চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করার নির্দেশনা চেয়ে দায়ের করা রিটের বিষয়ে শুনানি শেষ হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর আদেশের জন্য আাগমী ২৩ জুলাই দিন ঠিক করেছেন হাইকোর্ট।
Advertisement
বুধবার (৯ জুলাই) হাইকোর্টের বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি শেখ তাহসিন আলীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আদেশের এই দিন ঠিক করেন। রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন ও অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম এবং আইনজীবী কায়সার কামাল শুনানি করেন। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার আনোয়ার হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মহাদ্দেস-উল-ইসলাম ও মাহফুজ বিন ইউসুফ।
শুনানিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, নতুন কর্তৃপক্ষ নিয়োগ না দেওয়া পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ছয় মাসের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে- একনেকের সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরপর সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দিয়ে দেবে। এ প্রক্রিয়া চলমান। সরকার তার অবস্থান থেকে নড়েনি।
আহসানুল করিম বলেন, ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া আইনবিরোধী। জিটুজির ভিত্তিতে প্রকল্পের কাজ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করতে হয়। অথচ পিপিপি কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে প্রজেক্ট প্রোফাইলে অনুমিত বিনিয়োগ হিসেবে ২০০ কোটি টাকা দেখা যায়, যা জিটুজি গাইডলাইনের সংশ্লিষ্ট বিধিরও পরিপন্থি।
Advertisement
বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এই টার্মিনালে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার বা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে বলে শুনানিতে উল্লেখ করেন আহসানুল করিম। তিনি বলেন, পরামর্শক ফি হিসেবে আইএফসিকে গত ১৪ মে এক লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধ করে পিপিপি কর্তৃপক্ষ।
আইনজীবী কায়সার কামাল বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের হার্ট (হৃৎপিণ্ড)। ওখানে (হৃৎপিণ্ডে) রক্তক্ষরণ হলে কিন্তু মানুষটাকে বাঁচানো যায় না। অর্থ উপদেষ্টা কী বলেছেন? বিদেশিদের হাতে যাওয়ার আগে ছয় মাস নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলবে এনসিটি। অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। ১ জুলাই বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা এ কথা জানান। দরপত্র ডাকা হবে না বলা হয়েছে।
কায়সার কামাল আরও বলেন, রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছে জনগণ। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি এসে সিদ্ধান্ত নেবে কোনটা নীতিগত সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত, কোনটা হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থ এখানে জড়িত। রুল দেওয়ার আরজি জানান তিনি।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, টার্মিনাল বাংলাদেশের শ্রমিকরা পরিচালনা করার জন্য সক্ষম। সেখানে কী কারণে, কী উদ্দেশ্যে (বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে) দিয়ে দেওয়া হবে? এখানে জনস্বার্থ রয়েছে। ১২ দলীয় জোট আছে, তারাও কিন্তু এর বিরুদ্ধে। তারা বলেছে, টার্মিনাল দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতেই থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় স্বার্থ বড় করে দেখতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি পরিচালনার ক্ষমতা এ দেশেরই আছে। রুল দেওয়ার আরজি জানান তিনি।
Advertisement
তিনি জাতীয় স্বার্থে এসেছেন এবং শুধু রুল চাচ্ছেন বলে এ সময় জানান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মহাদ্দেস-উল-ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেনি সরকার। ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেবে- এমন সিদ্ধান্ত হয়নি। কী সিদ্ধান্ত হবে, ‘টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন (চুক্তির শর্ত)’ কী হবে, আদৌ অন্য কাউকে দেবে কি না- সিদ্ধান্ত হয়নি। ভবিষ্যতে কী হবে, তার ওপর ভিত্তি করে রুল হতে পারে না। শুনানি শেষে উচ্চ আদালত আদেশের জন্য ২৩ জুলাই দিন ঠিক করেন।
এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার ক্ষেত্রে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বানের নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই রিট আবেদন করেন।
রিটে দেশীয় অপারেটরদের অনুমতি না দিয়ে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) আইন ও নীতি লঙ্ঘন করে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না- এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়েছে।
যে কোনো অপারেটরকে এনসিটি পরিচালনার জন্য দায়িত্ব (নিযুক্ত) দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতি অনুসারে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক পাবলিক বিডিং (দরপত্র আহ্বান) নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- সে বিষয়েও রুল চাওয়া হয়েছে। রিটে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে।
নিউমুরিং টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের পক্ষে সংগঠনের সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন ওই রিটটি করেন। ‘নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে’ শিরোনামে গত ২৬ এপ্রিল সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও এ সংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে রিট আবেদন করা হয়েছে।
রিট আবেদনকারী পক্ষের আইনজীবী জানান, ২০১৯ সালে সমঝোতা স্মারকের মধ্য দিয়ে প্রক্রিয়া শুরু হয়। টার্মিনাল অপারেটর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দায়িত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। জিটুজির ভিত্তিতে প্রকল্পের কাজ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করতে হয়। অথচ পিপিপি কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রজেক্ট প্রোফাইলে অনুমিত বিনিয়োগ হিসেবে ২০০ কোটি টাকা দেখা যায়, যা জিটুজি গাইডলাইন-২০১৭ সংশ্লিষ্ট বিধির পরিপন্থি।
এফএইচ/এএমএ