কোভিড পরিস্থিতি, অটোপাস, শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিবর্তন, শিক্ষকদের ধর্মঘট, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সরকার পরিবর্তন ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে তারা লেখাপড়া থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে অমনোযোগী হয়ে ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরীক্ষা দিয়ে না দিয়ে, কৃতকার্য হয়ে না হয়ে পরের শ্রেণিতে উঠেছে। কেউ কেউ আবার অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত সহানুভূতি দেখাচ্ছেন। এমনকি তাদের উপরের শ্রেণিতে তুলে নেওয়ার জন্য এবং বোর্ড পরীক্ষার ফরম পূরণ করানোর জন্য জোর দাবি করছেন। এই সুযোগে অনেক শিক্ষার্থী আবার প্রাতিষ্ঠানিক ও বোর্ড পরীক্ষায় অটোপাসকে তাদের অধিকার মনে করে আন্দোলনে নেমে পড়ছে! কিছু অভিভাবক তাদের তাল দিয়ে বেতাল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন!
Advertisement
এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন অনেক বেশি যারা লেখাপড়া করে না, ধৈর্য ধরে না, ক্লাস করে না, মান্য করে না, বেতন-ফি দেয় না, পরীক্ষা দেয় না, কৃতকার্য হয় না; কিন্তু উত্তম সনদ আদায় করে নিতে চায়! বিভিন্ন স্তরে/শ্রেণিতে অবস্থিত আমাদের এমন শিক্ষার্থীদের টেনে নিতে হবে আরো অনেক বছর। তাদের প্রতি অযৌক্তিক মানবিকতা দেখাতে গিয়ে অটোপাস বা ইজি পাসের সুযোগ দিয়ে অযোগ্য বা কম যোগ্য নাগরিক তৈরি করে আমরা যে ক্রমাগত দুর্বল জাতিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছি এবং আরো দুর্বল হয়ে যাবো তা কেউ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছেন না! এভাবে চলতে থাকলে শুধু দেশে নয়, বিদেশে গিয়েও আমাদের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এমনকি বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। তাই বর্তমান বাস্তবতার ভিত্তিতে অতি দ্রুত বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে এই অধোগতি থেকে উত্তরণ আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, এসএসসি বা সমমান কিংবা এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় কোনো শিক্ষার্থী যদি এক চান্সে সকল বিষয়ে পাস করতে না পারে তাহলে পরবর্তী বছরের পরীক্ষার্থীদের সাথে কয়েকটি বিষয় রেফার্ড পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে এবং সেগুলোতে উত্তীর্ণ হলে এসএসসি বা সমমান কিংবা এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষা পাসের সনদ দেওয়া হয়ে থাকে। দুর্বল ও সমস্যা সংকুল শিক্ষার্থীদের জন্য এটি অবশ্যই একটি ভালো সুযোগ। তবে তাদের এক বছর লস হয়। তাছাড়া তারা একসঙ্গে ১০-১২ টি বিষয়ের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে অন্যান্য বিষয়েও খুবই কম নম্বর পেয়েই কৃতকার্য হয়ে থাকে। ফলে ওই অকৃতকার্য বিষয়গুলোতে পরবর্তী বৎসরে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলেও তাদের সুনাম থাকে না, মোট ফলাফল তেমন ভালো থাকে না।
এমন মন্দ ফলাফল দিয়ে তারা পরবর্তী শিক্ষায় ও কর্মে ভালো সুযোগ পাওয়ার জন্য আবেদনই করতে পারে না। অথচ এমন অনেক শিক্ষার্থী থাকে পরবর্তীতে যাদের পরিবেশ অনুকূল হবার কারণে বা অন্তর্দৃষ্টি খুলে যাওয়ার কারণে কিংবা উৎসাহ-উদ্দীপনা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে অনেক ভালো করতে পারতো। কিন্তু ওই পরীক্ষার মন্দ ফলাফল সারা জীবনই তাদের ভালো সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা অন্তরায় হিসেবে থেকে যায়। তাদের প্রতি অন্যদের একটা অবহেলার দৃষ্টি বা অবমূল্যায়ন থেকে যায়। সেই সাথে তাদের বুকে থেকে যায় একটা পাথর চাপা কষ্ট! যা সকল অর্জনের ক্ষেত্রেই কম/বেশি বিরূপ প্রভাব ফেলে। অনেকেই আর ওভারকাম করতে পারেনা সেটি। তাদের পিছু নেয় বেকারত্ব। কেউ কেউ চলে যায় বিপথে, নিমজ্জিত হয় অন্ধকার জগতে!
