জাতীয়

প্রাণিকুলের কথা বিবেচনায় না নিয়েই জাবিতে গাছ কেটে ভবন

প্রাণী-জীববৈচিত্র্যের অন্যতম আধার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২৬টি অবকাঠামো নির্মাণ হচ্ছে। এতে কাটা পড়েছে প্রায় এক হাজার গাছ। আবাসস্থল হারিয়েছে অসংখ্য পাখি ও প্রাণী। সুউচ্চ ভবনগুলোতে ধাক্কা লেগে অনেক পাখি মারাও যাচ্ছে। ‘অপরিকল্পিত’ গাছ কাটার ফলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।

Advertisement

নতুন করে প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় আইএমইডিকে দিয়ে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন তৈরি করে। আইএমইডির পরিচালক সোনিয়া বিনতে তাবিব গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সরেজমিনে পরিদর্শন করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেন। এতে প্রকল্প বাস্তবায়নে নানান ধরনের অসঙ্গতি ধরা পড়ে।

সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ শেষে আইএমইডি জানায়, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রচুর গাছ লাগানো প্রয়োজন হলেও প্রকল্পে বৃক্ষরোপণের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়নি। বহুতল ভবনে ধাক্কা খেয়ে অনেক পাখি প্রাণ হারাচ্ছে। এতে জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে পাখির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ক্যাম্পাসে গুইসাপ, বেজি, শেয়াল, কাঠবিড়ালি ও পরিযায়ী পাখির কথা বিবেচনায় না নিয়েই গাছগুলো কাটা হয়েছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্য

অতিরিক্ত ১৫টি বিভাগে ২ হাজার অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি, একটি ছাত্র হলের চতুর্থ ও পঞ্চম তলা সম্প্রসারণসহ নতুন করে তিনটি ছাত্র হল ও তিনটি ছাত্রী হল নির্মাণ, এক হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন ১০ তলা বিশিষ্ট তিনটি ছাত্র হল ও তিনটি ছাত্রী হল নির্মাণ করা হবে। এতে আবাসনের ব্যবস্থা হবে আরও ৬ হাজার ১৫২ জন ছাত্র-ছাত্রীর। এছাড়া ১০ তলা বিশিষ্ট একটি অত্যাধুনিক প্রশাসনিক ভবন, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের সুব্যবস্থার জন্য পাঁচটি আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ও প্রশাসনিক সমস্যার অনেকাংশেই সমাধান হবে।

Advertisement

কাটা পড়ে ১ হাজার গাছ

২০১৮ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প একবার মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ হয়নি। নতুন করে আবার সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। মেয়েদের তিনটি হলের জন্য ১৭৮টি কাঁঠাল গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ২০৭টি, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবন সম্প্রসারণের জন্য ২০০টি, লাইব্রেরির জন্য দেড় শতাধিক, স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের দক্ষিণে শতাধিক গাছ, অতিথি ভবনের জন্য শতাধিক গাছসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে প্রায় এক হাজারের বেশি গাছ কাটা পড়ে।

সব অবকাঠামোর স্থানে গাছ লাগানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় তো কোনো বনভূমি নয়। প্রথমদিকে জায়গা খালি থাকায় সবখানে গাছ লাগানো হয়েছিল। এখন ভবন নির্মাণের জন্য কিছু জায়গার গাছ তো কাটতে হয়েছে। আমরা আবারও গাছ লাগাচ্ছি।- প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন

আবাসিক ভবনগুলো ফাঁকা থাকার আশঙ্কা

শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের জন্য নির্মিত হচ্ছে পাঁচটি ১১ তলা ভবন। আইএমইডি জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এর আগে নির্মিত কোয়ার্টারগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। অধিকাংশ শিক্ষক, কর্মকর্তা ক্যাম্পাসের বাইরে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রকল্পে নির্মিত ভবনগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মেয়াদ বাড়ানোর যৌক্তিকতা ও আইএমইডির পর্যবেক্ষণ

