শিক্ষা

শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন নিয়ে কাটছে না সংশয়

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তাদের কাছে দেশবাসীর সবচেয়ে বড় দাবি ছিল সংস্কার। সেই দাবি মেনে এরই মধ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। কয়েকটি সংস্কার কমিশন এরই মধ্যে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। অথচ শিক্ষা রয়ে গেছে ব্রাত্য। শিক্ষাবিদ-রাজনীতিবিদদের মতে, ‘শিক্ষা সংস্কার কমিশন’ দরকার ছিল সবার আগে।

Advertisement

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা) অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল ইসলাম গত ১৮ ডিসেম্বর ‘শিগগির শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা হবে’ বলে ঘোষণা দেন। তার সেই ঘোষণার মাস পেরোলেও আলোর মুখ দেখেনি শিক্ষা কমিশন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, মন্ত্রণালয়ের প্রস্তুতি থাকলেও আপাতত সরকার শিক্ষা সংস্কার কমিশন করার ব্যাপারে সাড়া দিচ্ছে না। ফলে আদৌ শিক্ষা সংস্কার কমিশন হবে কি না, তা নিয়ে খোদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও রয়েছেন সংশয়ে। সার্বিক পরিস্থিতিতে শিক্ষা সংস্কার কমিশন ‘অধরাই’ থেকে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

যে কমিশনগুলো হয়েছে, সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। তারপরও সবাই একমত হবেন যে, সবার আগে শিক্ষা কমিশনটাই জরুরি ছিল। কেন সেটা করা হচ্ছে না বা হবে না, তা নিয়ে সবার প্রশ্ন তোলা উচিত। এখানে বাধা কোথায়?- ড. ইমতিয়াজ আহমেদ

Advertisement

সবার আগে জরুরি ছিল শিক্ষা সংস্কার কমিশন

অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। তবে সবার আগে শিক্ষা কমিশন জরুরি ছিল বলে মনে করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ২১ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত আলোচনা সভায় এ নিয়ে ক্ষোভ জানান তিনি।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সবকিছুর আগে শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা প্রয়োজন ছিল, সেটিই হয়নি। সব সমস্যার মূলে তো শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের যদি শিক্ষাটাই না থাকে, তাহলে আমরা কী দিতে পারবো, আর কী নিতে পারবো? কিন্তু সেই কমিশনটাই এখন পর্যন্ত করা হয়নি।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘বাংলাদেশের অনেক সমস্যা। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে লেখাপড়াটা শেষ হয়ে গেছে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা একেবারে শেষ। প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার মান এত নিচে নেমে গেছে, তা বলে বোঝানো যাবে না। এমপিওভুক্ত করে অসংখ্য স্কুল-কলেজ করা হয়েছে। যেখানে শিক্ষক নেই। তবুও অনার্স-মাস্টার্স খুলে বসে আছে।’

শিক্ষা কমিশন তো সরল একটি কমিশন। এখানে স্পেশালিস্টের অভাব আছে, নাকি কাজ করার ক্ষেত্রে বড় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বাধা আছে? কেন সেটা করা হলো বা না হচ্ছে না, তা তো রহস্যজনক।- অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

Advertisement

বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যের সঙ্গে একমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘যে কমিশনগুলো হয়েছে, সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। তারপরও সবাই একমত হবেন যে, সবার আগে শিক্ষা কমিশনটাই জরুরি ছিল। কেন সেটা করা হচ্ছে না বা হবে না, তা নিয়ে সবার প্রশ্ন তোলা উচিত। এখানে বাধা কোথায়?’

শিক্ষা কমিশন না করাটাকে ‘রহস্যজনক’ মনে করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা কমিশন তো সরল একটি কমিশন। এখানে স্পেশালিস্টের অভাব আছে, নাকি কাজ করার ক্ষেত্রে বড় রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বাধা আছে? কেন সেটা করা হলো বা না হচ্ছে না, তা তো রহস্যজনক।’

জোরালো হচ্ছে শিক্ষা সংস্কার কমিশনের দাবি

শিক্ষা সংস্কার কমিশনের দাবি শুরু থেকেই উঠেছে। নানান কারণে তা এড়িয়ে গেছে অন্তর্বর্তী সরকার। শেষ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী প্রতিশ্রুতি দিলেও তা নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। তবুও এ কমিশন গঠনের দাবি জোরালো হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষাবিষয়ক সংস্থা, ছাত্রসংগঠন শিক্ষা সংস্কার কমিশনের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে।

মঙ্গলবারও (২১ জানুয়ারি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে দ্রুত শিক্ষা সংস্কার কমিশন করার দাবিতে সমাবেশ করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট। ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘অবিলম্বে শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে। শিক্ষাবিদ, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও ছাত্রসংগঠনের নেতাসহ বিভিন্ন অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক, একই ধারার শিক্ষার পরিপূরক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে।’

