ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সংস্কারকাজ চলছে। আগামী সপ্তাহের মধ্যে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা চূড়ান্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কমে যাবে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ও সহ-সভাপতির সংখ্যা। এছাড়া সদস্যদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সভাপতি, সহ-সভাপতি ও পরিচালক নির্বাচিত হবে। এরপর আগামী এপ্রিলের শেষে অনুষ্ঠিত হবে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন।
Advertisement
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ব্যবসায়ীদের এ শীর্ষ সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক বসায় সরকার। ট্রেড অর্গানাইজেশন অ্যাক্ট ২০২২-এর ধারা ১৭-এর অধীনে গত ১২ সেপ্টেম্বর সাবেক অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমানকে ১২০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত কমিটির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হয়েছিল। তবে ওই মেয়াদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নতুন করে আবারো ১২০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে তাকে।
আগামী সপ্তাহে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা চূড়ান্ত হতে পারে। এটি হলে কমে যাবে পরিচালক ও সহ-সভাপতির সংখ্যা। সদস্যদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সভাপতি, সহ-সভাপতি ও পরিচালক নির্বাচিত হবেন।
প্রশাসক হাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বিভিন্ন কারণে এফবিসিসিআইয়ের সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। সংগঠনের সদস্যদের বৃহৎ অংশ সেটা চায়। সে সংস্কার আমরা দ্রুত করার চেষ্টা করছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দুটি মিটিং হয়েছে। আরেকটি মিটিং করে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা চূড়ান্ত করা হবে। সেখান থেকে এফবিসিআইয়ের আগের বিধি-বিধানে কিছু পরিবর্তন আসবে। এরপর এপ্রিলের শেষে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন হবে।
Advertisement
এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক সাবেক অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান। ছবি: এফবিসিসিআই
হাফিজুর রহমান জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রথম ১২০ দিন শেষ হওয়ার পরে আবারো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ১২০ দিন সময় নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন:
ব্যবসায়ী সংগঠনের দুর্বলতায় খেয়ালখুশি মতো সিদ্ধান্ত সরকারেরকর্মসংস্থান সৃষ্টি আমাদের লক্ষ্য: আহসান খান চৌধুরীশুল্ক-ভ্যাটের হার বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়াতে পারবেন না বিগত সরকারের সময় এফবিসিসিআইয়ের কর্মকাণ্ডবিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গত ১৫ বছরে এফবিসিসিআইয়ের কার্যক্রম ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও সেবা খাতের উন্নয়নে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি। বরং একদলীয় সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে তৎপর ছিল সংগঠনটি। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন হলেও এর নেতৃত্বে কে আসবেন, তা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ঠিক করে দেওয়া হতো। বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে সভাপতি পদে সরকার-সমর্থিত প্রার্থীর বিপরীতে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। ফলে এফবিসিসিআই সরকারের ব্যবসায়ী শাখায় পরিণত হয়।
Advertisement
বিভিন্ন কারণে সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। আগের বিধি-বিধানে কিছু পরিবর্তন আসবে। এরপর এপ্রিলের শেষে নির্বাচন। -এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক হাফিজুর রহমান
সর্বশেষ গত বছরের জুলাইয়ে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচনে আংশিক ভোট হয়েছিল। যদিও ভোটের আগেই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল, সভাপতি কে হবেন। শেষ সভাপতি মাহবুবুল আলম আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য ছিলেন। এছাড়া সাতজন সহ-সভাপতির মধ্যে পাঁচজনই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে ছিলেন। তার আগের কমিটিতেও একইভাবে আগেই নির্ধারিত জসিম উদ্দিন ও শেখ ফাহিমের মতো একাধিক সভাপতি ও অধিকাংশ সহ-সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগের নির্ধারিত প্রার্থী।
এফবিসিসিআইয়ের সংস্কার দাবিরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে ব্যবসায়ী নেতারা এফবিসিসিআইয়ে সংস্কার দাবি করেন। তারা গঠনতন্ত্রে সংস্কার আনার পর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব হস্তান্তরের দাবি জানান। সেক্ষেত্রে পরপর দুবার পরিচালক নির্বাচিত হলে অন্তত একবার বিরতি দিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিধান, মনোনীত পরিচালকের বিধান বাতিল, পর্ষদ ৩৫ থেকে ৪০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাসহ বিভিন্ন দাবি তোলা হয়।