এক হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে অক্টোবর ২০১৮ থেকে মার্চ ২০২২ নাগাদ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ নাগাদ মেয়াদ বাড়ানো হয়। নভেম্বর, ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ৯৪৪ কোটি ৫২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা, যা মোট ব্যয়ের ৬৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ বাস্তব অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। এই মেয়াদেও প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না। নতুন করে আড়াই বছর অর্থাৎ, ২০২৭ সালের ৩০ জুন নাগাদ মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। মেয়াদ বাড়ানোর যৌক্তিকতা যাচাই করতে গিয়েই পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি ধরা পড়ে আইএমইডির প্রতিবেদনে।

Advertisement

আরও পড়ুন ধ্বংস হচ্ছে জাবি’র জীববৈচিত্র দেশে বন্যপ্রাণী নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্র কম: ড. কামরুল হাসান বিদেশি অনুদান শ্রমিকদের কল্যাণে, ব্যয়প্রস্তাবে তাদেরই অবহেলা পরিবেশবান্ধব হবে রেলপথ, চাপ কমবে সড়কে

প্রকল্পে ২৬টি নির্মাণ ও পূর্ত অঙ্গ রয়েছে, যার মধ্যে সাতটি কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। অবশিষ্ট ১৯টি অঙ্গের মধ্যে বৈদ্যুতিক লাইন সম্প্রসারণ ও ট্রান্সফরমার স্থাপন, পানির লাইন সম্প্রসারণ ও গভীর নলকূপ স্থাপন, ছাত্রীদের জন্য একটি খেলার মাঠ প্রস্তুত, আল-বেরুনী হলের খেলার মাঠের উন্নয়ন কাজ চলমান।

এছাড়া প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ (১০ তলা), হাউজ টিউটরদের বাসভবন নির্মাণ (১০ তলা), প্রভোস্টদের জন্য আবাসিক কমপ্লেক্স নির্মাণ (১০ তলা), শিক্ষকদের জন্য আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ (১১ তলা), অফিসারদের জন্য আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ (১১ তলা), তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ (১১ তলা), চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ (১১ তলা), পরিচ্ছন্নকর্মীদের জন্য আবাসিক টাওয়ার নির্মাণ (১১ তলা), গেস্ট হাউজ কাম পোস্ট গ্রাজুয়েট রিসার্সার হাউজ নির্মাণ (১০ তলা) কাজ চলমান।

জীববিজ্ঞান অনুষদ ভবনের আনুভূমিক সম্প্রসারণ (৬ তলা), সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনের আনুভূমিক সম্প্রসারণ (৬ তলা), কলা ও মানবিক অনুষদ ভবনের আনুভূমিক সম্প্রসারণ (৬ তলা), গাণিতিক ও পদার্থ বিষয়ক অনুষদ ভবনের আনুভূমিক সম্প্রসারণ (৬ তলা), লেকচার থিয়েটার ও পরীক্ষার হল ভবন নির্মাণ (৬ তলা), নতুন একটি লাইব্রেরি ভবন নির্মাণ (৬ তলা), স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণ (৩ তলা নির্মাণ) কাজ চলমান।

প্রকল্প থেকে ১০ তলা ভিতবিশিষ্ট ১০ তলা প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের জন্য ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল, ২০২২ এ কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদার কাজ শুরুর পর ভবনের স্থান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বাধার সম্মুখীন হওয়ায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগস্ট ২০২২ এ পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নির্মাণকাজ স্থগিত রাখার নির্দেশনা দেয়। পরবর্তীসময়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে স্থান পরিবর্তন করে নতুন স্থানে প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্রশাসনিক ভবন নতুনভাবে নির্ধারিত স্থানে নির্মাণকাজের ক্রয়প্রস্তাব মন্ত্রণালয় থেকে এখনো অনুমোদিত হয়নি। দরপত্র প্রক্রিয়া করে নির্মাণকাজসহ প্রকল্পের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করতে প্রকল্পের মেয়াদ আড়াই বছর অর্থাৎ জুন, ২০২৭ পর্যন্ত বাড়ানোর যৌক্তিকতা রয়েছে।