আমরা শুরু থেকেই শিক্ষা সংস্কার কমিশন চেয়ে এসেছি। সরকার অনেকগুলো কমিশন করলেও শিক্ষা সংস্কার কমিশন করেনি। কেন করেনি, সেটা সরকার স্পষ্টও করেনি। আমরা চাই, দ্রুত শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা হোক। যদি অন্তর্বর্তী সরকার সেটি না করতে চায়, তাহলে সেটাও তার জাতির সামনে স্পষ্ট করুক। - ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই শিক্ষা সংস্কার কমিশন চেয়ে এসেছি। সরকার অনেকগুলো কমিশন করলেও শিক্ষা সংস্কার কমিশন করেনি। কেন করেনি, সেটা সরকার স্পষ্টও করেনি। আমরা চাই, দ্রুত শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা হোক। যদি অন্তর্বর্তী সরকার সেটি না করতে চায়, তাহলে সেটাও তার জাতির সামনে স্পষ্ট করুক। ছাত্রসমাজের এ বড় দাবি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।’

আরও পড়ুন কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষা সংস্কার কমিশন ঘোষণা  শিক্ষা সংস্কারে ১২ প্রস্তাব  শিক্ষা কমিশন গঠন এখন সবচেয়ে জরুরি: মোহাম্মদ আজম  শিক্ষা কমিশন গঠনের দাবি 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা আগেও দাবি জানিয়েছি, এখনো দাবি করছি; দ্রুত শিক্ষা সংস্কারে একটি কমিশন করা হোক। প্রয়োজনে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন করা যেতে পারে। যেখানে দলমত-নিরপেক্ষ শিক্ষাবিদদের রাখা হবে। তারা শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার করে আধুনিক ও জাতির চাহিদা মোতাবেক একটি শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা উপহার দেবেন।’

শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনে কেন গড়িমসি!

শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যত ‘চুপ’। কিন্তু কেন এমন অবস্থান, তা নিয়ে মুখ খুলছেন না সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। তারা নানানভাবে বিষয়টি এড়িযে যাচ্ছেন।

তবে শিক্ষা সংস্কারের বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি সেজন্য অন্তর্বর্তী সরকার সেদিকে নজর দিচ্ছে না বলে মনে করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘস্থায়ী সংস্কার করতে হলে নির্বাচিত সরকারকে দায়িত্ব নিতে হয়। অন্তর্বর্তী সরকার একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজের জন্য গঠিত হয়। তবুও আমি বলবো—শিক্ষার সংস্কার সবার আগে জরুরি।’

কাদের নিয়ে কমিশন হতে পারে—এমন প্রশ্নে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে যারা শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে কাজ করছেন, অবদান রাখছেন, তাদের নিয়ে কমিশন গঠন করা যেতে পারে। বিগত সময়ে শিক্ষা কমিশন নিয়ে কাজ করেছেন, এমন অভিজ্ঞদের রাখতে হবে। সেখানে দলমত যাতে প্রাধান্য না পায়। এ কমিশনটা এমনভাবে গঠন করা উচিত হবে, যাতে যে কোনো রাজনৈতিক সরকার এলেও তারা (সদস্য) কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।’

মন্ত্রণালয় ইতিবাচক, সরকারের উচ্চপর্যায়ে সায় নেই!

শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই ইতিবাচক। বিষয়টি নিয়ে কিছু কাজও করেছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ কারা থাকবেন, তাদের তালিকা ও বায়োডাটা প্রস্তুত করেছে মন্ত্রণালয়। তাছাড়া কমিশন হলে তা কত সদস্যের হতে পারে এবং তাতে কারা অংশীজন থাকবেন, সে বিষয়েও ধারণাপত্র প্রস্তুত রয়েছে। তবে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এখনো নির্দেশনা না আসায় তা আর এগোয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষা সংস্কার কমিশন করার প্রস্তুতি রয়েছে। সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে সাড়া মিললে যে কোনো সময় একটি গ্রহণযোগ্য শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা সম্ভব।’

শিক্ষাবিষয়ক সাংবাদিকদের সঙ্গে বুধবার বৈঠকে শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এটা সম্ভব হবে না। শিক্ষার এতটাই খারাপ অবস্থা তিন মাসে এ নিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। এটা আমার মত।’

গত ১৮ ডিসেম্বর শিগগির শিক্ষা সংস্কার কমিশন ঘোষণার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা) অধ্যাপক ড. আমিনুল ইসলাম। কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া কতটা এগোলো—এমন প্রশ্নে ২১ জানুয়ারি তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আমরা কাজ করছি, প্রস্তুতি নিয়ে রাখছি। সব ঠিক থাকলে শিগগির কমিশন হতে পারে। সুনির্দিষ্টভাবে কবে হবে, কেমন হবে তা বলতে পারবো না।’

এএএইচ/এএসএ/জিকেএস