তখনই কিছু একটা তার মুখ চেপে ধরলো। একটা টিকটিকি সরাসরি তার মুখের মধ্যে ঢুকে গেল!তারপর নীরবতা।পুরো বাড়িটা আবার শূন্য হয়ে গেল।

Advertisement

পরদিন সকালে পুলিশ এসে খুঁজে পেলো শুধুই ফাঁকা ঘর। রক্তের কোনো চিহ্ন নেই, কোনো মৃতদেহও নেই। তবে দেওয়ালের কোণে একটি ছোট টিকটিকি বসে ছিল। তার ছোট্ট জিভটা বেরিয়ে এলো। সেটি লালচে রঙের কিছু একটা চেটে নিলো। তার ছোট্ট চোখ দুটোয় এক মুহূর্তের জন্য রফিকের আতঙ্কিত মুখটা ফুটে উঠলো...

এসইউ/জিকেএস