প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামো নির্মাণের ফলে পাখি ও প্রাণিকুলের আবাস ধ্বংস করে ভবন হয়েছে ও গাছপালা কমেছে। সাইট সিলেকশন কীভাবে হয়েছে তার সঙ্গে আমরা ছিলাম না।- জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান

আইএমইডি জানায়, প্রকল্পটি শুরু করতেই এক বছরের বেশি দেরি হয়। প্রথম সভায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ছাড়পত্র পাওয়ার পর অন্য স্থাপনার কাজ শুরুর নির্দেশনা দেওয়া হয়। মার্চ ২০২০ থেকে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে প্রকল্পের নিয়মিত কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়।

কাজ এগিয়ে নিতে কঠোর আএমইডি

প্রকল্পের কারণে সৃষ্ট পরিবেশের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে যাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয় তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করে আইএমইডি। প্রকল্প অনুযায়ী নির্মাণকাজ পরিচালনা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রভোস্ট, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের জন্য যে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলো যাতে অব্যবহৃত না থাকে সে বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। খেলাধুলার পরিবেশ সৃষ্টি করা ও নতুন খেলোয়াড় তৈরিতে নির্মিত স্পোর্টস কমপ্লেক্স যাতে যথাযথ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। ভবিষ্যতে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বাস্তবতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভবন নির্মাণ করা সমীচীন হবে। এতে সময় ও সরকারি অর্থের অপব্যয় হবে না। পরবর্তীসময়ে আর মেয়াদ না বাড়ানোর পক্ষে আইএমইডি।

যা বলছেন আইএমইডি পরিচালক

প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সোনিয়া বিনতে তাবিব জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ চলমান। আমরা ভিজিট করে কাজের অগ্রগতি দেখেছি। প্রকল্পটি শেষ হতে কী পরিমাণ সময় লাগবে এটা দেখেছি।’

পরিবেশের কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। এটা কমিটিকে জিজ্ঞাস করলে তারা ভালো বলতে পারবেন।’

প্রকল্প পরিচালক ও কমিটির সদস্য যা বলছেন

বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের তৈরি অনেক কোয়ার্টার ফাঁকা পড়ে আছে। এর মধ্যে নতুন করে আবার ভবন তৈরি হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকল্পের পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোয়ার্টারগুলো কেন ফাঁকা পড়ে আছে এটা সবাই জানে। এখানে বসবাসের তেমন পরিবেশ নেই। নতুন করে ভবন তৈরি হচ্ছে মানসম্মতভাবে। আশা করছি ভবনগুলো সব সময় পরিপূর্ণ থাকবে।’

অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। পরিবেশের উন্নয়নে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সব অবকাঠামোর স্থানে গাছ লাগানো হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় তো কোনো বনভূমি নয়। প্রথমদিকে জায়গা খালি থাকায় সবখানে গাছ লাগানো হয়েছিল। এখন ভবন নির্মাণের জন্য কিছু জায়গার গাছ তো কাটতে হয়েছে। আমরা আবারও গাছ লাগাচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আড়াই বছর বাড়তি সময় আবদার করেছি। আশা করছি এই সময়ে প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হবে।’

ক্যাম্পাসের প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য বিষয়ে জানতে চাইলে জাবির প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামো নির্মাণের ফলে পাখি ও প্রাণিকুলের আবাস ধ্বংস করে ভবন হয়েছে ও গাছপালা কমেছে। সাইট সিলেকশন কীভাবে হয়েছে তার সঙ্গে আমরা ছিলাম না।’

আইএমইডি প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আইএমইডির রিপোর্ট আমাদের হাতে এখনো পৌঁছেনি। পাখির আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু পাখি মারা যাচ্ছে কি না জানা নেই।’

এমওএস/এএসএ/এএসএম