সকাল ৯টা। জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) গিয়ে চোখ কপালে ওঠার দশা! হাসপাতালটির বহির্বিভাগে শত শত মানুষ। প্রবেশ করা বা হাঁটাও কঠিন।
Advertisement
বেশিরভাগ রোগী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত। কেউই একা একা হাঁটাচলা করতে পারছেন না। তাই সঙ্গে এসেছেন একাধিক স্বজন। হাসপাতালের কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই নেই। টিকিট কাউন্টার থেকে ডাক্তারের রুম পর্যন্ত যেতে রোগীদের একপ্রকার যুদ্ধ করতে হয়। তবুও মেলে না কাঙ্ক্ষিত সেবা
মঙ্গলবার (১৪ জানুয়ারি) জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন (নিটোর) প্রতিষ্ঠানে গিয়ে এ চিত্রই চোখে পড়ে।
নিটোর কর্তৃপক্ষ বলছে, ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি রোগীর ভিড়। রোগীর স্বজনরাও বলছেন, সকাল থেকে যুদ্ধ করেই চিকিৎসা নিতে হয়।
Advertisement
বেশি রোগীর চাপে চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদেরও হিমশিম অবস্থা। কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করা যায় না। অসন্তুষ্টি নিয়েই ফিরে যেতে হয় অনেক রোগীকে।
এত চাপ কেন? এটা আজকের চিত্র, নাকি প্রতিদিনকার? প্রশ্নের জবাবে ওপিডি টিকিট কাউন্টারের ইনচার্জ লিয়াকত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সাধারণত ৯০০ থেকে ১১০০ রোগী আসে প্রতিদিন। আজ একটু বেশি, প্রায় ১৪০০ রোগী সকাল থেকে টিকিট কেটেছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের বহির্বিভাগে ১০টি রুমে বিভিন্ন বিভাগের প্রায় ৩০ জন ডাক্তার চিকিৎসা দেন। তবে সামর্থ্যের তুলনায় রোগীর চাপ অনেক বেশি।
একই চিত্র জরুরি বিভাগেও। সেখানেও রোগী নিয়ে স্বজনরা ছুটে এসেছেন। কয়েক মিনিট দাঁড়ালে একজন মানুষের স্বাভাবিক থাকা দায়।
Advertisement
জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার (ইএমও) ডা. রাকিজ খান জাগো নিউজকে বলেন, এই চিত্র ২৪ ঘণ্টাই থাকে। রাত ৩টায় এলেও এরকম ভিড়। প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ রোগী আসে। সারাদেশ থেকে বেশি খারাপ অবস্থার রোগীরাই এখানে আসেন। বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনার রোগী। বিশেষ করে মোটরসাইকেলের দুর্ঘটনা। কিছু রোগী থাকে প্রবীণ, হাঁটতে গিয়ে পিছলে পড়ে হাড় ভেঙে গেছে।
আরও পড়ুন সরেজমিন শিশু হাসপাতাল/সর্দি-কাশি ও নিউমোনিয়ার রোগীর চাপ, সতর্কতার পরামর্শ চিকিৎসকদের অভিযোগ নেই, তবে সমস্যার শেষ নেইচাঁদপুরের মতলব থেকে মা ও খালার সঙ্গে এসেছে ৫ বছরের মিথিলা। এক মাস আগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পা ভেঙে গেছে। নিটোরে থেকেই প্লাস্টার করে নিয়ে গেছেন, আজ এসেছেন ফলোআপ করাতে। এক্স-রে করে ট্রলিতে রোগী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সিরিয়ালে। মানুষের চাপে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করাই দায়। দালাল ধরে রিপোর্ট দেখিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু ভেতরে গিয়ে ডাক্তারকে রোগী দেখানোর সুযোগ হয়নি।
