পেঁয়াজ চাষে পাবনার সুনাম দেশজুড়ে। দেশের মোট উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশই উৎপাদন হয় পাবনায়। এরমধ্যে বেশি উৎপাদন হয় জেলার বেড়া, সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলায়। তবে কমবেশি সব উপজেলাতেই আবাদ হয় পেঁয়াজের।
Advertisement
মুড়িকাটা পেঁয়াজ উত্তোলন শেষে বাজারজাতকরণের ব্যস্ততার পাশাপাশি জেলাজুড়ে এখন কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি হালি বা চারা পেঁয়াজ রোপণে ব্যস্ততা। এ পেঁয়াজ রোপণে বাড়ির পুরুষ ও নারীদের পাশাপাশি চাষিদের নিতে হয়েছে শ্রমিক। এ শ্রমিক হিসেবে মাঠে যারা কাজ করছেন তাদের বড় একটি অংশই স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী। এসময়টাতে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থায় শ্রমিক চাহিদা ও স্কুল-কলেজে শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা কম থাকায় শ্রমিক হিসেবে পেঁয়াজ রোপণ করছেন শিক্ষার্থীরা।
চাষি ও এসব শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিসেম্বরের শুরু থেকে এসব অঞ্চলে চারা বা হালি পেঁয়াজের চারা রোপণ শুরু হয়েছে। চলবে পুরো জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। সুজানগরের গাজনার বিল ও সাঁথিয়ার গজারিয়া বিলসহ বিস্তীর্ণ মাঠে একযোগে শুরু হয় পেঁয়াজের চারা রোপণ। এসময় বাড়ির সব বয়সী নারী ও পুরুষ পেঁয়াজের চারা রোপণে ব্যস্ততম সময় কাটান। তবে এতেও সঠিক সময়ে রোপণ শেষ সম্ভব হয় না। ফলে আলাদা করে শ্রমিক নিতে হয় তাদের। জেলার বাইরে থেকেও এসময় অনেক লোক আসেন পেঁয়াজের চারা রোপণ করতে। চাহিদা থাকায় তাদের পারিশ্রমিকও বাড়তি।
অন্যদিকে বছরের শেষের এসময়টাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষা কার্যক্রম ধীরগতিতে চলে। লেখাপড়ায় তেমন চাপ না থাকায় শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে মাঠে পেঁয়াজের চারা রোপণ করেন। বয়স ও সক্ষমতাভেদে ৪০০-৭০০ টাকা পারিশ্রমিক পান তারা। বছরের শুরুতে ক্লাস শুরু হলেও কিছুদিন ক্লাসে অনুপস্থিত থেকেও এ কাজ করেন শিক্ষার্থীরা।
Advertisement
সুজানগরের গাজনার বিল ও সাঁথিয়ার গজারিয়া বিলসহ এ অঞ্চলের মাঠগুলো ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন মাঠে স্বাচ্ছন্দ্যে পেঁয়াজ রোপণ করছেন শিক্ষার্থীরা। তবে এ চিত্র বেশি দেখা গেছে জেলার সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার মাঠগুলোতে। আটঘরিয়া ও সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন জায়গা থেকেও এসেছেন বেশকিছু শিক্ষার্থী। তারা জানান, ডিসেম্বর মাসের পুরোটাই ক্লাস বন্ধ থাকে। তাই ঘরে বসে বা আড্ডায় সময় নষ্ট না করে অতিরিক্ত কিছু আয়ের জন্য তারা স্বেচ্ছায় এ কাজে এসেছেন।
বেড়া উপজেলার চাকলা গ্রামের মোল্লাপাড়া মাঠে পেঁয়াজের চারা রোপণ করছিল শাকিল। সে উপজেলার পুন্ডুরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র।
শাকিল জানায়, তার মতো আরও অনেক শিক্ষার্থীই দিনপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা পারিশ্রমিকে এখানে কাজ করছেন। তবে তাদের চেয়ে আরও অল্প বয়সীরা ৪০০-৫০০ টাকা পারিশ্রমিকে কাজ করছে। সঙ্গে দুইবেলা খাবার দেন মালিকরা।
কিছু শিক্ষার্থী ব্যাচসহ নেমে পড়েছেন পেঁয়াজ রোপণে। কোনো ব্যাচে ১০ জন আবার কোনোটায় ২০-৩০ জন করে শিক্ষার্থী কাজ করছেন।
Advertisement