Advertisement
এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে এসএসসি বা সমমান এবং এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষা দুই ধাপে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অর্থাৎ এসএসসি বা সমমান এবং এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষার মোট বিষয়/পত্রসমূহকে দুই ভাগে ভাগ করে দুই বৎসরে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের সুযোগ দিয়ে ভালো লেখাপড়া করার ও ভালো ফলাফল নিশ্চিত করার সম্ভবনা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। যেমন, এসএসসি বা সমমানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নবম শ্রেণিতে অধ্যয়ন শেষে ৫টি বিষয়/পত্রের বোর্ড পরীক্ষা গ্রহণ করে এবং দশম শ্রেণিতে অধ্যয়ন শেষে অবশিষ্ট ৫টি বিষয়/পত্রের বোর্ড পরীক্ষা গ্রহণ করে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করা যেতে পারে। অনুরূপভাবে শিক্ষার্থীদের এইচএসসি বা সমমানের ক্ষেত্রে একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়ন শেষে ৬টি বিষয়/পত্রের বোর্ড পরীক্ষা গ্রহণ করে এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়ন শেষে অবশিষ্ট ৬টি বিষয়/পত্রের বোর্ড পরীক্ষা গ্রহণ করে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করা যেতে পারে।
অন্তত কয়েক বছরের জন্য হলেও আমাদের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের কিছুটা উত্তরণের জন্য এইরূপ দুই ধাপে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। এতে করে শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ কমবে, নিজের উপর আস্থা বৃদ্ধি পাবে, প্রতিটি বিষয়ের প্রস্তুতি ভালো হবে, তুলনামূলকভাবে পরীক্ষা ও ফলাফল অধিক ভালো হবে এটিই স্বাভাবিক। বিশেষ করে দুর্বল শিক্ষার্থী যারা একসঙ্গে ১০-১২ বিষয়ের প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিতে সাহস করে না, সকল বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ভালো ফলাফল করে না; তাদের জন্য দুই ধাপে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাটি খুবই উপযোগী হবে। এতে তাদের রেফার্ড পরীক্ষা দিতে হবে না, এক বছর লস হবে না। অপরদিকে অবশ্যই অধিক শিক্ষা লাভ ও অধিক ভালো ফলাফল করবে সবল শিক্ষার্থীরা। এটি হবে সবল ও দুর্বল উভয় রকম শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির জন্য অধিক সহায়ক। সুতরাং কোভিড থেকে শুরু করে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আলোচিত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত বলে আমি মনে করি।
প্রস্তাবিত এ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে গেলে শুধু প্রথম বছর এসএসসি বা সমমান এবং এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষার্থীদের সাথে নবম ও একাদশ শ্রেণির পরীক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষা নিতে হবে বিধায় মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। তাই এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় ৫ কর্মদিন এবং এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় ৬ কর্মদিন বেশি লাগবে। পরবর্তীতে আর এই সমস্যাটি থাকবে না। অর্থাৎ পরবর্তীতে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৫ বিষয়/পত্র এবং দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৫ বিষয়/পত্র মিলে মোট ১০ বিষয়/পত্রের পরীক্ষা দশ কর্মদিন নিতে হবে। যা এখনো নিতে হয়।
সে ক্ষেত্রে একই কেন্দ্রে একই জনবল দ্বারা প্রথম ৫ কর্মদিন দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা শেষ করে সাথে সাথেই পরবর্তী ৫ কর্মদিন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেয়া যাবে। অনুরূপভাবে দ্বাদশ ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাও নেওয়া সম্ভব হবে। কেবল সদিচ্ছা পোষণ করে সামান্য ত্যাগ স্বীকার করে তা বাস্তবায়ন করা গেলে অবশ্যই অধিক সুফল নিশ্চিত হবে। কারো দয়ায় নয়, নিজের যোগ্যতায় এগিয়ে যাবে শিক্ষার্থীরা। অনেক বৃদ্ধি পাবে নির্বাচনী পরীক্ষায় ও বোর্ড পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা। পরিবর্তিত বাস্তবতায় দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় এই ব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন/ পরিমার্জন করাই উত্তম।
Advertisement
লেখক: অধ্যক্ষ, শিশুসাহিত্যিক ও শিক্ষা গবেষক।
এইচআর/এমএস