ফিচার

লোডশেডিং রোধে নাগরিকের করণীয়

দেশে সম্প্রতি লোডশেডিংয়ের আকার খানিকটা বড় হয়েছে। প্রচণ্ড তাপদাহে পরিস্থিতি অনেকটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আমরা জানি, বিদ্যুৎ একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সঞ্চালক ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট পিছিয়ে। তবে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিদ্যুতের সমস্যা অনেকটাই সমাধান হওয়ার পথে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অন্য অনেক দেশের মতো বিদ্যুৎ-সংকটে পড়েছে বাংলাদেশও। সরকার চেষ্টা করছে দ্রুত এ সমস্যা সমাধান করতে। বিশেষ করে কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে। সুতরাং উৎপাদন স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে।

Advertisement

মনে রাখতে হবে, বিদ্যুৎ স্টোর করে রাখার মতো কোনো ভোগ্যপণ্য নয়। এটি একটি চলমান ব্যবস্থা। চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন করতে হয়। কাজেই উৎপাদন কম হলে লোডশেডিং অপরিহার্য। আপনি যখন অপ্রয়োজনে একটি বাতি, ফ্যান বা এসি চালিয়ে রাখবেন; তখন আপনাকে মনে রাখতে হবে এ বিলাসিতার জন্য অন্য একজনকে অন্ধকারে থাকতে হচ্ছে। গরমে হাঁসফাঁস করতে হচ্ছে। সুতরাং বিদ্যুৎ ব্যবহারে আমাদের বিলাসিতাও বর্তমান সংকটের একটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। এ ক্ষেত্রে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের উক্তিটি মনে করতে হয়, ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি’।

দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা দায়িত্ব বা সচেতনতা নিয়ে সব সময় উদাসীন। কোনো সংকট এলে আমরা সরকারের প্রতি সব দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে মুক্ত রাখতে ব্যস্ত থাকি। নাগরিক হিসেবে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকার যেমন আছে; তেমনই নাগরিক দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতাও দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের স্বীকার করতে হবে। বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা। তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং লোডশেডিং বৃদ্ধি উভয়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়লে লোডশেডিং সমস্যা সমাধান হবে কিন্তু তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি এবং এর প্রভাবও দীর্ঘমেয়াদি। সুতরাং এটি সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আরও পড়ুন: পরীক্ষায় পাস করতে গাছ লাগাতে হয় যে দেশে

Advertisement

বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের পাশাপাশি নদী দখল ও বৃক্ষ নিধন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের নদীব্যবস্থার ওপর প্রথম খড়গ চলে ব্রিটিশ আমলের ভুল নদী ব্যবস্থাপনায়। এরপর ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের নামে ক্ষতিকর বাঁধ, আশির দশকে বিশ্বব্যাংকের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদীগুলোর ভালোর বদলে ক্ষতিই করেছে বেশি। গত দুই দশকে শিল্পকারখানা ও বাণিজ্যের প্রসারের জন্য নদীর দখল ও দূষণ ঘটেছে ব্যাপক হারে। নদীতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, দূষণমুক্ত রাখা এবং দখল রোধে জড়িত আছে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। নদীর অবৈধ দখল ও পরিবেশ দূষণ ঠেকাতে আরও আছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। তবুও রক্ষা পাচ্ছে না নদীর দখল ও দূষণ। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত আমরা ময়লা-আবর্জনা সব নদীতে ফেলছি। শিল্পকারখানার বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। উজান থেকে নেমে আসা পলি এসে পড়ছে নদীতে। ময়লা-আবর্জনার কারণে একদিকে যেমন জলজ প্রাণী হুমকিতে পড়ছে, অন্যদিকে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

