একুশে বইমেলা

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বইমেলা

•ছিল না একুশের আমেজ•মাসজুড়ে ‘বিতর্কিত’ বই নিয়ে সমালোচনা •নিষ্প্রাণ ছিল লিটল ম্যাগাজিন ও বাংলা একাডেমি চত্বর•নীতিমালা ভঙ্গে শোকজ দিয়ে দায় সারা•মেলায় পাঠক-ক্রেতা টেনেছে মেট্রোরেল

Advertisement

অমর একুশে বইমেলা-২০২৪ শেষ, ফের অপেক্ষা নতুন বছরের। করোনা সংকট পুরোপুরি কাটিয়ে এবার শুরু থেকেই জাঁকজমক ছিল বইমেলা প্রাঙ্গণ। মেট্রোরেলের সুবিধার কারণে পাঠক-দর্শনার্থীর পদচারণা যে কোনো সময়ের তুলনায় ছিল চোখে পড়ার মতো। সাধারণত ২৮ দিনে শেষ হওয়া মেলা এবার চলেছে ৩১ দিন। বিক্রি হয়েছে ৬০ কোটি টাকার বই। শুরুতে কিছু বই ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশৃঙ্খলা থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রাণ ছিল মেলায়।

উপেক্ষিত একুশ

একুশের চেতনা ধারণ করে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বইমেলা। কিন্তু এবার অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল ভাষা আন্দোলন ও একুশের স্মৃতিবহ আবহ। লেখক-পাঠকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সময় বইমেলার তথ্যকেন্দ্র থেকে মাইকে নিয়মিত বাজানো হতো একুশের বিভিন্ন গান। এবছর শুধু একুশে ফেব্রুয়ারির দিন তথ্যকেন্দ্র থেকে গান শোনা গেছে।

Advertisement

এছাড়া আগে বিভিন্ন সময় মেলার মূল প্রবেশদ্বারের সামনে, ভিতরের চত্বরে ভাষাশহীদদের ছবি সম্বলিত ফেস্টুন-ব্যানার দেখা যেত। এবার মেলার প্রবেশদ্বার থেকে শুরু করে তথ্যকেন্দ্র, মোড়ক উন্মোচন, লেখক বলছি মঞ্চসহ কোথাও ভাষাশহীদদের স্মৃতি সম্বলিত কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। দর্শনার্থীরা বলছেন, মেলা প্রাঙ্গণের বিভিন্ন চত্বরের নামকরণ করা হতো ভাষাশহীদদের নামে। সেটিও এবার দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী জোনায়েদ খান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির যে ইতিহাস, যে চেতনা ধারণ করে বইমেলা, সেখানে একুশের কোনো আমেজ বা একুশের স্মৃতি স্মরণ করার কোনো কার্যক্রম দেখিনি। অন্তত ভাষাশহীদদের ছবি তাদের পরিচিতি সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুনে দেওয়া যেত। নতুন প্রজন্ম অন্তত তাদের সম্পর্কে জানতে পারতো ও মেলার সঙ্গে একুশের সম্পর্ক বুঝতে পারতো।

মেলাজুড়ে ভোগান্তি

মেলার প্রথম সপ্তাহে মসজিদ, শৌচাগার ও খাবারের হোটেল রেডি হয়নি। প্রথম চারদিন মেলায় ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য ছিল না ডাস্টবিন। খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হয় দর্শনার্থী ও বিক্রয়কর্মীদের। উদ্যানের লেকের পাশে যত্রতত্র পড়ে থাকতে দেখা যায় খাবারের উচ্ছিষ্ট। বিভিন্ন স্টলের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল নির্মাণসামগ্রী। এছাড়া প্রচুর ধুলাবালির অভিযোগ জানিয়েছেন দর্শনার্থীরা। প্রথম কয়েকদিন বেশি ভুগিয়েছে শৌচাগার ও খাবারের দোকান না থাকা।

Advertisement

 

যারা প্রকৃত প্রকাশক তাদেরই বইমেলায় স্থান পাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এখন স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে স্টল সংখ্যা বাড়ছে, বইয়ের মান বাড়ছে না। আমি মনে করি একাডেমি যাচাই-বাছাই করে সর্বোচ্চ ২৫০টির বেশি প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া ঠিক হবে না। নামমাত্র প্রকাশক যদি বেড়ে যায় তাহলে বইমেলার সার্বিক ভাবগাম্ভীর্যতা বিনষ্ট হয়। এ বিষয়গুলোতে আরও তদারকির প্রয়োজন।- প্রকাশক ওসমান গণি

 

খন্দকার মুশতাক ও ডা. সাবরিনার বই ঘিরে নাটকীয়তা

এবার মেলার শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল খন্দকার মুশতাকের বই ‘তিশার ভালোবাসা’ ও ডা. সাবরিনার ‘বন্দিনী’। মুশতাক-তিশা স্টলে গেলেই জমে যেত ভিড়। এর মধ্যে এক শ্রেণির পাঠক-দর্শনার্থী অসময় বয়সী আলোচিত এই জুটিকে মেলা থেকে বের হয়ে যেত বাধ্য করে। পুলিশ ও আনসার সদস্যের প্রহরায় তারা মেলা ছাড়েন। এ ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে সরব হয়ে ওঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

