মতামত

রোগের চিকিৎসায় ডাক্তার স্বাস্থ্য খাত সারাবে কে?

মাত্র ক’দিন আগে গুরুত্বপূর্ণ এক বৈঠকে বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে শুরু করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সদর হাসপাতালসহ, মেডিক্যাল কলেজের যন্ত্রপাতির তথ্য উপাত্ত, যন্ত্রপাতি ঠিকমতো মেরামত, সংরক্ষণ ও অকেজো যন্ত্রপাতি কার্যোপযোগী করার উপায় নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকটি ছিল মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট ও ডিভাইস বিষয়ে। সেখানে এ সংক্রান্ত তথ্য ঘাটতিতে কষ্টের কথা জানিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। বলেছেন, আমরা খালি ওষুধের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি। আসলে এটা কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা না, এটা চিকিৎসা-ব্যবসা হয়ে গেছে। সবাই মিলে রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে ফিরে গেলে সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি হবে বলে আশা তার। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, পরিচালক এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা তার কথা শুনেছেন। মাথা নেড়েছেন। কিন্তু, জের বা ফলো আপ কী?

Advertisement

বিশেষায়িত হাসপাতাল জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালে বিভিন্ন রুমের সামনে নোটিশ ঝুলছে, ‘মেশিন নষ্ট’। ভুক্তভোগী রোগী ও স্বজনদের চরম দুর্গতি যাচ্ছে সেখানে। ৬ থেরাপি মেশিনের সবগুলোই বিকল। ঘুষ দাবির ২৫ হাজার টাকা না পাওয়ায় এক ক্যানসার রোগীকে ৬ মাস পরের রেডিওথেরাপির সিরিয়াল দেওয়ায় দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে অভিযোগ গেছে এক ওয়ার্ডবয়ের বিরুদ্ধে । হাসপাতালটিতে কর্মরত আনসার, ওয়ার্ডবয় ও আয়াদের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সিরিয়াল পাইয়ে দেওয়াসহ অন্যান্য অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের দু’জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত এনফোর্সমেন্ট টিম এ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানকালে টিম ছদ্মবেশে ক্যানসার রোগীদের সঙ্গে সেখানে কর্মরত আনসার ও আয়াদের খাদ্যবিতরণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এবং টাকার বিনিময়ে চিকিৎসকদের সিরিয়াল পাইয়ে দেওয়াসহ বেশকিছু অনিয়ম সম্পর্কে জানতে পারে তারা। তাদের জানার বাইরে আরো অনেক কিছুই রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির অভিযোগ বহু পুরোনো এবং অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এর সঙ্গে আছে দলীয় পরিচয়ে পদায়ন, পদোন্নতিসহ অনিয়মের নানা ঘটনা। সবমিলিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের রূপরেখা তৈরি এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে চাপ আছে অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের উপর। কিন্তু একদিকে যখন অধিদপ্তর অনেকটাই অকেজো, তখন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দপ্তর থেকেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জোরালো কোনও পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

দেশের ক্যানসার আক্রান্ত গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল-এনআইসিআরএইচের অভ্যন্তরে এক গুরুচরণ দশা যাচ্ছে। বিশেষায়িত আরেক হাসাত হৃদরোগ হাসপাতাল। কার্ডিয়াক সার্জারি, পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি এবং ভাস্কুলার সার্জারিসহ বিভিন্ন বিভাগে বিশেষায়িত চিকিৎসা পান রোগীরা। হাসপাতালের বিশটি ইউনিটের মাধ্যমে দেয়া হতো এসব চিকিৎসা। এই দুই উদাহরণের বাইরে হাসপাতালগুলোর অভ্যন্তরীণ দশা কম-বেশি এমনই। এমনিতেই আমাদের স্বাস্থ্য খাত একটা আস্ত রোগী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্বাস্থ্যসেবা খাতে ভর করে নতুন নৈরাজ্য। প্রথম ধাপে কয়েকদিন চলে এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পদত্যাগ দাবির অস্থিরতা। সেটা কিছুটা কাটতে না কাটতেই শুরু হয় বঞ্চিতদের প্রাপ্য ফিরে পাওয়ার দাবিতে অস্থিরতা। এ নিয়ে প্রতিদিনই মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন করছে চিকিৎসক, নার্সদের বিভিন্ন সংগঠন। যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অচলাবস্থা তৈরি করে। সেখানে আওয়ামীপন্থী চিকিৎসকদের স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপের উৎপাত কমে। সমান্তরালে শুরু হয় বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাবের আধিপত্য।