একই বিদ্যালয়ের নবম শেণির ছাত্র সজীব বলে, ‘ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকে বিদ্যালয় বন্ধ থাকে। জানুয়ারিতে ক্লাসও কম। তাই বাড়তি কিছু টাকা রোজগারের জন্য পেঁয়াজ রোপণ করছি।’
আরও পড়ুন মানিকগঞ্জে হালি পেঁয়াজের চারা রোপণের ধুমসাঁথিয়ার গজারিয়া বিলের জমিতে পেঁয়াজ লাগাচ্ছে মুরাদ মালিথা। এবার নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে সে। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার ইচ্ছা তার। এক্ষেত্রে নোট, গাইড ও প্রাইভেট পড়াসহ অনেক ব্যয় আছে জানিয়ে মুরাদ বলে, ‘সারা বছর এসব ব্যয় মেটাতেই আব্বার কষ্ট হয়ে যাবে। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেশি, খরচও বেড়েছে অনেক। নতুন ক্লাসে ওঠার পর ব্যক্তিগত অতিরিক্ত কিছু খরচ আছে। সেগুলোর কথা আব্বাকে বললে চাপ দেওয়া হয়ে যেতো। তাই অন্যদের সঙ্গে কাজ করছি। যা আয় হবে তা দিয়ে জুতা, পছন্দের শীতের পোশাকসহ অন্যান্য প্রয়োজন মেটাবো। গাইডও কেনা যাবে।’
সুজানগরের গাজনার বিলের মাঠে কাজ করা স্কুলছাত্র হৃদয়ের ভাষ্য, ‘পাবনা থেকে কাজ করতে এসেছি। দেড় থেকে দুই সপ্তাহের মতো পেঁয়াজের চারা লাগালাম। আজ এ জমিতে লাগানো শেষ করে বাড়ি যাবো। কিছু টাকা জমানো ছিল। তার সঙ্গে এই টাকা লাগিয়ে একটা স্মার্টফোন কিনবো। এর আগে কয়েকদিন কাজ করে জুতা কিনেছিলাম।’
চাষিরা জানান, এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ রোপণে কমপক্ষে ১০-১২ জন শ্রমিকের দরকার হয়। এসময় রংপুর, বগুড়া ও লালমনিরহাটসহ কয়েকটি জেলা থেকে শ্রমিকরা আসেন। জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকেও আসেন অনেকে। এদের সঙ্গে যোগ দেন শিক্ষার্থীরাও। এতে শ্রমিক সংকট অনেকটা কেটে যায়।
বেড়া উপজেলার চকপাড়া গ্রামের চাষি আরজান মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবারে ১০ বিঘা জমিতে হালি পেঁয়াজ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরইমধ্যে সাত বিঘা লাগানো শেষ। বেশকিছু ছাত্র পেঁয়াজ লাগাচ্ছে জমিতে। লেবার পাওয়া মুশকিল। তারা দক্ষ না হলেও টুকটাক ভালোই লাগাচ্ছে।’
আরও পড়ুন ঋণের দায়ে পালানোর উপক্রম পাবনার পেঁয়াজ চাষিদেরচাষি আব্দুর রহমান বলেন, গ্রামের ছাত্ররা এ কাজটি ভালো পারে এবং মজুরিও কম। তাই তাদের দিয়ে আমরা পেঁয়াজ রোপণের চেষ্টা করি।
জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, চলতি মৌসুমে জেলায় চারা বা হালি পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৪ হাজার ২২১ হেক্টর জমিতে। এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজার ৮০১ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। রোপণ শেষ হলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ হবে বলে আশা কৃষি বিভাগের।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) রোকনুজ্জামান বলেন, পাবনার বিস্তীর্ণ জমিতে ব্যাপক পেঁয়াজের আবাদ হয়। একযোগে চারা পেঁয়াজ রোপণের সময় শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। অথচ নির্দিষ্ট সময়ে চারা না লাগাতে পারলে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকে যায়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাশ্রমে যদি অবসর সময় পেঁয়াজের চারা রোপণে আত্মনিয়োগ করেন, তবে সেটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক বিষয়।
আলমগীর হোসাইন নাবিল/এসআর/জিকেএস