১ মে-কে অনেক নামেই ডাকা হয়- মে দিবস, শ্রমিক দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস ইত্যাদি। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, প্রকৃত তাৎপর্যটি কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের মর্যাদার একটি স্বীকৃতি লাভ। বিষয়টির ব্যাখ্যার দরকার রয়েছে। এই লেখায় আমরা সেই চেষ্টাই কিছুটা করবো। এমনিতে দিবসটির একটি ইতিহাস রয়েছে। সেটি আগে জেনে নেয়া দরকার।ঊনিশ শতকে শিল্প বিপ্লব ইউরোপ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়ে। শহর বা আশপাশের অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে শিল্প কলকারখানা গড়ে উঠছিল। গ্রাম থেকে কর্মসংস্থানের জন্যে উঠে আসা মানুষরা ঠাঁই নিচ্ছিল বেশির ভাগ ছোট ও মাঝারি কারখানায়- যেখানে মজুরি এবং শ্রম ঘণ্টার কোনো বালাই ছিল না। অদক্ষ শ্রমিকদেরকে কোথাও কোথাও দৈনিক ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কারখানায় কাজ করতে হতো, কিন্তু মজুরি সেই অনুপাতে নির্ধারিত ছিল না। শ্রমিকদের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ ছিল, বিক্ষোভ ধর্মঘটও ডাকা হতো। বেশ কিছু ট্রেড ইউনিয়ন এসব শ্রমিকের মধ্যে গড়ে ওঠে। ছোট বড় এসব শ্রমিক সংগঠন শ্রমঘণ্টা কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে আনার দাবি করতে থাকে। কোথাও মালিক পক্ষ কিছুটা ছাড় দিলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকদেরকে কম মজুরিতে ১৫-১৬ ঘণ্টা কারখানায় কাজ করতে বাধ্য করা হতো।এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে শ্রমিক সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়ে উঠতে থাকে। ১৮৮৬ সালের ৪ মে তারিখ শিকাগো শহরের শ্রমিকরা ধর্মঘট আহ্বান করে। অবশ্য এর আগে থেকে প্রতিদিনই হাজার হাজার শ্রমিক ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে মিছিল করেছিল। ওই দিন শিকাগো শহরের শ্রমিকগণ মিছিল সহকারে বিভিন্ন রাস্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গা প্রদক্ষিণ করে। তদের মূল দাবি ছিল শ্রমঘণ্টা ৮ ঘণ্টা বাস্তবায়ন করা, শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা। এই দাবি নিয়ে শ্রমিকদের একটি মিছিল শিকাগো শহরের হে মার্কেটে মিলিত হয়, সেখানে নেতৃবৃন্দ বক্তৃতাও করেন, সকলে যখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনেছিলেন তখন আকস্মিকভাবে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি পুলিশকে লক্ষ করে একটি বোমা নিক্ষেপ করে। তাতে কয়েকজন পুলিশও আহত হয়। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুলিশও মিছিলকারী সমবেত শ্রমিকদের ওপর গুলি ছোঁড়ে। এতে চারজন শ্রমিক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাদের রক্তে রাস্তা রঞ্জিত হয়ে পড়ে। ৪ জনই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।এমন মৃত্যুর জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। সবাই একদিকে হত বিহ্বল হয়ে পড়েন, অন্যদিকে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ১৮৮০-এর দশকের শুরুতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য শ্রমজীবী মানুষের নামে একটি দিবস চালু করার দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। ৪ মে শিকাগোতে শ্রমিক হত্যার ঘটনাটিকে স্মরণীয় করতে সেই দাবিটি সম্মুখে চলে আসে, মে মাসে তা পালনের কথাও নতুনভাবে উত্থাপিত হতে থাকে। বিশেষ করে নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল লেবার ইউনিয়ন এ দাবিটি জোরদার করে। ১৮৮৭ সালে কোনো কোনো শহরে মে দিবসকে স্মরণীয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের প্যারিস সম্মেলনে (১৮৮৯) শিকাগো দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়। ১৮৯০ সালে ইউরোপে দ্বিতীয় ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে প্রথম মে দিবস পালিত হয়, মে দিবসের স্বীকৃতি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হতে থাকে। এটি প্রতি বছর পালনের রেওয়াজ ক্রমেই শুরু হয়। ১৯০৪ সালে আমর্স্টাডমে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সোশ্যালিস্ট কনফারেন্সে সকল দেশের সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দলকে মে দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়, সম্মেলনে ৮ ঘণ্টার শ্রম দিবস ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সোশ্যালিস্টগণ ১ মে কাজ বন্ধ রেখে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস প্রতিষ্ঠার দাবি জানাতে থাকেন। সেখান থেকেই মে শ্রমিক দিবস রূপে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে। এটি কোনো কোনো দেশে সরকারি ছুটি লাভ করে।সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে, এই দিনে ওইসব দেশে শ্রমজীবী মানুষ শহরের কেন্দ্রীয় চত্বরে নানা রঙের পোশাক পরে প্যারেড করতেন, পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সরকারি ছুটি না থাকলেও দিবসটি সেখানেও কম বেশি পালিত হয়। বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১ মে প্রথম সরকারি ছুটি হিসেবে মে দিবস পালিত হয়। সে থেকে দিবসটিতে সরকারি ছুটি থাকে, বিভিন্ন সংগঠন এ উপলক্ষ্যে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। তবে যেটি মনে রাখতে হবে, তা হচ্ছে, ১৮৮৬ সালের হে মার্কেটে শ্রমিকদের রক্ত থেকে যে মে দিবসের জন্ম হয়েছে, সেটি শুধু শ্রমিকদেরই একটি দিবস রূপে থাকেনি, এটি হয়ে উঠেছে পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের মর্যাদারও স্বীকৃতির দিবসে। ওই সময় যদিও ৮ ঘণ্টার শ্রম দিবসের দাবি মানা হয়নি, কিন্তু কালক্রমে সভ্য দুনিয়ায় স্বীকার করা হয়েছে যে, যে কোনো মানুষের দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টাই স্বাস্থ্যসম্মত, সেটিই সর্বত্র স্বীকৃত হয়েছে। এখন পৃথিবীর সর্বত্র ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবসের বিষয়টি মেনে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মানুষ সভ্যতার একটি স্বাভাবিক নিয়মকে গ্রহণও করেছে। শুধু কল-কারখানায় নয়, অফিস-আদালতেও ৮ ঘণ্টার শ্রম সময় সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে শ্রমের মর্যাদাও লাভ করেছে। সুতরাং, ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের সঙ্গে মানুষের শ্রমের মূল্য এবং মর্যাদাকেও গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করার শিক্ষা নিতে হবে, দিতে হবে।এক সময় মানুষ শ্রমের এই প্রয়োজনীয় দিকটি সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না, মানতো না। শ্রমিকরা তাদের অতিরিক্ত কষ্টের কারণে এর প্রতিবাদ করেছে, তার জন্যে তাদের রক্ত দিতে হয়েছে, অবশেষে সভ্য দুনিয়া উপলব্ধি করতে পেরেছে ৮ ঘণ্টার শ্রম দিবস শুধু শ্রমিকদেরই নয়, কর্মজীবী সকলেরই প্রয়োজন। এভাবেই মানুষ সভ্যতার শিখরে উঠতে শিখেছে। আমাদের চারপাশে এখনও যারা অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে বাধ্য হচ্ছেন, মজুরি কম পাচ্ছেন তাদেরকেও এই শ্রমঘণ্টা ও মর্যাদায় আনতে হবে, তবেই দিবসটির তাৎপর্য অর্থবহ হবে। এইচআর/এমএস
Advertisement