ফিচার

বঙ্গবন্ধুর ৮ জন্মদিন কেটেছে কারাগারে

আজ শুক্রবার, ১৭ মার্চ। বাঙালির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনে (মঙ্গলবার) এই বাংলায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি মহামানব। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশকে স্বাধীন করার। শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে যাননি, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার সাহসও দেখিয়েছেন। আজ বাঙালি জাতির আনন্দের দিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। বাংলাদেশের খুশির দিন।

Advertisement

বঙ্গবন্ধু যখন বেঁচে ছিলেন তখন জন্মদিন পালন করেছেন শিশুদের নিয়ে। শিশুদের সঙ্গে গল্প করতেন। খেলা খেলতেন। তিনি শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। আদর, স্নেহ করতেন। শিশুদের নিয়ে তার ছিল অনেক স্বপ্ন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আগামীতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দেবে শিশুরা। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর ৮টি জন্মদিন কেটেছে কারাগারে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে নানান প্রহসনমূলক মামলায় বিনা বিচারে ১৩ বছর ৯ মাস বঙ্গবন্ধুকে কারাবরণ করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে তার ৩১তম জন্মদিন কারাগারে কাটান। পাকিস্তান সরকার তাকে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি বন্দি করে। টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে কাটিয়ে তিনি মুক্তি পান ১৯৫২ সালে। ওই একই দফায় বন্দিদশায় ১৯৫১ সালে তার ৩২তম জন্মদিনও কাটে জেলে। এরপর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে টানা ১১৫৩ দিন বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে কাটাতে হয়। গ্রেফতারের ১৪ মাসের মাথায় তিনি মুক্তি পেলেও সেদিনই কারা ফটকে আবারও গ্রেফতার হন। এ সময় তার ৪০তম (১৯৫৯ সাল), ৪১তম (১৯৬০) ও ৪২তম (১৯৬১) জন্মদিন কাটে জেলখানায়। ওই দফায় ১৯৬১ সালের শেষ দিকে মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি ফের গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পান একই বছরের ১৮ জুন। এ কারণে ৪৩তম (১৯৬২) জন্মদিনও তাকে জেলে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬৭ সালে ৪৮তম এবং ১৯৬৮ সালে ৪৯তম জন্মদিনও জেলখানায় কাটে বঙ্গবন্ধুর।

বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের ডায়েরি নিয়ে ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ে জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর একটি জন্মদিন কাটানোর বিবরণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর মুক্ত জীবনের জন্মদিনগুলো ঘটা করে পালন করা না হলেও ১৯৬৭ সালের জন্মদিনটা কিছুটা আওয়াজ দিয়েই পালন করা হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ তার ৪৮তম জন্মদিনটা কেমন কেটেছিল বা জন্মদিনে তার দল আওয়ামী লীগ কী কর্মসূচি পালন করেছিল? জাতির পিতা তা অকপটে তুলে ধরেন ডায়েরির পাতায়। তিনি লেখেন, জন্মবার্ষিকী তিনি কোনো দিনই নিজে পালন করেননি। বেশি হলে তার স্ত্রী ওই দিনটাতে তাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকতেন। বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করতেন জন্মদিনের দিনটিতে বাড়িতে থাকতে। ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালন করেছে বলে খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন বলে ডায়েরিতে উল্লেখ করেন তিনি। ওইদিন জেলখানায় আটক তার দলের নেতারা জন্মদিন উপলক্ষে তাকে গোলাপ, ডালিয়াসহ নানান ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বলেও উল্লেখ করেন। এছাড়া বিকেলে স্ত্রী ও সন্তানেরা ফুলের মালা ও অন্য একজনের (বদরুন) পাঠানো কেক নিয়ে আসেন। এছাড়া ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর জন্য একটা বিরাট কেক ওইদিন পাঠিয়েছিল বলে ডায়েরিতে উল্লেখ করেন। বঙ্গবন্ধুর মতে, ‘জেলে থাকার কারণেই ওই বছর এমনটি হয়েছিল।’ দল জন্মদিন পালন করেছে দেখে তিনি হেসেছিলেন বলেও ডায়েরিতে উল্লেখ করেন। জন্মদিন পালনের বিষয়টিকে তিনি ডায়েরিতে উল্লেখ করেন এভাবে, ‘আমি একজন মানুষ, আমার আবার জন্মদিবস!’

