ফিচার

খেজুরের রস ও শীতের সকাল: বাড়বকুণ্ডের অপরূপ দৃশ্যপট

আরিফুল ইসলাম তামিম

Advertisement

সারি সারি ছোট-বড় শত শত খেজুর গাছ। এসব গাছের সবকটিতেই রসে টইটম্বুর। টপ টপ করে সবকটি গাছেই ঝুলানো প্লাস্টিকের জারে জমা হচ্ছে খেজুরের রস। ঘন কুয়াশার কারণে কয়েকটি গাছের পরে আর কিছু দেখা সম্ভব হচ্ছেনা। শীতের সকালে এমন খেজুরের রস আর গ্রামীণ প্রাকৃতিক পরিবেশের দেখা মিলছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকায়।

খেজুরের রস আহরণের এমন অপূর্ব দৃশ্য দেখতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগরের অলংকার মোড় থেকে সীতাকুণ্ডগামী বাস চেপে বাড়বকুণ্ড নেমে রিকশা কিংবা লোকাল সিএনজি যোগে ২০-৩০ টাকা ভাড়ায় বেড়িবাঁধ নামতে হবে। তবে এমন দৃশ্য দেখার জন্য আপনাকে মধ্যরাতেই বাসা থেকে বের হতে হবে সেক্ষেত্রে লোকাল বাস নাও থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে বাইক কিংবা ব্যক্তিগত যেকোনো গাড়ি হলে খুব সহজেই রস আহরণের এই দৃশ্য ও এখানকার প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র উপভোগে ছুটে যেতে পারেন।

সম্প্রতি রাত ৪ টায় পাঁচ বন্ধু মিলে আমরা চট্টগ্রাম শহর থেকে রওনা হই বাড়বকুন্ড বেড়িবাঁধে রস অভিজানের উদ্দেশ্য। প্রায় ৪০-৫০ মিনিট পরেই পৌঁছে যাই বাড়বকুণ্ড। এরপর গ্রামীণ আঁকাবাঁকা সড়ক আর কুয়াশা পেরিয়ে গ্রামীণ জনজীবন আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে প্রায় দেড় কিলোমিটার এগিয়ে গেলে খেজুর রসের ঘ্রাণ আপনাকে জানান দেবে বরাবর গন্তব্যে চলে এসেছেন।

Advertisement

ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। এরমধ্যে রাত ৩ টায় প্রথম ধাপে আহরণ করা প্রায় কয়েক হাজার লিটার খেজুরের রস। এরপর এই রস নিয়ে বিক্রেতারা ছুটে যাচ্ছেন শহরের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রির উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় ধাপে আবার বসানো হয়েছে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য প্লাস্টিকের জার। দ্বিতীয় ধাপের রস আহরণ দেখার জন্য এবার অপেক্ষার পালা।

বেড়িবাঁধের এই এলাকায় খেজুরের রস আহরণের দৃশ্য আর শীতের সকালের কুয়াশামাখা পরিবেশে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে ভোরের আলো ফোটার আগেই এখানে উপস্থিত হতে হবে।

যতদুর চোখ যায় সড়কের দু'পাশে শুধুই খেজুরের গাছ। কুয়াশা মোড়ানো চারপাশে হিমেল হাওয়া বইছে, ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ জনজীবনের ব্যস্ততাও দেখা মিলছে। কেউ চাষাবাদের কাজে আবার কেউ বেড়িয়েছেন গরু-ছাগল চড়াতে। সড়কের দুইধারে বিস্তীর্ণ ফসলি জমি, সবুজ গাছগাছালি, পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চারপাশ। বেড়িবাঁধের উপর থেকে দেখা যাচ্ছে বাড়বকুণ্ড সমুদ্র সৈকতের নান্দনিক চিত্রপট। আর সমুদ্রের বুক চিরে কিরণ দিচ্ছে রক্তিম সূর্য। প্রকৃতির এমন রূপবৈচিত্র্য, গ্রামীণ সজীবতা, যে কাউকেই মুগ্ধ করবে।

সূর্য ওঠার পরই এই স্থানে দ্বিতীয়ধাপে গাছিদের রস নামানোর ব্যস্ততা শুরু হয়। এখানে গাছিরা দিনের ২ সময় রস সংগ্রহ করেন। রস সংগ্রহের ব্যপারটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হলেও গাছিরা রস সংগ্রহের সময় এখানে উৎসবমুখর এক আবহ সৃষ্টি হয়। বিকাল ৪ টায় খেজুর গাছ গুলোতে প্লাস্টিকের জার ঝুলিয়ে দেন গাছিরা। সারারাত রস জমা হতে থাকে। রাত ৩ টায় এসব রস নামানোর কাজ শুরু হয়। প্রথম ধাপে রস নামিয়ে আবার প্লাস্টিকের জার ঝুলিয়ে দেন গাছিরা যা থেকে আবার সকাল ৭-৮ টার সময় রস আহরণ করা হয়। প্রতি গাছ থেকে ৪-৫ লিটার রস সংগ্রহ করতে পারেন স্থানীয় গাছিরা।

Advertisement

রস আহরণের এই দৃশ্য দেখতে ও সুস্বাদু রস কিনে নিতে প্রতিদিন অসংখ্য ক্রেতা ভিড় করেন বেড়িবাঁধের এই স্থানে। কেউ কেউ আগেই এখানকার গাছিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রস কিনতে আসেন। ৪০-৫০ টাকা মূল্য যে কেউ এখান গাছ থেকে নামিয়ে সুস্বাদু রস কিনে বাড়িতে নিতে পারছেন।

একসময় খেজুর গাছের রস সংগ্রহে মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হলেও এখন হাড়ি বাদ দিয়ে প্লাস্টিকের জার ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় গাছি ইমন জানান, এক সময় রস সংগ্রহে মাটির হাড়ি ঝোলানো হতো। কিন্তু অনেকে হাড়ি ভেঙে ফেলেন আবার চুরি হয়ে যায় সেজন্য এখন প্লাস্টিকের জার ব্যবহার করি আমরা। এখানে প্রায় ৫ শতাধিক খেজুরের গাছ রয়েছে। যেখান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৫-১০ হাজার লিটার রস আহরণ করা যায়।

গ্রামবাংলার সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ খেজুরের গাছ ও রস আহরণ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় অনেকটা অযত্নে-অবহেলায় কমতে শুরু করেছে খেজুর গাছের সংখ্যা। এভাবে কমতে থাকলে একসময় খেজুর গাছ ও রস আহরণের গ্রামীণ এই চিরায়ত দৃশ্য হারিয়ে যাবে। তাই খেজুর গাছ সংরক্ষণ ও রোপণে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন ঐতিহ্যের টানে ৪০০ বছরের পুরোনো সানোড়ার মেলায় ক্যামেরার ফ্রেমে জীবনের গল্প বলেন নাহিদ

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগ, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম

কেএসকে/এএসএম