আরও পড়ুন:
ওষুধ-পোশাকসহ নিত্যপণ্যের ভ্যাট রিভিউ হচ্ছে: অর্থ উপদেষ্টাএফবিসিসিআই থেকে চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহালের দাবিদলীয়করণে ব্যবসায়ী সংগঠনে অস্থিরতা, প্রয়োজন সংস্কারবর্তমানে এফবিসিসিআই পর্ষদের মোট ৮০ জন পরিচালকের মধ্যে ৩৪ জন হন মনোনীত। এর মধ্যে ১৭ জন মনোনীত হন চেম্বার গ্রুপ থেকে ও ১৭ জন অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে। বাকি পরিচালকরা নির্বাচিত।
নতুন করে এ সংগঠন সংস্কারের পক্ষে বাণিজ্য উপদেষ্টা নিজেও। তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী, তিনিও বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। তিনি সরাসরি ভোটের পক্ষে। ফলে শিগগির সংস্কারের সিদ্ধান্তগুলো আসবে।- সহায়ক কমিটির সদস্য আব্দুল হক
বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালার খসড়ায় এফবিসিসিআইয়ের বর্তমানের ৮০ জনের পর্ষদ ৬৮ জনে নামছে। পাশাপাশি মনোনীত পরিচালকের সংখ্যাও ৩৪ থেকে কমে চারজন হবে। পর্ষদে একজন সভাপতি, একজন সিনিয়র সহ-সভাপতি এবং চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে তিনজন করে মোট ছয়জন সহ-সভাপতি হতে পারবেন।
এফবিসিসিআইয়ের সহায়ক কমিটি গঠনবর্তমানে এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসনকে সহায়তা করতে সহায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সহায়ক কমিটির সদস্য চারজন। তারা হলেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি আবুল কাশেম হায়দার, সাবেক পরিচালক আব্দুল হক, গিয়াস উদ্দিন খোকন ও নাসিমা আওয়াল মিন্টু। এ চার সদস্যও এফবিসিসিআইয়ের সংস্কারের পক্ষে কাজ করছেন। তবে তারা দ্রুত সংস্কারের পরে নির্বাচনের দাবিও জানিয়েছেন।
আব্দুল হক জাগো নিউজকে বলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে আমরা সহায়ক কমিটির সবাই মিটিং করেছি। নতুন করে এ সংগঠনের সংস্কারের পক্ষে বাণিজ্য উপদেষ্টা নিজেও। তিনি একজন বড় ব্যবসায়ী, তিনি বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। তিনি সরাসরি ভোটের পক্ষেও। ফলে শিগগির সংস্কারের সিদ্ধান্তগুলো আসবে।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হবে এফবিসিসিআইআব্দুল হক আরও বলেন, মোটাদাগে আমরা চাই রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে একটি স্বাধীন ব্যবসায়িক সংগঠন হবে এফবিসিসিআই, যেভাবে অন্যান্য দেশের প্রধান ফেডারেশনগুলো চলছে। যার জন্য আমাদের সংগঠনের অনেক কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস দরকার। সবচেয়ে ভালো হতো একটি কমিশন করে এর সংস্কার করা হলে।
বিগত ১৫ বছরে ধ্বংস করা হয়েছে এটি। সরকারের তাঁবেদারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছিল। সেখানে সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দেওয়া যুক্তিযোগ্য নয়। -এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু
তিনি আরও বলেন, তবে ব্যাপক সংস্কার, কতটুকু সম্ভব হবে সেটা এখন বড় প্রশ্ন। কারণ দ্রুত নির্বাচনও দরকার। অনেকে আবার নতুন নেতৃত্ব চায়। ফেডারেশনে ব্যবসায়ী নেতৃত্ব না থাকায় বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। মাসের পর মাস এভাবে চললে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কা আছে।
আরও পড়ুন:
এফবিসিসিআই পর্ষদের পদত্যাগের দাবিতে ব্যবসায়ীদের অবস্থানএফবিসিসিআই-রিহ্যাব বৈঠক, ড্যাপে ফারের বৈষম্য দূরের দাবিশিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চাইলেন ব্যবসায়ীরাআব্দুল হক বলেন, সেটা হলে পরে আবার রাজনৈতিক সরকার সংস্কার করবে কি না সেটা অনিশ্চিত। এ সময় সংস্কারের সবচেয়ে বড় সুযোগ ছিল। অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারগুলোও সমস্যায় রয়েছে, সেগুলো দেখতে হবে। সব মিলিয়ে একটি বড় জটিলতাও হচ্ছে।
সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন। সেই সংগঠন বিগত ১৫ বছরে ধ্বংস করা হয়েছে। সরকারের তাঁবেদারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছিল। সেখানে সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। তাহলে সেটা আবারো তাঁবেদারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।
তিনি বলেন, আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি, এ প্রতিষ্ঠানকে কার্যকর করে গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃতপক্ষে যেন ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নের জন্য সহায়ক প্রতিষ্ঠান হয়। আশা করছি, মন্ত্রণালয় দ্রুত সংস্কার করে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন দেবে।
এনএইচ/এসএনআর/এমএমএআর/জেআইএম