Advertisement

এমন সহজ সরল, সোজা-সাপ্টা কথার মানুষ বঙ্গবন্ধু। গবেষকরা বলেন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল জনগণ। নিজের জন্মদিন বা মৃত্যু নিয়ে ভাববার সময় তার ছিল না। তবে একাত্তরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন উপলক্ষে বায়তুল মোকারম মসজিদে আছর নামাজের পর বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘায়ু কামনা করে মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা শেখ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ বিন সায়িদ জালালাবাদী। পরের দিন ১৮ মার্চ দৈনিক পূর্বদেশ, ইত্তেফাক ও আজাদ পত্রিকায় এ সংক্রান্ত সংবাদ ছাপা হয়। মাহমুদ হাসানের ‘দিনপঞ্জি একাত্তর’ এবং ড. মোহাম্মদ হান্নানের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থেও একাত্তরের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন সংক্রান্ত এ বিবরণ পাওয়া যায়।

একাত্তরের সেই উত্তাল দিনগুলোর ওই বিশেষ দিনে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে জনতাকে সেদিন তিনি বলেছিলেন- তার জীবনটাই জনগণের জন্য। তাই তার জীবন-মৃত্যু জনগণের জন্যই উৎসর্গীকৃত। জনগণের মুক্তিই যে তার একমাত্র লক্ষ্য। ওই জন্মদিনে তিনি তা ব্যক্ত করেছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিষ্কারভাবে বলেন, তিনি জন্মদিন পালন করেন না। জন্মদিনে মোমবাতি জ্বালান না এবং কেকও কাটেন না। বঙ্গবন্ধু বলেন, আমি জনগণেরই একজন। আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যু দিনই কি। আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। গবেষকরা বলেন, ‘বাঙালি জাতির মহান ঐতিহ্য বিশেষ করে লৌকিক ঐতিহ্যের প্রতি বঙ্গবন্ধুর প্রচন্ড দরদ ছিল। বঙ্গবন্ধু শহুরে আচারে অভ্যস্ত ছিলেন না। শহুরে আচার-আচরণ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু একজন লোকনায়ক বলেই জন্মদিন নিয়ে তার এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ও সাধ প্রতিফলিত হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই বলতে পেরেছেন, তিনি জন্মদিন পালন করেন না। বঙ্গবন্ধু জাতির প্রকৃত প্রতিনিধি। তিনি দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় নিয়ে সাধারণ মানুষকে কখনো দূরে সরিয়ে দেননি।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে হয়তো আজ আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ থাকতো না। বাঙালির আপোসহীন এই নেতার আবির্ভাব না হলে একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তারই বজ্রকন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহবান। বাঙালি জাতির চেতনাকে, ভিতরের সুপ্ত শক্তিকে অভ‚তপূর্ব যাদুতে নাড়া দিয়েছিলেন-এই মহান নেতা। তিনি আমাদের মাঝে সময়োপযোগী আত্মপোলব্ধির উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। বাঙালি জাতিকে বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের রূপকার তথা স্বপ্নদ্রষ্টা। শেখ মুজিব শুধু একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী চেতনা। জাতির জনকের কাছে বাংলাদেশের সব মানুষ ঋণী।

বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে থাকলে আমরা একটি সুখী সুন্দর সোনার বাংলা অনেক আগেই অর্জন করতে পারতাম। বিজয় অর্জনের পর সরকার গঠন করে তিনি একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে যেভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেটাই তার প্রমাণ বহন করে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি এবং তাদের দোসররা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে সেই পথ রুদ্ধ করে দেয়। অথচ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরী তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে দেশ আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি-গৌরবের বাংলাদেশ।

Advertisement

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার চেতনা আজও বেঁচে রয়েছে আমাদের মাঝে। সেই চেতনাকে শক্তিতে পরিণত করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে উজ্জীবিত হোক তরুণ প্রজন্ম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রজন্মের প্রাণঢালা বিনম্র শ্রদ্ধা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: বিজ্ঞান ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কেএসকে/এমএস