আরও পড়ুন•তাড়া খেয়ে বইমেলা ছাড়লেন মুশতাক-তিশা দম্পতি•বইমেলা ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ‘নতুন চ্যালেঞ্জ’ মেট্রোরেল•বইমেলা জমজমাট, ভিড় নেই লিটল ম্যাগ চত্বরে

এছাড়া করোনাকালে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের দায়ে জেলবন্দি ডা. সাবরিনার জীবনের নানান ঘটনা নিয়ে আহমেদ পাবলিশিং হাউজ প্রকাশ করে ‘বন্দিনী’ বইটি। আলোচনায় আসে বইয়ের ভিতরের কন্টেন্ট। মেলায় গিয়ে নারীদের জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

মুশতাক-তিশার বই নিতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হন লেখক মাসউদ আহমাদ। তিনি বাংলা একাডেমি মহাপরিচালক বরাবর একটি অভিযোগপত্রও দেন। সেখানে তিনি বলেন, আলোচিত এই বই নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে দেখে বই সম্পর্কে জানার জন্য বইটি কিনতে যাই। মিজান পাবলিশার্সে তিশা-মুশতাকের আলোচিত বইটি চাইলে আমাকে দেখাতে রাজি হন না। বিক্রয়কর্মীরা আগে টাকা নিয়ে পরে ব্যাগে ভরে বই দেবেন- এই চুক্তিতে বই কিনি। এরপরেও তারা টাকা নিয়ে অন্য একটি বই আমাকে ধরিয়ে দেয়। এ নিয়ে বিক্রয়কর্মীরা আমাকে হেনস্তা করে।

মেলায় প্রকাশ হওয়া বইয়ের মান, বই নিয়ে ওঠা ‘বিতর্ক’র বিষয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘যেসব বই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সেখানে টাস্কফোর্স পাঠিয়েছি। এর আগে আমি জানতে চাই সারা বছর প্রকাশকরা কী করেন? বাকি ১১ মাস বইগুলো কারা নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা কীভাবে এসব বই ছাপান। মেলায় হাজার হাজার বই আসে। এসব বইয়ের ভিতরে কী লেখা আছে সেটার দায়িত্ব তো মেলা কমিটির নয়।’

নিষ্প্রাণ লিটল ম্যাগাজিন চত্বর

তরুণ লেখক তৈরির আঁতুড়ঘর লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজ। বরাবরের মতো এবারও নিষ্প্রভ ছিল লিটল ম্যাগাজিন চত্বর। মাসজুড়ে ছিল না প্রাণের ছোঁয়া। ছুটির দিনেও ক্রেতা সমাগম ছিল না এ চত্বরে। বিক্রেতারা পার করেছেন অলস সময়। সন্ধ্যার পর এখানকার স্টলকর্মীরা কয়েকজন মিলে আড্ডা দিয়েই কাটিয়েছেন সময়।

নোঙর-এর প্রকাশক সুমন শামস বলেন, প্রতিবছর লিটল ম্যাগাজিন চত্বর একাডেমির অবহেলায় থাকে। মেলার এখানকার দৃশ্যপট পুরাই ভিন্ন ছিল। পর্যাপ্ত লাইট না থাকায় আলোর অভাব ছিল। প্রকৃত পাঠকরা দু-একবার ঢুঁ মারলেও মাসজুড়ে তেমন বেচাকেনা হয়নি।’

নীতিমালা লঙ্ঘন করে বই বিক্রি

নোটবই থেকে শুরু করে ইংরেজি শব্দের অভিধান, ইংরেজি ব্যাকরণ কিংবা ক্যামব্রিজের আইইএলটিএসের বই ও পাইরেটেড বইয়ের ছড়াছড়ি ছিল মেলায়। নীতিমালার শর্ত পূরণ না করে মেলায় ছিল অনেক স্টল। অনুমতিবিহীন অনুবাদ বই, একই আইএসবিএন ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক বইয়ে। টাস্কফোর্স টিম অনেক বই জব্দ করে এবং প্রকাশনীকে সতর্ক করে।

এসব নিয়মনীতি ভঙ্গের অভিযোগে ১৯ প্রকাশনীকে শোকজ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি মেলা কর্তৃপক্ষ।

যা বলছেন প্রকাশকরা

দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতার পরেও বাংলা একাডেমির এমন ত্রুটি মানতে নারাজ প্রকাশকরা। তাদের দাবি, মেলার জন্য একাডেমি আলাদা বিভাগ খুলুক, যাতে তারা বছরব্যাপী গবেষণা করে পরিকল্পনা করতে পারে কীভাবে মেলা আরও সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করা যায়।

পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব একাডেমি নেওয়াটা মোটেও ভালো হয়নি। বাংলা একাডেমি প্র্যাকটিস করছে, কিন্তু বইমেলা তো পরীক্ষা করার জায়গা নয়। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট থাকলে ইট বিছানো থাকতো, ধুলাবালি উড়তো না, একাডেমি মেলার শুরু থেকে লেখক মঞ্চ নির্মাণ করতে পারেনি। ভাষাশহীদদের নামে চত্বর নেই, একুশের আমেজ নিয়ে ভিন্ন চিন্তা তাদের মাথায় নেই। তবে বাংলা একাডেমি চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের লোকবল সংকট। মেলায় অব্যবস্থাপনা ছিল, তারপরেও আমি বলবো মেলা ভালো হয়েছে।’

মিজান পাবলিশার্সের প্রকাশক মিজানুর রহমান পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘খন্দকার মুশতাকের বই ৯ ফেব্রুয়ারি ঝামেলার পরই মেলায় বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। তার গত বছরের বই মেলায় ভালো চলছে, তাহলে আমি তার বই প্রকাশ করবো না কেন। ওই বই তাদের প্রেমের কাহিনি নিয়ে লেখা। এতে সমস্যা কোথায়। ওই বই তো অনলাইনে চলছে। তাদের নিয়ে সমালোচনা ধর্মান্ধ মানুষের চক্রাক্ত।’

 

এবার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ছিল না। প্রথম থেকে এত কাজ আমরা পারবো কি পারবো না একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আমাদের জনবল ৪৫৭ জন, কিন্তু সেখানে আছি মাত্র ২৪০ জন। তারপরও যেসব জিনিস আমরা এজেন্ডায় নিয়েছিলাম বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। প্রথম তিনদিন দর্শনার্থীদের ভোগান্তি ছিল এটা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু এরপর থেকে আর কোনো সমস্যা হয়নি।- মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম

 

আগামী প্রকাশনীর প্রকাশক ওসমান গণি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবারের মেলায় বিক্রি বেশি হলেও সার্বিক ব্যবস্থাপনা আরও সমৃদ্ধ হতে পারতো। মেলার জন্য একাডেমির আলাদা বিভাগ থাকা উচিত, যাতে বছরজুড়ে পরিকল্পনা করা যায়। আমি মনে করি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট থেকে বাংলা একাডেমির হাতে আসার কারণে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার জায়গা নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন পাইরেটেটেড বইয়ের ছড়াছড়ি ছিল এবারের বইমেলায়। একই বই বিভিন্ন প্রকাশনীতে ছিল।’

সিজনাল প্রকাশকদের মেলায় স্থান দেওয়া উচিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, যারা প্রকৃত প্রকাশক তাদেরই বইমেলায় স্থান পাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু এখন স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে স্টল সংখ্যা বাড়ছে, বইয়ের মান বাড়ছে না। আমি মনে করি একাডেমি যাচাই-বাছাই করে সর্বোচ্চ ২৫০টির বেশি প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ দেওয়া ঠিক হবে না। নামমাত্র প্রকাশক যদি বেড়ে যায় তাহলে বইমেলার সার্বিক ভাবগাম্ভীর্যতা বিনষ্ট হয়। এ বিষয়গুলোতে আরও তদারকির প্রয়োজন।’

সার্বিক বিষয়ে মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ছিল না। প্রথম থেকে এত কাজ আমরা পারবো কি পারবো না একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। আমাদের জনবল ৪৫৭ জন, কিন্তু সেখানে আছি আমরা মাত্র ২৪০ জন। তারপরও যেসব জিনিস আমরা এজেন্ডায় নিয়েছিলাম বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। প্রথম তিনদিন দর্শনার্থীদের ভোগান্তি ছিল এটা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু এরপর থেকে আর কোনো সমস্যা হয়নি।’

মেলায় নিয়ম-নীতি ভঙ্গের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়ম-নীতি ভঙ্গের অভিযোগে মাসব্যাপী আমাদের টাস্কফোর্স টিম তদন্ত করেছে। আমরা শোকজও করেছি। মেলা পরিচালনা কমিটি প্রায় ৩২ সদস্যবিশিষ্ট। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে বাংলা একাডেমিসহ বসে নিতে হবে। ১৯টি প্রকাশনীকে সতর্ক করা হয়েছে। আর মেলার পরে তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।’

মেলায় একুশের আমেজ নেই কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আজ থেকে ৮-৯ বছর আগে গান চলতো। এরপর অভিযোগ আসে বেচাকেনা করতে সমস্যা হয়, পাশেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সেমিনার করতে সমস্যা হয়। যারা লাইভ দেয় তারা দু-তিন মিনিটের জন্য গান বন্ধ করতে বলেন। পরবর্তীসময়ে এটা বন্ধ হয়ে যায়। গতবার ভাষাশহীদদের নামে চারটি চত্বর ভাগ ছিল। এবার প্রকাশকদের অনুরোধে মেলার সব স্টল এক জায়গায় করতে গিয়ে এ প্রসঙ্গটা মাথায় আসেনি। তবে এটা ভালো প্রস্তাব। পরবর্তীসময়ে এসব বিষয়ে খেয়াল রাখবো।

আরএএস/এএসএ/জিকেএস