Advertisement

ওই পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাপক এম এ ফয়েজকে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি করে। অবস্থা দেখে তিনি এই পদ থেকে পদত্যাগ করে নিস্তার নেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমও ক’দিন গরহাজির থেকে বিদায় নেন। ওই সময়ে মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয় অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকে। বাধার মুখে পড়ে তিনি অফিসেই ঢুকতে পারেননি। পরে তাঁকেও সরিয়ে দিয়ে অধ্যাপক নাজমুল হোসেনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক করা হয় । সেখানেও বিপত্তি। সঙ্গে আরো নানা গোলমাল। অভ্যন্তরীণ গোলমালে সেখানে ১০টি ইউনিট বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ফলাফল যা হবার তাই হলো।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির অভিযোগ বহু পুরোনো এবং অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। এর সঙ্গে আছে দলীয় পরিচয়ে পদায়ন, পদোন্নতিসহ অনিয়মের নানা ঘটনা। সবমিলিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, স্বাস্থ্যখাতে সংস্কারের রূপরেখা তৈরি এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে চাপ আছে অধিদপ্তর এবং মন্ত্রণালয়ের উপর। কিন্তু একদিকে যখন অধিদপ্তর অনেকটাই অকেজো, তখন স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দপ্তর থেকেও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জোরালো কোনও পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এসবের মধ্য দিয়ে এক একটা হাসপাতাল নিজেই এক একটা রোগী হয়ে গেছে। এ রোগ সারাবে কে?

হাসপাতাল ও ডাক্তারদের এ রোগাক্রান্তের ফাঁকে যে ওষুধের দাম দ্বিগুণ- ত্রিগুণ হতে হতে কোনো কোনোটির দাম শত শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। রোগী বা স্বজনদের এ নিয়ে বাদানুবাদের বাইরে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। সময়ের সদ্ব্যবহার করছে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো । এ ক্ষেত্রে তারা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়মের তোয়াক্কা করছে না। এতে নিত্যপণ্য কিনতে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষের কী দুর্গতি যাচ্ছে তা দেখার কেউ নেই। অত্যাবশ্যকীয় ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। এর বাইরে যত ওষুধ বাজারে রয়েছে, বেশির ভাগ উৎপাদক কোম্পানির ঠিক করা দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে এর জন্যও কিছু প্রক্রিয়া মানতে হয় কোম্পানিগুলোকে। নতুন দরের যুক্তিসহ অনুমোদনের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করতে হয়। সরকার আমদানি কাঁচামালের সোর্স কান্ট্রি, দর, মানসহ বিভিন্ন বিষয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে যাচাই শেষে সমন্বয় করে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও এ নিয়ম মানেনি কোম্পানিগুলো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজারে দাম কার্যকর করে তা অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বড় বড় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই সরকারকে চাপে রাখে। যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের সক্ষমতা না থাকায় অধিদপ্তরও মেনে নিতে বাধ্য হয়। বিত্তবানরা মানিয়ে নেবেন। নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে ওষুধের বাড়তি দাম চুকাতে হবে প্রাণের মূল্যে। এমনিতেই হতদরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। এখন আরো বাইরে। আফসোস বা জেদে আরো রোগী হওয়াই বুঝি তাদের নিয়তি?

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

Advertisement

এইচআর/জিকেএস