এছাড়া দেশে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। গাছ পরিবেশের অতিরিক্ত তাপমাত্রা শোষণ করে পরিবেশকে নির্মল রাখে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে প্রাণীর বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নির্গমন করে। কিন্তু জনসংখ্যার চাপে দিন দিন গাছ নিধন হচ্ছে। এর কারণে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে; আবহাওয়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গাছ নিধনের কারণে বৃষ্টিও হচ্ছে না। বৃষ্টির অভাবে আমাদের নিত্যজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে গাছ নিধনের ফলে পরিবেশ ভারসাম্য হারাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। বাস্তুসংস্থান ভেঙে পড়ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে কোনো দেশের ২৫% ভূমিতে বন-জঙ্গল থাকা দরকার। সেই তুলনায় বাংলাদেশে গাছ নিধনের কারণে পর্যাপ্ত বনভূমি নেই। গত বছর জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের সাড়ে ১৩ শতাংশ বনভূমি। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এ তথ্য মানতে নারাজ। মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি আছে। তবে এ পরিসংখ্যানও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

বর্তমান জলবায়ুর এ পরিবর্তনকে আমরা ‘মানবসৃষ্ট’ বলি। কারণ অতীতের জলবায়ুর পরিবর্তনগুলো ছিল প্রাকৃতিক। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আমাদের সুন্দর এ ধরিত্রী অদূর ভবিষ্যতে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। কারণ ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার বৃদ্ধি বায়ুমণ্ডলের উচ্চ ও নিম্নস্তরে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। তাই আর্দ্র অঞ্চল আর্দ্রতর ও শুষ্ক অঞ্চল শুষ্কতর হবে। ফলে মানুষের জীবনধারণ বা টিকে থাকাই হয়ে উঠবে কঠিন।

আরও পড়ুন: বাড়ছে পরিবেশ দূষণ কমছে সচেতনতা

Advertisement

গবেষণায় দেখা যায়, দেশের উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ অঞ্চলগুলোয় তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা ব্যাপক, যা খুবই উদ্বেগের। গত ৫০ বছরে (১৯৬৮-২০১৮) দেশে দিন ও রাতে উষ্ণতার হার বেড়েছে। একইভাবে দিন ও রাতের শীতলতা ভীষণ হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ গত পাঁচ দশকে উষ্ণ দিনের সংখ্যা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোয় প্রতিবছরে গড়ে শূন্য দশমিক ৩৯৪ দিন এবং দেশের অভ্যন্তরভাগে শূন্য দশমিক ১৫ দিন করে বেড়েছে। এ ছাড়া উষ্ণ দিনের সময় উপকূলীয় অঞ্চলে শূন্য দশমিক ৫০৭ দিন করে প্রতিবছর বাড়ছে। তাপমাত্রার তুলনায় বৃষ্টিপাতের সূচকগুলো অপেক্ষাকৃতভাবে কম পরিবর্তিত হয়েছে। গত ৫০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে গভীরভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি মোতাবেক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা রাখার ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। তবু গবেষণা বলছে, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা আরও নিচে রাখা না গেলে আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের (যেমন- তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বাতাসের গতি) অনিয়মিতকরণ ও অস্বাভাবিকতার কারণে বাংলাদেশকে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। জনসংখ্যার ঘনত্ব ও দারিদ্র্যের কারণে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তন ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে। সক্ষমতার অভাব অবস্থাকে করবে ভীষণ নাজুক।

পরিশেষে বলতে চাই, নাগরিক হিসেবে পরিবেশ সুন্দর ও সহনীয় রাখতে আমাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক বনায়ন কিংবা ব্যক্তি উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। পরিবেশ দূষণ রোধ ও নদীর প্রতি সদাচরণ করতে হবে। এটি নাগরিক দায়িত্বের অংশ। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার পরিবেশ সুন্দর রাখতে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বসবাস উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে আমাদের কাজ করতে হবে। আশা করি সরকারের আন্তরিকতায় লোডশেডিং সমস্যা দ্রুত সমাধান হবে। তবে দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু সমস্যা সমাধান কতটা দীর্ঘ হবে, এটি নির্ভর করছে আমাদের কর্মের ওপর। সুতরাং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নাগরিক দায়িত্ব পালন ও জনসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।

লেখক: কথাশিল্পী ও কলামিস্ট।

এসইউ/জেআইএম