দেশজুড়ে

খননের পরও নদে জাগছে চর, প্রকল্পে হরিলুট

ব্রক্ষপুত্রের সঙ্গে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের ছিল গভীর মিতালি। নদকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহ করতেন বহু মানুষ। জেলেরা জাল ফেললে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়তো ছোট-বড় মাছ। উত্তাল পানিতে চলাচল করতো বড় বড় জাহাজ। নদের আশপাশের বাজারগুলো ছিল জমজমাট। তবে এসব দৃশ্য এখন শুধুই কল্পনা।

Advertisement

ধীরে ধীরে মরে যাওয়া নদটিতে পানিপ্রবাহ ধরে রাখতে উদ্যোগ নেয় তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। এতে সবাই ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই যৌবন ফিরে পাবে নদটি। খননকাজ শুরুর পর থেকেই মানুষ আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু সেই আশা হতাশায় পরিণত হয়। খননের পরও নদে নেই পানি। স্থানীয়রা বলছেন, এ প্রকল্পে টাকা লোপাট করা হয়েছে।

খননকাজটি করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ২০১৯ সালের জুন থেকে দুই হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ শুরু হয়। গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ—এ পাঁচ জেলায় নদের ২২৭ কিলোমিটার অংশ খনন করার কথা। খনন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল গত বছরের জুনের মধ্যে। খনন শেষে আরও তিন বছর খননকাজের দেখভাল করার কথা প্রকল্পের আওতায়। কিন্তু যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়। ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত এই প্রকল্পের মাত্র ৩৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। খননের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানোর জন্য আবেদন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: নদীর জমি দখল করে বিক্রি, নিষ্ক্রিয় প্রশাসন

এসময়ের মধ্যে অনেক এলাকা খনন হয়েছে। কিন্তু হতাশার বিষয় হচ্ছে, খনন করা অনেক স্থানে পুনরায় জেগেছে চর। অনেক স্থান দিয়ে নৌকা পর্যন্ত চলছে না। খনন করা মাটি ফেলা হয়েছে নদের পাশেই। ফলে বৃষ্টির সময় এই মাটি চলে যাচ্ছে খনন অংশে। প্রভাবশালীরা এসব মাটি রাতের আঁধারে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনতো আছেই। সবমিলিয়ে নদটি এখনো মৃত।

Advertisement

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেরপুর অংশে কাজ করতে গিয়ে সমস্যা হচ্ছে। যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থলে মাটি কাটতে গিয়ে স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। করোনাকাল, লকডাউন, অর্থপ্রাপ্তিতে ধীরগতি, নদের সীমানা নিয়ে জটিলতা, বালু রাখা নিয়ে সমস্যা, যমুনাছোঁয়া উৎসমুখে খননকাজে স্থানীয়দের বাধা, সীমানা জটিলতা ইত্যাদি কারণে প্রকল্পটির কাজ ধীরগতিতে চলছে। ভাটির দিক থেকে নদটি খনন শুরু করে এখন শেরপুর-জামালপুর অংশে রয়েছে।

ময়মনসিংহ নগরীর কাচারি ঘাটের খেয়া পারাপারে নিয়োজিত জাহিদ মিয়া। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এইডা কোনো খনন অইলো? যেইনো (যেখানেই) খনন করছে, অইনোই (সেখানেই) পানি নাই। পানি কম থাহার কারণে নৌকা অনেক জায়গায় আটকায়্যা যায়। তাই নৌকা আটকাইবো না এমন দিক দিয়া নৌকায় মানুষ পারাপার করতে অইতাছে।’

আরও পড়ুন: ছোট এসব জলাভূমি যেন একেকটি সোনার খনি

নদের পাড়ঘেঁষা থানাঘাট এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমরা দেখেছি নদকে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষ জীবিকা নির্বাহ করতেন। অথচ দখল, দূষণ আর প্রভাবশালীদের বেপরোয়া বালু উত্তোলনসহ নানা কারণে নদটি এখন মৃতপ্রায়।’

ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটি শুধু খনন প্রকল্প ছিল না; খননের আড়ালে ব্রক্ষপুত্রের একটি ভরাট প্রকল্পও ছিল। ব্রহ্মপুত্র একটি বিনোনি নদ। কোথাও কোথাও এই নদের দুই তিনটি ধারা রয়েছে। খনন শুরু হওয়ার পর মাটি ফেলে একাধিক ধারাকে চিরতরে বন্ধ করা হয়েছে। ফলে এর সঙ্গে যেই নদীগুলোর সংযোগ রয়েছে সেগুলোর উৎসমুখ আটকে দেওয়া হয়েছে। নদীগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। খননের একটুও সুফল পাওয়া যায়নি। বর্তমানে নদের ডান-বাম ও মাঝখানেও চর জেগেছে।’

Advertisement

তিনি বলেন, খননের নামে মানুষকে সঙ্গে ভাঁওতাবাজি করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাদ দেওয়া প্রয়োজন। খননের নামে হরিলুট করা টাকাগুলোও উদ্ধার করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন: দখল-দূষণে ভাগাড় কিশোরগঞ্জের প্রাণ নরসুন্দা

ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী নুরুল আমিন কালাম। তিনি বলেন, খনন প্রকল্পে বলা হয়েছিল এটি বাস্তবায়ন হলে ব্রহ্মপুত্র নদে শুষ্ক মৌসুমেও ১০ ফুট পানির প্রবাহ থাকবে। প্রশস্ত হবে ৩০০ ফুট। এমনটি হলে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ের মানুষের জীবনধারা বদলে যাবে। প্রকল্প শেষ হলে এই নদ দিয়ে জাহাজ চলবে। এটি আন্তর্জাতিক নৌ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হবে। উন্নয়ন ঘটবে মৎস্য সম্পদের। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা করে খননকাজ করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। ফলে খননকাজ কোনো কাজেই আসেনি। খননের নামে মোটা অংকের টাকা লোপাট করা হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, নদ খননের মাধ্যমে পানিপ্রবাহ ধরে রাখতে খননকাজ চলছে। তবে সীমানা জটিলতাসহ অনেক স্থানে বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বর্তমানে নদে ৯৫টি ড্রেজারের মধ্যে মাত্র ৫৫টি কাজ করতে পারছে। বাকিগুলো বসে আছে। উৎসমুখে খননকাজ করতে পারলে খননের সুফল পাওয়া যাবে।

এসআর/জেআইএম