মিথিলার মা জানিয়েছেন, বাড়ি থেকে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে আসছি। ওরে তো ট্রলি ছাড়া মুভ করাতে পারি না। এখানে এসে একজন লোক ধরে টিকিট কাটা, এক্স-রে করে ডাক্তার দেখিয়েছি। লোক ছাড়া তো আমাদের কিছু করার নেই। কোথায় কোন রুমে যাবো, তাও তো চিনি না। আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে আফসোস হলো, ডাক্তারকে সশরীরে দেখাতে পারলাম না। একটু কথা বলতে পারলাম না।
উত্তরবঙ্গের মিলন মিয়া, মাওনা থেকে এসেছেন ছেলে মেহেদী হাসানকে (১৫) নিয়ে। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেহেদী চার বছর ধরে হিপ জয়েন্টের ব্যথায় ভুগছে। দিনমজুর বাবা সন্তানের জন্য সর্বস্ব খুইয়েছেন। তারপরও সন্তোষজনক চিকিৎসা পাচ্ছেন না। আজ সকাল ৮টায় এসে একরকম সিরিয়ালের যুদ্ধ শেষ করে টিকিট নিয়ে ডাক্তারের রুমে যান। সব সময় ডা. সারোয়ারকে দেখান। কিন্তু আজ পাননি। যে কারণে হতাশ তিনি। অন্য ডাক্তার নাপা লিখে বিদায় দিয়েছেন। বলেছেন, আর আসা লাগবে না। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না, ছেলে সুস্থ হলো কি না বা হবে কি না।
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে এসেছেন মাখম (৫০)। এক বছর আগে পা ভাঙে। অপারেশন করিয়েছিলেন। ফলোআপে এসেছেন। সকাল ৮টায় এসে সিরিয়াল ধরে টিকিট কেটে বেলা ১১টায় ডাক্তার দেখিয়েছেন। এক্স-রে দিয়েছে, হাসপাতালের নিচতলায় এক্স-রে রুমে গেছেন স্ট্রেচারে ভর করে। কিন্তু তারা ফেরত দিলো। জরুরি বিভাগে যেতে বললো। জরুরি বিভাগে বিশাল সিরিয়ালে পড়ে গেছেন।
এই রোগীর পেছনে ঘুরে পুরো প্রক্রিয়া দেখে মানুষের অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। একজন লোক তার সঙ্গে দুজন অভিভাবক। স্ট্রেচারে ধীরে ধীরে এক রুম থেকে আরেক রুমে যাওয়া, এ যেন না বলা এক কষ্টের গল্প।
রেডিওলজি এবং ইমেজিং বিভাগের এক্স-রে রুম-১ এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি জানান, এক্স-রে হচ্ছে। তবে রোগী ফেরত দিচ্ছেন কেন? জানতে চাইলে বলেন, ফিল্ম নেই। অথচ এই প্রতিবেদকের সামনেই দুজন এক্স-রে করে নিয়ে গেলেন।
হাসপাতালটির নানান বিভাগে কথা বলে জানা গেছে, সব মিলিয়ে এখানে ১ হাজার বেড। রোগী আছে ১ হাজার ৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ৮৯ জন ছুটি পেয়েছেন, ভর্তি হয়েছেন ৯৯ জন। এরমধ্যে জরুরি বিভাগ থেকে ৭৯ জন ভর্তি হয়েছেন। বহির্বিভাগে মূলত সিট খালি থাকা সাপেক্ষে জরুরি প্রয়োজনের ভিত্তিতে কিছু ভর্তি দেয়। বেশিরভাগই ফেরত দিতে হয়। কারণ সংকুলানের চেয়ে চাপ বেশি।
সড়ক ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বারোপনিটোরের বিশাল সংখ্যক রোগীর বেশিরভাগই সড়ক দুর্ঘটনার। এজন্য সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে গতানুগতিক গতি কমানো, ড্রাইভিং লাইসেন্স চেকের পাশাপাশি সড়ক ব্যবস্থাপনায় জোর দেওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের। নিটোরের ইএমও রাকিজ খান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এখন গুরুত্ব দেওয়া দরকার সড়ক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। অর্থাৎ হাইওয়ে থেকে লোকাল সড়কে ঢুকতে গাড়ি কতটুকু ঢালুতে নামতে পারবে, দূরত্ব কত রাখা দরকার, কত স্পিডে নামতে পারবে? এসব মনিটরিং করে সঠিক উদ্যোগ নিতে হবে। হুট করে নামিয়ে দিলেই দুর্ঘটনা ঘটে। একইভাবে শীতকালে ফগ লাইট না থাকায় দুর্ঘটনা হয়। বর্ষাকালে স্লিপ কেটে দুর্ঘটনা হয়। এসব বিবেচনায় নিতে হবে।
এসইউজে/এসআইটি/এএসএম